বিদ্যুৎ সরকার : ‘আমি কিছু দিন একা থাকতে চাই।’
‘আমি আমাকে নিয়ে ভাবতে চাই। একান্তভাবে? আমাকে নিয়ে, শুধুই আমাকে নিয়ে।’
‘এ জন্য আমার যা যা করার প্রয়োজন আমি সব কিছুই করতে সচেষ্ট থাকবো।’
‘আমার সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ এ মুহূর্ত থেকে বন্ধ রাখার প্রক্রিয়া শুরু করতে চাই।’
‘স্বল্প মেয়াদি থেকে ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ মেয়াদি বিচ্ছিন্ন থাকতে অভ্যস্ত হোয়ে যাবো আমি।’
‘হঠাৎ করে সব যোগাযোগ’ ডেড স্টপ ‘করে দিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।’

‘ধিরে ধিরে অধির মৌনতার দিকে এগিয়ে যাব আমি।’
‘বিচ্ছিন্নতা আমাকে আত্মমগ্নে আচ্ছন্ন হতে সহায়তা করে থাকবে আশাতীত, আমার বিশ্বাস।’
‘টাইম এন্ড টাইড ওয়েট ফর নান।’
‘আর কোন কালক্ষেপণ করতে চাই না আমি, ঢের হোয়েছে, আর নয়।’
‘কথা দিচ্ছি আমি আবার ফিরে আসবো আপনাদেরই মাঝে।’
‘কিছুটা দিন আমি একা থাকতে চাই, আমি আমাকে নিয়ে ভাবতে চাই। আমি আমার জন্য ভাবতে চাই। আমার প্রতি আমি বড্ড অবহেলা করেছি।’

‘এই রৌদ্রোজ্জ্বল সোনালী সকাল, ঝিরিঝিরি দখিনা সমীরণ, টুপ টুপ ঝরা বকুলের শব্দ, শুকনো পাতাদের উড়োউড়ি, মেঘলা আকাশে সিঁদূরে মেঘ, হঠাৎ রিমঝিম বৃষ্টি টিনের চালে গাছের ডালে ঝিলের জলে। পানকৌড়ির ডুব সাতার গহিন জলে – সবই থাকবে যেমনটি আছে। শুধু, আমিই একটু সরে আসবো আমার অবস্থান থেকে। তাও ক্ষনিকের এ চলে আসা।’
সাম্পান রেস্তোরাঁয় কফি খেতে খেতে কথা হচ্ছিল কুহুর সাথে। ওর অবশ্য কফির চেয়ে বেশি পছন্দ আইসক্রিমে। তাই, ভেনিলার সাদ নিতে নিতে কথাগুলো কুহু বলে যাচ্ছিল। সা¤প্রতিক উপলব্ধি থেকে সাময়িক নির্জলা এ উচ্চারণ তার। কুহু প্রকৃতিপ্রেমি। প্রকৃতি বেষ্টিত হয়ে থাকতেই তার পছন্দ। এর চার দেয়ালের মাঝেই তার সুখ, তার দু:খ বিরাজমান। ওর জীবনে দু:খের চেয়ে সুখের পাল্লাটাই বেশি ভারি। অবশ্য দু:খ না থাকলে যে সুখের রঙ ফিকে হয়ে যায় তা তো অজানা নয় তার। তবুও জীবন নিয়ে ভাবতে চায় সে। এ জন্য চাই স্বঘোষিত নির্বাসন। একাকিত্ব যা তাকে তার মতো করেই ভাবতে সুযোগ সৃষ্টি করে দিবে নির্বিঘেœ। প্রতিটি মানুষেরই জীবনে কোন না কোন এক দিন এ মুহূর্তটি ঠিক ঠিকই চলে আসে আচম্বিত। তখন, নিজকে নিয়ে ভাবতে ব্যক্তিটিকে ভীষণভাবে প্রলুব্ধ করে। কুহুর জীবনে হয়তো সেই ক্ষণটি চলে এসেছে এরই মধ্যে।
তার আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয়েছে অনেক আগেই। সময়ও গড়িয়েছে, সন্ধ্যা ছুৃঁই ছুঁই। এখন আর এক কাপ কফি হলে মন্দ হয় না। এবার কিন্তু কুহুও আমার সাথে কফি পানে সামিল হলো।

কফির কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম –
: পারবে তো একাকিত্ব বরন করতে?
: কেন পারবো না?
: তুমি এতোটাই বন্ধু বৎসল যে তোমার পক্ষে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হোয়ে একাকী থাকাটা কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। বরঞ্চ আমার পক্ষে হয়তো সম্ভব হতে পারে।
: তোমার ধারণা ভুল। আমি মনের দিক দিয়ে কতটা স্ট্রং তা হয়তো তুমি জান না। যা ভাবি তা করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। আর, তোমার দ্বারা কোন দিনও তা সম্ভব নয় এ বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত।
: আমায় আন্ডার এস্টিমট করছো না তো?
: মোটেও তা নয়, তোমাকে আমি রিড করতে পারি।
তোমার স্বভাব, আচার-আচরণ বলে দেয় তুমি আমাদের সাথে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারবে বড়জোড় একদিন কিংবা দুদিন। তাও বহু কষ্ট করে থাকতে পারবে, এর বেশি নয় মোটেও।
: তুমিও কি পারবে তোমাকে পরিপূর্ণভাবে আলাদা করে নিতে তোমার পারিপার্শ্বিক ভাবনাগুলো থেকে? যখনি তুমি কোন নির্দিষ্ট ভাবনায় মন নিবেশ করলে তখন তো অপ্রত্যাশিতভাবে অন্য কোন ভাবনা-চিন্তা এসে বিঘœ সৃষ্টি করতে পারে!
তোমার একাকিত্ব এখানে তার বৈশিষ্ট্য হারাবে বৈকি! সে অর্থে তোমার সত্ত¡া, তোমার একাকিত্ব অনেকাংশেই বিবর্ণ।
: লিভ মি এলোন প্লিজ। আমি একা থাকতে চাই।
আমাকে নিয়ে আমায় থাকতে দাও, আমার ভাবনা আমার চেতনা, জীবন বোধ।
কেমন আছে কুহু?

বেশ ক’দিন হলো ওর কোন সাড়া পাচ্ছি না। ও কি ভালো আছে, আগে যেমন থাকতো, উচ্ছল, উজ্জ্বল ঠিক যেন একটি দুষ্ট প্রজাপতি উড়ে উড়ে যায় ফুলে থেকে ফুলে মন থেকে মনে। কত দিন দেখা হয় না, কথা হয় না টিএসসি’র সবুজ চত্বরে, লাইব্রেরীর মসৃন করিডোরে, সাম্পানের গরম চায়ের টেবিলে?
কুহু কি প্রতিদিন সকালে ঘুমের ঘোরে গান শুনতে ভালোবাসে, কুহু কি মন খারাপের দিনগুলোতে একা একা বসে ছবি আঁকে, কুহু কি মেমোরিতে ফিরে আসা প্রিয় ছবিগুলো না দেখে আনমনে শরতের আকাশ দেখে?
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে।
কুহু, তুমি কেমন আছো, কুহু তুমি কেমন থাক বেলা, অবেলায়, নিশি-দিন জানতে ইচ্ছে করে।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা