বিদ্যুৎ সরকার : জলের সাথে জয় দাসের যত যোগা যোগ। ত্রিশোর্ধ এক মাথা কুচকুচে কালো কোকড়ানো চুল। চওরা ঘার, সুঠাম দেহের অধিকারী জয় দাস। উচ্চতা ছয় ফুট না হলেও কাছাকাছি তো অবশ্যই। মাছ ধরা তাদের বংশগত পেশা। নদীর পাড় ঘেঁষে প্রায় দুই মাইল প্রসারিত দাস পাড়ার বাসিন্দা জয় দাস। তিন ভাই বোনের মধ্যে জয় দাসের অবস্থান দ্বিতীয়। কৈশোরে মাকে হারিয়ে মায়ের আদরের বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়ে জয় দাস ও বাকি দুই বোন। বড় বোন ঘর সামলাতে ব্যস্ত থাকতে হয়। ছোট বোন মাঝে মাঝে বোনকে গ্হৃস্থালী কাজে সহায়তা করে মন চাইলে। কানামাছি ভোঁভোঁ, গোল্লাছুট এক্কা দোক্কার ছকের মধ্যেই জীবনের সব সুখ আনন্দ খুঁজে পায়। নাম আঁখি। কাজল কাল ডাগর ডাগর দুটি চোখের আলোয় আলোকিত সে। ওর দু-চোখে চোখ পড়লে চোখ ফেরানো দায় যে কেউর। চোখ তো নয় যেন শ্রাবণ ধারায় প্লাবিত দুটি ছোট্ট পুকুর। মায়া ভরা ছায়া ঘেরা চোখে রাজ্যের প্রশান্তির ছোঁয়া। আঁখি চঞ্চল উচ্ছল পাখি উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে বেড়ায় পাড়া ময়। সবাই তাকে আদর করে কাছে ডাকে এটা ওটা খেতে দেয়, গাছের ফল বিন্নি ধানের খৈ নোয়েল গুরের সন্দেশ কত না কি? মেয়ে বেলার বয়সটাই অমন ফড়িং হয়ে হাওয়ায় পাখা মেলার। চঞ্চল মন চায় কোথাও হারিয়ে যাবার।

বিয়েটা জয়ের জন্য যতটা না প্রযোজ্য ততোধিক বাস্তবধর্মী হবে তাদের মা হারা এ সংসারের জন্য। আর বোনের বিয়ে হবার পরই না তার প্রসংগ আসা সমীচিন। সামনের বছর বড় বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তার পছন্দের ছেলের সাথে। রাখির বিয়ে হয়ে গেলে সমস্ত ঘরময় একটা শূন্যতা এসে ভর করবে নির্ঘাৎ। বিশেষ করে আঁখির জন্য প্রথম প্রথম খুবই খারাপ লাগবে দিদির অবর্তমান পরিবেশে নিজকে মানিয়ে নিতে। বাবা মাছ ধরতে গেলে এক নাগারে দুই থেকে তিনদিন সাগরের মোহনায় ভাসতে হয়। সাগরের নোনা হাওয়া তার এখন আর সহ্য হয় না। বয়সের ভারে এখন অনেক কিছুই তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছে। জয় দাস মনস্থ করেছে বোনের বিয়ের পর থেকে বাবা আর সাগরে মোহনায় যাবে না, তার বদলে সে নিজেই সাগরে মাছ ধরার কাজে যাবে। আর, রান্না-বান্নার কাজটা মনে হয় বাবা ভালোই সামলিয়ে নিতে পারবে। আঁখি বাবাকে কাছে পেলে বরং খুশিই হবে এন্তার। বোনের বিয়ের পর আঁখি অনেকটাই একাকী হয়ে গেছে। তার চঞ্চলতা, উচ্ছলতায় ভাটা পড়েছে। রাত-দিন মন মড়া হয়ে বসে থাকে। জয় দাস তার বোনের হঠাৎ এমন বদলে যাওয়াটাকে গুরুত্ব দিলো।

শীঘ্রই বিয়ে করার বিষয়কে সামনে নিয়ে এলো। উপরন্তু তার তো অনেক আগেই বিয়ে করার কথা ছিল। শুধু বোনের বিয়ে দেয়ার জন্যই তার এ অপেক্ষা। আত্মীয় পরিজন সব্বাই মেয়ে খুঁজছে জয়ের বিয়ের জন্য। জয়ের মতো একটি সহজ সরল ছেলের জন্য চাই তেমনি একটি মেয়ে। ছোট বোনের প্রতি অবশ্যই যেন সে মেয়ের ভালো লাগা থাকে। জয় মোহনায় যায় মাছ ধরার নৌকায় অন্যান্যদের সাথে। মাছ ধরে, নানান কাজে সবার সাথে হাত মিলায়, খায়-দায়, অবসর পেলে শুয়ে শুয়ে কত কিনা ভাবে সে। ছোট বোন, বাবা আর সদ্য বিয়ে দেয়া বোনের কথা। তার ভাবনার একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে তার বিয়ের বিষয়। যাকে সে বিয়ে করবে সে দেখতে কেমন হবে? তাকে ভীষণভাবে ভালোবাসবে তো? যখন এভাবে মাছ ধরতে চলে আসবে তখন খুব বেশি কষ্ট পাবে নাতো? এমন সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে। ঘুমের ঘোরে নৌকার পাটাতনের জলের শব্দকে ভুল করে নদীর জলের কল কল ধ্বনি মনে করে। স্বপ্নের মধ্যে সে সাতরিয়ে মোহনার দিকে যায়। হঠাৎ জয় দাস বিরাটকায় পাঙ্গাস দেখে তার পিছু ছুটতে শুরু করে দিল। এটা তার ধরা চাই-ই চাই! পাঙ্গাসের ধব ধবে সাদা মসৃণ দেহ, কী নরম তার শরীর! জড়িয়ে ধরে থাকতে ইচ্ছে করে সারাক্ষণ। নিরিহ পাঙ্গাস কত অসহায় যেন একটি অবলা সুন্দরী তন্বী। জয় দাস সত্যি সত্যি এক সময় সাঁতরিয়ে পাঙ্গাসটাকে ধরেই ফেলেছিল। কিন্তু এতো পিচ্ছিল বলে হাত ফসকে চলে গেল। দুঃখে কষ্টে তার স্বপ্ন দেখা ঘুমটা ভেঙ্গে যায়।

জয় দাস নব বধূর এমন উত্তরে আরো যেন চঞ্চল হয়ে উঠলো। ঘোমটা সরিয়ে প্রথমে কপালে পড়ে রাঙ্গা দুটি ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো জয় দাস। পৃথিবীর সমস্ত লাবন্য বুঝি ছড়িয়ে পড়লো নব বধূর চোখে মুখে। জয় দাস বুঝি এই প্রথম জীবনের অন্য এক রকমের সুখ খুঁজে পেল। – কলি? – হুম। – কলি, তুমি ফুল হোয়ে কখন ফুটবে? – মরশুম এলেই দেখা যাবে, সুবাস ছড়ালেই বুঝা যাবে। – তুমি কি আরো কাছে আসবে, আমার বুকের কাছে? – আসবো, হারিকেনের আলোটা একটু কমিয়ে দেয়া যায়? – আমিতো সেই আলোতে তোমার রূপ সৌন্দর্যের সবটুকু দেখতে চাই। – কলিতো আস্তে আস্তে ধিরে ধিরে তার পাপড়ি মেলবে, কথায় বলে না সবুরে মেওয়া ফলে। কলি একে একে তার পাপড়ি মেলে ধরছিল আর জয় দাস বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল কলির মেলে ধরা শরীরটা। শীর্ণকায়, শ্বেতকায়, মসৃন একটি সদ্য ফোটা ফুল যেন। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় হারিকেনের আলো নিভে গেলে কলি ভয়ে জয়কে জড়িয়ে ধরে। জয়ও কলিকে বুকের কাছটায় সজোরে টেনে নিল। হাত দিয়ে কলির সমস্ত শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল। বার বার জয়ের কেন জানি মনে হচ্ছিল এ যেন তার স্বপ্নে দেখা বহুল প্রত্যাশিত সুডৌল, শ্বেত শুভ্র মৎস কন্যা ‘পাঙ্গাশ মাছ’।

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো