ইউসুফ কামাল : নয়.
জীবনগ্রন্থির মায়াজাল বড়ই অদ্ভুত, কোথায় কখন, কে যে কার কাছে বাঁধা পড়বে তা কেউই বলতে পারে না। শাহেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে দেখা হওয়ার আগে তো একরকম ভুলেই গিয়েছিলো ইলা’কে, স্মৃতির অতলে একরকম হারিয়েই ফেলছিলো। ইলা’র কলেজে যাওয়ার সঙ্গীর সাথে দেখা হয়ে গেলে মনে পড়ে যেত অমিমাংসিত গল্পের এক অধরা কন্যার কথা। যার সাথে তুলনা চলে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ নব যৌবনা এক হরিণী শাবকের সাথে। কখনো মনটা হারিয়ে যেত ঝাউতলা পার হবার সময় ঝড়ো হাওয়ার শব্দের মাঝে, ঠিক যে জায়গায় এসে ইলা দাঁড়িয়ে পিছনে তাকিয়ে শাহেদকে খুঁজতো। একটা অদ্ভুত ব্যাথা নাড়া দিয়ে যেত সেই সাথে ছোট্ট একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসতো বুকের অর্গল ভেংগে। মনকে বোঝাতো কতো পাখীই তো দূরদুরান্তে উড়তে যেয়ে পথ হারিয়ে ফেলে, একবার হারিয়ে গেলে কি সে আর ফিরে আসে?

তবু মানুষের মনতো আশাতেই থাকে হয়তো দেখা আবার হয়ে যাবে, অদৃষ্টে হয়তো এমনই লেখা ছিলো। কথায় কথায় ইলা তো একদিন সেটা বলেই ফেলেছিলো, আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিলো বেঁচে থাকলে দেখা একদিন হবেই। তাইতো চলতি পথে দু চোখ খুঁজে বেড়াতো সেই মানুষটাকে, যদি কখনো দেখা হয়ে যায়? শাহেদও পরে ইলার কথাটা বিশ্বাস করেছিলো, মন থেকে কিছু চাইলে সত্যিই নাকি সেটা পাওয়া যায়! শাহেদের সাথে দেখা হওয়ার পর তার সেই বিশ্বাসটা যেন আরো মজবুত হয়ে মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলো। আর তাই এই দেখা হয়ে যাওয়াটাকে ইলা সত্য সত্যই একটা ঐশ্বরিক যোগাযোগ বলে ধরে নিয়েছিলো, যদিও সেটাতে একটু দেরীই হয়ে গিয়েছিলো। আর তার জন্য আক্ষেপ করে ইলা একবার বলেও ফেলেছিলো, দেখা হলোই যখন সেটা আর এক বছর আগে কেন হলো না? তাহলে তো জীবনটা এমন ওলট পালোট হয়ে যেতো না। শাহেদের অফিসের ফোনে মাঝে মাঝেই লংডিস্ট্যান্ট কল চলে আসতো আমেরিকা থেকে, ইলার ফোন। এমনিতেই কাজের চাপে বা মন বেশি খারাপ থাকলে কখনো চিঠি না লিখতে পারলে সেটার জবাবদিহিতা স্বরুপ ফোনে কথা বলে পুষিয়ে নিতো।

এর একটা মনস্তাত্তিক দিকও আছে, মুখে অনেক কথা সরাসরি বলা যায় না কিন্তু লিখে সেটা প্রকাশ করা অনেক সহজ। সেখানে কোন মানসিক প্রতিবন্ধকতাই কাজ করে না বরং স্বাচ্ছন্দ বোধ করা যায়। মনের সুপ্ত কথাগুলো খুব সহজেই লিখে প্রকাশ করা যায়, আর তাই তো ইলাও যেন লিখেই অবলীলায় নিজের মনটাকে হাল্কা করে ফেলতো। শাহেদ বুঝতো ইলা মনের কষ্টগুলো বলতে পেরে ধীরে ধীরে যেন ভারমুক্ত হচ্ছে। একটা মানুষ যার কতই বা বয়স বিদেশ বিভূইয়ে একাকী সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিপদসংকুল এই মুহূর্তে তো তার হাত ছেড়ে দেওয়া যাবে না, তাহলে তো হারিয়ে যাবে চিরতরে সাগরের অতলান্তে। কি বিচিত্র মানুষের মন, ভাবাই যায় না। শুধুমাত্র একটা ভালোবাসার দাবি নিয়ে কেউ একটা মানুষের জন্যে তেপান্তরে অপেক্ষা করে দিনের পর দিন পার করে দিতে পারে? নিজের রক্তের বন্ধনকেও দূরে সরিয়ে রেখে? পিছনে একটাই শক্তি বা সাহস যাই বলা হোক সেটা হলো মনের টান, যার সামনে আর অন্য কোন বন্ধনই দাঁড়াতে পারে না। যা কোন যুক্তিতর্ক দিয়েই খন্ডন করা যায় না, শুধুমাত্র মন দিয়েই অনুভব করা যায় অন্য কিছুতেই নয়।

মায়াবীগ্রন্থির মায়া জালে শাহেদ এখন আর ইলার বিকল্প কিছু ভাবতেই পারছে না। অদ্ভুত একটা মনের টান যা দেখা যায় না, যার অস্তিত্বই শুধু মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করা যায়। প্রতিটি স্পন্দনের সাথেই যেন সেটা জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্টে। শাহেদ সেদিন নোমানের সাথে কথা বলার পর পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে ইলা এখন সম্পূর্ণভাবেই তার অপেক্ষায় বসে আছে, কারো সাথেই এখন তার আর কোন রকম যোগাযোগ বা সম্পর্ক নাই। শাহেদ খুব ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্তে চলে এলো, এমতাবস্থায় ইলার কাছ থেকে দূরে থাকা শাহেদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। মনে মনে প্রচন্ড একটা কষ্ট অনুভব করছে ইলা’র বর্তমান অবস্থার জন্য, সেই সাথে কেন যেন নিজেকেও সে দায়মুক্ত ভাবতে পারছে না। সম্পর্কের নৈতিকতা এমন একটা বিষয়, একবার কোথাও বাঁধা পড়ে গেলে সেটা ঠিক রাখার জন্য কোন বাধাকেই আর অলংঘ্যণীয় মনে হয় না। সময়টাকে কেউ ইচ্ছা করলেও ধরে রাখতে পারে না, সময় তার নিজের গতিতেই চলে। শাহেদ ভাবছে আর একটু সময় যাক্ ভালো একটা পোষ্টিং নিয়ে একটু স্থিতি হয়ে বসি। রেজাল্ট যেহেতু ভালোই ছিলো একটা ফরেন পোষ্টিং হয়ে গেলে পরবর্তি সিদ্ধান্তে যাওয়াটা তার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। তাছাড়া মা’কে বলেই দিয়েছে এ সব ব্যাপারে যেন কোন চিন্তা না করে, সময় সুযোগ মতো সে সে জানাবে।

এর মধ্যেই পেশাগত কারণে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ মিশনে চল্লিশ দিনের ‘মিশন অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন’ এর উপর একটা কোর্সের সুযোগ এসে গেলো। বিষয়টা ইলা’কে জানাতেই সে প্রচন্ড খুশী, বলেই ফেল্লো এ দিকে পারলে চলে আসো। আমি তো আছিই এখানে কোন অসুবিধাই হবে না। তবে পারলে সত্যিই চলে এসো, আমি আর পারছি না শাহেদ। ইলার আজকের এই প্রথম স্বীকারোক্তিতে শাহেদ বুঝলো ও সত্যিই আর পারছে না, ধীরে ধীরে নিজের মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থা বেশি দিন চল্লে বড় কোন সমস্যা হয়ে যেতে পারে। ঘন্টাখানেক কথা হলো শুধু স্মৃতি রোমন্থন করেই। কথায় কথায় শাহেদ বলে ফেল্লো চাকরিতে জয়েন করার পর তার ছুটি নিয়ে দেশে যাওয়ার কথা। ইলাদের সেই সরকারি বাসা, রাস্তামুখী সামনের দিকের জানালার কথা যেটা দিয়ে দূর থেকে শাহেদকে দেখেই তো ইলা কলেজে বেরিয়ে পরতো এক সাথে হওয়ার জন্যে। আর সেই ঝাউগাছের শব্দ আর সাথে পিছন ফিরে দেখা – শাহেদের স্মৃতি রোমন্থনের গল্পে ইলা কি নতুন করে একটু লজ্বা পেলো? ইলার উচ্ছ¡াসে শাহেদের দূর থেকে মনে হলো ও যেন সেই পুরনো দিনগুলোতেই ফিরে গেছে। মনে হলো ইলা যেন তার সমস্ত দুঃখ কষ্টগুলো সাময়িকভাবে ভুলে গেলো। ভালোবাসা এমনই জিনিষ আপন মানুষের সংস্পর্শে এলে সব হারানোর পরও আবার যেন সব কিছুই নতুন করে সজীব হয়ে ওঠে। নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়, ফিরে পায় বেঁচে থাকার নতুন প্রেরণা।

সমস্ত প্রতিকুলতা সত্বেও সেই হারানো দিনগুলোকে মনের মধ্যে নিয়েই তো ইলা এখনো বেঁচে আছে । শাহেদ মনে মনে নিজের কাছে প্রশ্ন করলো শুধু ইলার কথাই বা কেন, সে নিজেও কি ইলার স্থানে বিকল্প কাউকে বসাতে পেরেছে? কলেজ জীবনে ইলা’র বাবা বদলী হয়ে চলে যাবার পর তো একরকম বিচ্ছিন্নই হয়ে থেকেছিলো লম্বা একটা সময়। কিন্তু কই তখনও তো শাহেদের মন থেকে ইলা হারিয়ে যায়নি? ভুলতে পারেনি ইলা’কে। জীবনের প্রারম্ভের ভালো লাগা তো সারাজীবনের মধুরতম স্মৃতি যা কখনোই মন থেকে হারায় না, প্রাণভোমরার মতোই যেন সযতেœ চুপটি করে বসে থাকে বুকের গভীরে।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, ইউএসএ