বিদ্যুৎ সরকার : ১.
এখানে বছরের প্রায় অর্ধেকটা জুড়েই শীতের প্রভাব। অথচ ভাবখানা এমন সবেতো আসলাম থাকি না আর কিছুটা সময়, কিছুটা দিন। মাঝে মাঝে এমনও হয় এই বুঝি শীতের অবসান ঘটলো। কিসের কি তখনই এক ঝাক বরফ মাথায় করে এনে বিছিয়ে দেবে চার পাশ। শ্বেতশুভ্র চারিধার, এক মনোরম দৃশ্যের মনোময় উপস্থাপনা যেন। নবাগত ভ্রমণ প্রেমীদের দৃষ্টির কাছে এ দৃশ্য যতই মুগ্ধকর মনে হোক না কেন দেহ কিন্তু ততটা কিছুতেই মেনে নিতে চাইবে না।

সোহানা গ্রীষ্ম প্রধান দেশের মেয়ে। শীতের প্রথম ভাগে তার প্রথম সেমিস্টার শুরু। প্রথম যেদিন পিয়ারসন্স এয়ারপোর্টে পা রাখলো দিনের শীতল সুবাতাসে তার দেহের সাথে প্রাণও জুড়িয়ে গেল অজান্তেই। মনে মনে সে এমনটাই বুঝি চেয়েছিল এতোদিন। তাড়াহুড়োর মধ্যে ডর্মেই উঠে পড়লো বাক্স-পেটরা নিয়ে। সাথে করে কীইবা আনবে কিছু জামা-কাপড়, জরুরি কাগজ -পত্র, বন্ধুদের জন্য উপহার ও ওর প্রিয় লেখকদের গল্প কবিতার বই। সোহানা বই পড়তে যেমন ভালোবাসে তেমনি ভালোবাসে ঘুরে বেড়াতে, ছবি তুলতে ও হরেক রকমের ফিঙ্গার ফুডস খেতে। হেমন্তে (ভধষষ) পাতার রং বদলের খেলা দেখে সোহানা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে প্রকৃতির দিকে। ঝটপট কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়ে মনের মতো ছবি তুলতে। সত্যিই তো এমন রঙ্গিন মনোরম দৃশ্য খুঁজে পাওয়া ভার। সময়ের সাথে সাথে পাতারাও রং বদলায়। সবুজ থেকে হলুদ, গাঢ় হলুদ, কমলা, লাল। এক সময় রঙ্গীন পাতারা ঝরে পড়ে মৃত্তিকার বুকে। পাতাবিহীন গাছেরা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে আরেক বসন্তের অপেক্ষায়। এখানে মূলত গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত, বসন্ত এ চারটি সিজন প্রত্যক্ষ করা সম্ভব।

২.
জিনিয়ার সাথে ওর ভাব হোয়েছে প্রথম দেখাতেই। দু’জনের ভাবনায় অনেকটা মিল রয়েছে, মিল রয়েছে পছন্দ – অপছন্দের বিষয়গুলোর সাথেও। একই ক্লাসে পড়ার সুবাদে দিনের সিংহভাগ সময় দু’জন এক সাথে থাকার সুযোগ ঘটে যায়। সময় কাটাবার উপকরণগুলো কোন অবস্থাতেই সাংঘর্ষিক নয়। বরঞ্চ একে অপরের সম্পূরক। এমন করেই দু’জনের বন্ধুত্বের বাধনটুকু আরো দৃঢ় হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে। প্রায় প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে দূরে কিংবা কাছের প্রাকৃতিক দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে বেড়িয়ে পরা চাইই চাই। জিনিয়ার মতো একজন বন্ধু সাথে থাকলে হাজারো কষ্ট নিমেষেই উবে যেতে বাধ্য। সোহানার ভালো লাগার সরল রেখাটুকু আস্তে আস্তে জিনিয়াদের বাড়ির আঙ্গিনায় এসে থমকে গেছে। এখানে যেন সে ভালো লাগার সবটুকু উত্তাপ খুঁজে পায়। জিনিয়ার মা’র মাতৃসম স্নেহ মমতা, ছোট ভাই অংকুরের চঞ্চলতা, আদরমাখা খুনসুটি, পাকামো সবকিছুই তার ভাল লাগতে থাকে অহর্নিশ। এ দূর প্রবাসে সোহানার মনের জানালা এসে বার বার উঁকি দিয়ে যাওয়া দুঃখগুলোকে অনেকটাই ¤øান করে দেয় জিনিয়াদের অকৃত্রিম আদর আর ভালোবাসা। তবুও কিছুটা দুঃখ তাকে মাঝেমধ্যে আচ্ছন্ন করে রাখে যখন সে দীর্ঘক্ষণ একাকী থাকে। একমাত্র গানই তখন তার এ একাকিত্ব ঘুচিয়ে দিতে কিছুটা হলেও সহায়ক ভ‚মিকা রাখতে পারে। ‘আমি খোলা জানালা তুমি দখিনা বাতাস….’ কিংবা ‘কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়…’ গানগুলো বেজে যায় বিরামহীন। সবধরনের গান তার প্রিয়। ব্যান্ড সংগীত থেকে শুরু করে রবীন্দ্র সংগীত, ভাটিয়ালি থেকে সুফি, মারফতি সব গানই ভাল লাগে তার।মন ভালো থাকার অবসর সময়গুলো কেটে যায় কবিতা পড়ে। ছুটির দিনগুলোতে ছবি তোলা ছাড়াও মুভি দেখা, এ ছাড়া একটু বাড়তি সময় পেলে জিনিয়াকে সাথে নিয়ে রান্না-বান্নার হাতেখড়ি দেয়ার চেষ্টা চালানো।

জিনিয়াদের বাড়িতে ভালো-মন্দ কিছু রান্না হলে ওর মা বলবে সোহানাকে ক্লাস শেষে নিয়ে আসতে। এভাবে সোহানা যেন জিনিয়াদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেল এ ক’মাসে। সোহানা আসলে অংকুরও মনে মনে আনন্দিত হয়। তিনজন মিলে এটা ওটা বানিয়ে খাওয়া, গল্প, খুনশুটিতে সময় কেটে যায়। অংকুর জিনিয়ার চেয়ে দু’বছরের ছোট স্বভাবতই সে দু’ক্লাস নিচে পড়ছে একই ভার্সিটির সাইন্স ফ্যাকাল্টিতে আর সোহানা জিনিয়া আর্টস ফ্যাকাল্টিতে। অবশ্য ফ্যাকাল্টি দু’টো পাশাপাশি, কাছাকাছি হওয়ার সুবাদে প্রায় সময়ই না চাইলেও দেখা হয়ে যায় পরস্পরের সাথে। দেখা হলেই ক্যাফেটেরিয়ায় বসে কফি বা চা সাথে টা নিতেও ভুল করতো না অংকুর। পেমেন্টের দায়িত্ব ওদের উপর চাপিয়ে দিয়ে বন্ধু সান্নিধ্যে হারিয়ে যেতে মোটেও দেরি করতো না সে। তার এই চঞ্চলতা, শিশু সুলভ আচরণ সোহানার মোটেও খারাপ লাগতো না কখনো। ছোট হওয়ার বাড়তি সুবিধাটুকু আদায় করে নিতে ভুল করেও ভুল করতো না অংকুর।

৩.
জিনিয়া চলে যাচ্ছে। দু’দিন পরেই তাকে ভার্জিনিয়ার জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে হাজির থাকতে হবে। সুতরাং আজই তার শেষ রাত সোহানা, অংকুর ও তার মা’র সাথে। সোহানা আজ ওদের সাথেই রাত কাটাবে। পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি ওরা কেউই মেনে নিতে পারছে না। বিশেষ করে ভালো লাগার ট্রায়াঙ্গাল ক্ষেত্রটি জিনিয়ার অনুপস্তিতে অনাবাদি থেকে থেকে ভালোবাসার ফসলহীন আগাছায় ভরে যাবে একদিন। অজ্ঞাত, অশ্রæত অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটির জন্য কেউ-ই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। বেশ কিছুদিন আগে জিনিয়া ঐ ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ চেয়ে এপ্লিকেশন জমা দিয়ে ছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ করে তার এ অফার চলে আসে। যা কি না জিনিয়া এরই মধ্যে ভুলতে বসেছিল। ডিনার শেষে তিন জনে মিলে গল্প হচ্ছিল, স্মৃতি জাগানিয়া ফেলে আসা দিনের গল্প। কেমন একটি বিয়োগান্তক নাটকের মহরা যেন। তিন জনের প্রত্যেকই বার বার একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল কিন্তু বাক্য বিনিময় হচ্ছিল খুবই কম এবং অপ্রাসঙ্গিক। দুঃখ মাখানো বিচ্ছেদ পরস্পরকে কেমন ধিরে ধিরে নির্বাক করে দেয়, স্থবির করে দেয় একটা সময়ের ব্যবধানে, সেটাই দৃশ্যমান হচ্ছিল বার বার। সকাল সকাল উঠতে হবে, কোন অবস্থাতেই ফ্লাইট মিছ করা যাবে না তাই অনিচ্ছা সত্তে¡ও তাদের চলে আসতে হলো ঘুমের ঘরে। ঘুমহীন রাত কাটে সবার। ঘুম যেন গুম হোয়েছে কোন্ অজানায় কেউ তা জানে না।

সময় মতই এয়ারপোর্টে পৌঁছে যেতে বেগ পেতে হয়নি অংকুরের। গাড়ি পার্ক করে পিছন থেকে লাগেজ নামিয়ে ওদের সাথে সাথে ইমিগ্রেশনের দিকে এগিয়ে গেল অংকুর। ইমিগ্রেশনের সীমানায় পৌঁছানোর আগেই জিনিয়া ওদের দু’জনকে এক সাথে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে ছিল। শব্দহীন মৌনতায় এক হিরন্ময় নিরবতা যেন বিরাজ করছিল চারিধারে। এখানে ভালো লাগা, ভালোবাসা আবেগের উত্তাপ, অনুরাগের ছোঁয়া সবকিছুই মিষে আছে চৌম্বক আবেষে। হাত ছাড়াছাড়ির আগে অংকুরকে উদ্দেশ্য করে বললো সে যেন সবসময় বিভিন্ন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সোহানাকে সহায়তা করে, মাঝে-মধ্যে গাড়িতে নিয়ে বেড়াতে বের হয় এবং ভাল-মন্দ কিছু রান্না হলে বাসায় নিয়ে আসে।

৪.
– এতোটা ইমোশনাল হলে চলবে কেমন করে, সে তো আমার বোন কই আমিতো এতটা ভেঙ্গে পড়িনি?
– ছেলেদের ইমোশনটা বাই বার্থ একটু কমই থাকে।
– চল আজ তোমাকে একটি নতুন রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাই ওখানে গরম গরম লুচি ভেজে দেবে, বুটের ডাল আর ভেজিটেবল দিয়ে দারুন জমবে। সাথে সাউন্ড ট্র্যাকে অবিরাম হারানো দিনের গান।
– এর আগে কখনো যাইনি ওখানে?
– বললামতো না। নামটাও এর সুন্দর ‘সপ্তডিঙ্গা’, নিশ্চয়ই তুমি এখন মেনে নিবে?

– একটা শূন্যতা আমাকে পেয়ে বসলো বোধহয়!
– শুধু শুধু তুমি ফ্রাস্টেটেড হচ্ছ। জিনিয়া চলে গেছে সত্যি, আমিতো এখনো আছি। যে কোন প্রয়োজনে পাবে আমাকে। জিনিয়াও বলে গেছ তোমার সব ধরনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে, তোমার পাশে দাঁড়াতে।
– আমি জানি তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে, বিপদেআপদে আমার পাশে থাকবে। কিন্তু তারপরও ওকে ভীষণভাবে মিস্ করবো।
– তা অবশ্য ঠিক সবকিছু হয়তো আমাকে দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হবে না!

– আমি জানি তুমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট ডিভোটেড টু ইউর ওয়ার্ড।
– মিষ্টি জাতীয় কিছু কি খাবে না কি চায়ের কথা বলবো?
– মিষ্টি খেয়ে খেয়ে তো জাম্বোজেট হয়ে যাচ্ছি, না বাবা আর মোটা হতে চাই না।
– এখন তুমি পরিমিত ফিগার নিয়ে ভালোই আছ। এর চেয়ে কম বা বেশি কোনটারই প্রয়োজন নেই। পারফেক্ট।
– তুমিও দেখি ভীষণভাবে ফিগার সচেতন।
– কে না সুন্দরের পূজারী? সুন্দর সর্বত্রই সমাদৃত।
– আমি জানি আমি মোটেও সুন্দর না।
– সেটা যাচাইয়ের গুরু দায়িত্ব তো আমজনতার। ওদের উপরই ছেড়ে দাওনা।
– তুমিতো দেখছি আমাকে সুন্দরীর তকমা না ঝুলিয়ে ছাড়বে না?
– আমি যেটা ফিল করি, যেটা বাস্তব সেটাই প্রকাশ করলাম এই যা।
– জিনিয়াকে ভীষণ মিস করবো,হাটতে বসতে ও যেন আমাকে জড়িয়ে থাকতো সর্বক্ষণ। আজ থেকে বিরাট একটি শূন্যতা, একাকিত্ব আমার অনুষঙ্গ হোয়ে গেল বুঝি!

– ওর দিকটাও একবার ভেবে দেখ, ও কিন্তু আমাদের সব্বাইকে মিস করবে। সুতরাং তার কষ্টটা আরো বেশি।
মন বেশি খারাপ লাগলে আমাদের বাসায় না হয় চল, মারও ভালো লাগবে তোমাকে কাছে পেলে।
– গেলে ভালো হতো কিন্তু, দু’দিন বাদেই আমার একটি এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার কথা। তাই, ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও যেতে পারছি না। পরে একদিন না হয় আসবো।
– ও কে, তা হলে আর কি করা। চলো তোমাকে ড্রপ দিয়ে বাসায় ফিরে যাই, মা বাসায় একা, তার নিশ্চয়ই খুব খারাপ সময় কাটছে!
– হুম! যেতে পারলে সবার দুঃখগুলো কিছুটা হলেও লাঘব হতো। এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে সেদিনই আন্টিকে দেখতে আসবো।
– তোমার কষ্ট করে যেতে হবে না, আমি এসে নিয়ে যাব, তুমি রেডি হয়ে থেকো। আর, পরের দু’দিন ভার্সিটি বন্ধ সুতরাং সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েই তুমি যাচ্ছ কিন্তু।

– জিনিয়া নেই অতটা ভালো লাগবে না নিশ্চয়, শুধু শুধু রাত কাটানো!
– আমরা আছিতো, তোমার ভাল লাগার বিষয়গুলো সম্পর্কে কিছুটা হলেও তো জানা আছে আমার, এতটা নিরাশ হচ্ছো কেন?
– তোমার দূরদর্শিতার তারিফ করতে হয়। ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করবো, তুমি আসার আগে একটা ওয়েক আপ কল দিও প্লিজ। এখন আমাকে এখানটায় নামিয়ে দিলেই চলবে, ভিতরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
– ও কে নামাচ্ছি। তুমি কিন্তু প্রস্তুত থেকো আমি সময় মত চলে আসবো।
– তোমার প্রিয় একটি জিনিস দিচ্ছি, একটিই ছিল নিয়ে নাও।
– বাঃ, কিট ক্যাট! দারুন!! যুগ যুগ জিও! বাইই!

৫.
– কল না দিতেই ঝট পট রিসিভ?
– আসলে এ ক’দিন ঘুমটাও ঠিকমতো হয়নি। ওর চলে যাওয়া, এসাইনমেন্ট জমা দেয়া, ব্যাক হোমে মা’র হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া এসব মিলিয়ে মানসিক অস্থিরতায় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা খুবই স্বাভাবিক।
– এরই মধ্যে এতোকিছু? কল দিলেই পারতে?
– কেন, তুমি কি আমার হাউস ফিজিশিয়ান, ডাকলেই সব রোগের উপশম হয়ে যাবে?
-হলেও তো হোতে পারে।
– বাদ দাও, আন্টি এখন কেমন?
– অনেকটাই ওভারকাম করতে পেরেছে, তারপরও মাঝে মাঝে কেমন আনমনা হয়ে পড়ে।

– এ অবস্থা থেকে উত্তরন ঘটতে আরো কিছুটা সময় লাগবে বৈকি! আমারও কি সবকিছু আগের মতোই চলছে? মোটেও না,নদী যেমন শুকিয়ে গেলে তার রেখাটুকু রেখে যায়…..! আমার বেলায়ও তাই ঘটে চলছে।
– আমরা তো সরাসরি বাসায় যাচ্ছি এখন?
– একটু বাংলা পাড়া হয়ে যেতে চাচ্ছি।
– ওখানে আবার কী ঘটলো হঠাৎ করে?
– এখনও ঘটে নাই তবে ঘটাবো।
মানে কি?
– গেলেই বুঝতে পাবে বাচাধন।
– ‘উন্দাল’ এর অর্থ কি, বুঝতে পারলাম না?

-সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় চুলোকে ‘উন্দাল’ বলেই ডাকে। নতুন রেস্তোরাঁ ক’দিন হলো শুরু করেছে। এদের খাবার দাবার, ব্যবহার এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা আপ টু দ্যা মার্ক।
– এখন আবার ব্র্যাকফাস্ট করার প্রয়োজন কি? মা তো বাসায় সব রেডি করে রেখেছে। তুমি গেলেই সবাই মিলে একসাথে বসে ব্র্যাকফাস্ট করবো। সেদিনের বদলা বুঝি?
– তা হলে গরম গরম সদ্য ভাজা কয়েকটি পরোটা নিয়ে যাই কি বল?
– সেটা করা যেতে পারে, আমারও ভীষন পছন্দ। পরে না হয় এক দিন সময় নিয়ে বসে খাওয়া যাবে!

ব্র্যাকফাস্ট করতে করতে স্বভাবতই জিনিয়ার প্রসঙ্গ চলে এলো। সোহানাই প্রথম জিনিয়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়লো, সাথে সাথে জিনিয়ার মাও। অংকুর কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লো ঠিকই কিন্তু, পরক্ষণেই নিজকে সামলে নিয়ে এ অবস্থার অবসান ঘটাতে বিষয় বস্তু পালটিয়ে দিল। যেহেতু সোহানা এসেছে সেজন্য কি কি রান্না হবে এটা জানতে চাইল ও’র মা’র কাছে। মা ফ্রিজ থেকে মাছ, মাংস নামিয়ে ডি-ফ্রস্ট করতে জলে ভিজিয়ে দিল। কিছু সব্জিও নামিয়ে নিল। সোহানাও সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। দুপুরের খাবার শেষ করে তিনজনে মিলে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল হঠাৎই সোহানার ফোন বেজে উঠতেই দৌড়ে গিয়ে কল রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে জিনিয়ার কন্ঠ শুনেতো অবাক! এতোক্ষণ ওর পছন্দের খাবারগুলোর কথাই বলাবলি হচ্ছিল মধ্যাহ্নকালিন এ আড্ডায়। তিনজনই থ বনে গেল জিনিয়ার এমন উপস্থিতিতে।পর পর তিনজনি কথা বললো।কথা যেন শেষ হতে চায় না কারোরই। প্রিয়জনের সান্নিধ্য কে না চায় হউকনা তা অযান্ত্রিক কিংবা যান্ত্রিক। মা স্বভাব সুলভাবেই মেয়ের কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো, অংকুরের আকুতি কতদিন লাগবে ক্লাশ ছুটি হতে, সোহানার আবেগময় কথোপকথন। এন্ডলেস ভালোলাগা আর, ব্রিথলেস কথা বলা।

৬.
গত রাতের চেয়ে আজ জ্বরের ধকল অনেকটাই বেশি। তাপমাত্রা কিছুতেই ১ ডিগ্রির নিচে নামতে চাচ্ছে না। মাথায় টাইম টু টাইম জল দেয়া হচ্ছে, গা স্পঞ্জ করে দেয়া হচ্ছে আর ওষুধ তো আছেই। সমস্ত শরীর ব্যথায় টন টন করছে, খাওয়া দেখলে গা গুলিয়ে আসে এসমস্ত উপসর্গ তো আছেই। কিছুই মুখে নিতে চাচ্ছে না। যা একটু আধটু খাচ্ছে তা ঐ সোহানার আদরমাখা বকুনি আর জোর জবরদস্তির কারনেই। সোহানা না থাকলে যে কেমন করে ওর মা একা একা ওকে সামলাতো তা ভেবে অবাক হতে হয়। ভাগ্য ভালো সোহানা আছে বলেই রেহাই। রাত গড়িয়ে তখন প্রায় একটা। অংকুরের সেবা-যতেœর কাজে সোহানাকে আজ রাত জেগে থাকতে হবে। ওষুধ-পততর সমস্ত কিছু হাতের কাছে দিয়ে চলে যেতে হলো অংকুরের মাকে। কাল সারারাত জেগে থাকতে হয়েছিল অসুস্থ ছেলের পাশে। এমনিতেই প্রেশারের প্রবেøম, পর পর দু’রাত নির্ঘুম কাটালে তার শরীরও খারাপ হবে নিশ্চিত।
তাই অনেকটা জোর করেই ঠেলে পাঠাতে হলো তাকে।

– এখন কিছুটা ভাল লাগছে?
– আগের চেয়ে অনেকটা ভাল ফিল করছি।
– তোমাকে কে বলেছিল সেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে?
– আমিতো আর্টস ফ্যাকাল্টির দিকে যাচ্ছিলাম, মাঝ পথে হঠাৎ বৃষ্টি। ইচ্ছে ছিল তোমার সাথে দেখা করার। দেখাতো হলোই না মাঝখান থেকে জ্বরটা বাধাইলাম আর কি।
– আমাকে বললেইতো পারতে? ফোন করোনি কেন, আমি না হয় অপেক্ষা করতাম।
– বলে কয়ে কি সব সময় আসলে হয়, হঠাৎ দেখার আনন্দটাইতো আলাদা মাত্রার।
– এসব পাকামো ছাড়,এখন জ্বরে কে ভুগছে তুমি না কি আমি?
– তাতে কি সেবা-যতœতো কম পাচ্ছি না।
– ঠিক আছে কাল সকালেই আমি চলে যাব, দেখি রাত জেগে জেগে কে কাকে সেবা দেয়?
– আমি জানি তুমি যাবে না।
– তোমাকে কে বলেছে, আমি যাবো না?
– কেউ বলেনি, আমার মন বলছে।
– বলিহারি তোমার মন!

– ‘মন হাওয়ায় পেয়েছি তোর নাম,
হাওয়ায় হারিয়ে ফেললাম….’ চন্দ্র বিন্দুর গানটি নিশ্চয়ই শুনে থাকবে, কেমন লেগেছে তোমার?
– অবশ্যই দারুণ। ইদানীং ‘ভ‚মি’ প্রকাশিত কয়েকটি গান শুনছি যা আগে কখনো শুনিনি। জানি না তুমি শুনেছো কি? বেশ ভাল গেয়েছে, লিরিকসেও তারুণ্যের ছোঁয়া।
– দু’য়েক লাইন গাওতো শুনি।
– আমি গায়ক নাকি বললেই গেয়ে উঠবো?
– তা হলে একটু না হয় হাসো, তোমার হাসিতেও পুলক আছে। বিশেষ করে টোল পড়া গালের হাসি।
– এসব বস্তাপচা ডায়েলগ বাদ দিয়ে ঝটপট স্যুপটা খেয়ে ফেলতো।
– হুম, সত্যি কথা বললেই শুনতে হয় আমি শুধু ‘পচাকথা’ বলি! যাও আমি কিছুই খাবো না। হউক না আমার বেশি করে জ্বর তাতে তোমার কী?
– যা চাইবে তাই পাবে যদি, তুমি আমার কথামত স্যুপ শেষ করে ফেল।
– সত্যি বলছ তো?

– সত্যি সত্যি সত্যি, তিন সত্যি বললাম।
– তাহলে এক্ষুনি ঝটপট দু’টো ‘হামি’ দিয়ে ফেল।
– খাবে তুমি এর জন্য ‘হামি’ দিতে হবে আমাকে, মামা বাড়ির আবদার আর কি?
– এমন করে বলছো কেন, খুব বেশি কি চেয়েছি বল? ঠিক আছে চাই না আমি তোমার ‘হামি’।
– ওরে বাবা এতো রাগ! উমা, উম্মা, উম্মা- এবার হল তো?
– তুমি অ নে ক সুইট।
– আমারটা কই?

– তোমাকে আমি একবারই দেব কিন্তু তোমার ঠোঁটে।
– কেন? আমিতো তোমার ঠোঁটে দেইনি।
– তোমার ঠোঁটের উপরের ছোট্ট মিষ্টি তিলটির জন্য এবং থ্রি ইজ্ টু ওয়ান, ও কে?