বিদ্যুৎ সরকার : অনেক দূর থেকেই প্রপেলারের শব্দ শোনা যায়। এ শব্দ তার অনেক আপন, হৃদয়ের অনেকটা জুড়েই এ শব্দের তরঙ্গ তরঙ্গায়িত হতে থাকে চোখে দেখার শব্দ চোখের সিমানা অতিক্রম হওয়ার পরও। এ শব্দের সাথে জড়িয়ে আছে দৃশ্যমান মস্ত একটি জলযান। গাঢ় হলুদ রঙের রকেট স্টিমার। যখন ঘাট অভিমুখে ক্রমশ আসতে থাকে দূর থেকেই এর আগমনী বার্তা বয়ে বেড়ায় স্টিমারের দু’ধারে দু’টো চলমান হুইল, যার সাথে যুক্ত আছে অনেকগুলো প্রপেলার। প্রপেলারের ঘূর্ণনে জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে পদ্মা নদীর জলকে দ্বিখণ্ডিত করে স্টিমার এগিয়ে চলে আবার থেমে যায় সারেং-এর ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। যখন প্রপেলারগুলো ভীষণ জোরে ঘুরতে থাকে হুইলের দু’ধারে বিরামহীন জলরাশি শব্দ করে ছিটকে পরে, স্টিমার তখন জোড়ে চলতে থাকে।

একবার স্টিমারের টিকেট মাস্টারকে অনেক বলে কয়ে নাদের আলী স্টিমার ঘুরে দেখার অনুমতি পেয়েছিল। নাদের আলীর জীবনের একটি অনন্য স্মরণীয় দিন ছিল সে দিনটি। স্টিমারে উঠেই প্রথমে উপরের তলার ডেকে, সারেং-এর কেবিন অতপর নিচের তলায়। উপরের বিশাল চিমনি যেখান থেকে অনবরত কালো ধোয়া বের হতে থাকে কখনো অনেক বেশি কখনো পরিমাণে কম। ধোয়ার উৎপত্তি স্থল খুঁজতে গিয়ে তো নাদের আলী হতবাক! স্টিমারের গহ্বরে পাটাতনের ভেতর এক এলাহি কান্ড। বিভিন্ন চেম্বারে কয়েকজন মিলে বেলচি দিয়ে অনবরত কয়লা দিয়ে যাচ্ছে। সে আগুনের লেলিহান শিখায় ওরাও যেন পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল। লাল বর্ণের আগুনের চুল্লি যেন উত্তাপ ছড়াচ্ছে উপরের অংশেও। যেখানে নাদের আলী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদের অদেখা দৃশ্যসমূহ দেখে যাচ্ছিল। কয়লা জ্বালানোর কারণ পরবর্তিতে জানতে পেরেছিল সে। আগুনের তাপ দিয়ে জলের বাষ্প তৈরি করে হুইল ঘোরানোর শক্তি উৎপন্ন করা হয়। এ জন্য এর নাম স্টিমার। মূলতঃ স্টিম থেকে উৎপন্ন শক্তি দিয়েই বিরাট এ জলযান সচল করা হয় দুটি বিরাট হুইলের ঘূর্ণনের মধ্য দিয়ে, যেখানে প্রপেলারগুলো সংযুক্ত আছে।

স্টিমার ঘাটের একপাশে একটি টং ঘর। সেখানে সাধারণত চা আর বিস্কুট বিক্রি করা হয়। রমজান চাচা এ চায়ের দোকান চালান। সকাল থেকে রাতের স্টিমার আসা অব্দি দোকান খোলা রাখে। দুপুরের খাবার বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। তাই রাতেই একবারে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে রমজান চাচা। নাদের আলী রমজান চাচার দোকানে ছোট-খাটো ফুট ফরমায়েশ খাটে, বিনিময়ে সারাদিনে কয়েক কাপ চা আর কুকিজ বিস্কুট খাওয়ার সুযোগ পায়। স্টিমার আসলে অনেক সময় যাত্রিদের মালামাল গন্তব্যে পৌঁছে দেয়, বিনিময়ে কিছু পায়। তবে সে কখনো চাওয়া-পাওয়া নিয়ে উচ্চ বাচ্য করে না। যার দরুন অল্প দিনের মধ্যেই নাদের আলী সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠলো। কাজ না থাকলে রমজান চাচার লম্বা বেঞ্চটায় বসে বসে গল্পে মেতে উঠে দু’জনে। বিশেষ করে এ স্টিমার ঘাটের গল্প নাদেরের ভালো লাগে বেশি। কখন থেকে এ ঘাট চালু হয়েছে তা কিন্তু রমজান চাচা সঠিক বলতে পারে না। কৈশর থেকেই এ ঘাট ও চায়ের দোকানের সাথে সখ্যতা নাদের আলীর। কত মানুষ আসে যায়। কত মানুষ শুধু যায় আর কোন দিন ফিরে আসে না এ গ্রামে। হয়তো চির দিনের জন্য হারিয়ে যায় এ ঠিকানা থেকে। আবার অনেকে ফিরে আসে নিজ গ্রামে আর কখনো তাদের যাওয়া হয় না। রমজান চাচার সাথে কত মানুষের যে পরিচয়, গুনে শেষ করা ভার। রমজান চাচার মুখে নানান মানুষের গল্প শুনতে নাদের আলীর ভীষণ ভালো লাগে। বিভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন গল্প তাকেও সমৃদ্ধ করে মানুষের মন সম্পর্কে জানতে প্রতি নিয়ত। দুপুরের দিকে বাড়ি চলে যায় আবার ফিরে আসে বিকেলের আগেই। ওর এখন সব সময় মুখস্থ, কখন কোন লঞ্চ ঘাটে ভিরে। কিন্তু তার প্রধান আকর্ষণ হলুদ রঙের স্টিমার কখন আসে কখন যায়। দূর থেকে প্রপেলারের শব্দ তাকে উদ্দীপিত করে, গায়ে শিহরণ জাগায়। আর, স্টিমারের ভোঁ শব্দটাও অনেক প্রিয়, অনেক দূরে থাকতেই এ ভোঁ শব্দ শোনা যায়। তখন চারদিক থেকেই যাত্রীরা ঘাটে এসে ভির করতে থাকে। আবার, স্টিমার ছাড়ার পূর্বে বার দু’য়েক এমন ভোঁ শব্দ করে থাকে। রাতের বেলায় স্টিমারের সার্স লাইটের আলো অনেক দূর থেকেই ঘাটের আশেপাশে আলোকিত করে তুলতো। নাদের আলীর মনে পড়ে ছোট কালে সেই সার্স লাইটের আলো এসে ঠিকরে পড়তো তাদের বাড়ির গাছ-গাছালিতে, উঠোনে। তখন বুঝতে পারতো স্টিমার আসছে, তাদের তখন রাতের খাবার খাওয়ার সময় হতো। এ ভাবেই হলুদ স্টিমার নাদের আলীর জীবনের অনুযোগী হয়ে গেল অজান্তেই। সকাল-সন্ধ্যা খুঁজে বেড়ায় হলুদ স্টিমারের গোপন উপস্থিতি। হলুদ স্টিমার ও নাদের আলী একে অপরের সম্পূরক। এক অবিচ্ছেদ্য, অবিচ্যুত অবস্থান তাদের।

ইদানিং ঘাটের যাত্রীদের মালামাল গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে ভালোই উপার্জন করে নাদের আলী, যেখান থেকে অনেকটাই ব্যয় করে সংসারের জন্য। প্রতি মাসে কিছু না কিছু টাকা জমা পড়ে তার মাটির ব্যাংকে। টাকা জমানোর দুটি গোপন উদ্দেশ্য আছে তার। বছরে অন্তত একবার শহরে গিয়ে সিনেমা দেখা ও শখের এটা ওটা কেনা এবং দ্বিতীয়টি হলো ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ির আয়োজনে পূজার সময় পাঁচদিন ব্যাপী যাত্রা দেখা ও মেলায় বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করা। মেলায় আসা রকমারি খাবারের দোকানগুলোতে বসে খাওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম। যাত্রা ও মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষের সমাগম হয় এ পূজা-আঙ্গিনা জুড়ে ও আশ-পাশের খোলা জায়গাগুলোতে। নাদের আলীর বছরের এ দুটি মুহূর্ত তার প্রধান দুটি সুখময় সময়।

দিন যায়, মাস যায়, নতুন বছরও আসে সময়ের আবর্তে। নাদের আলীর আয়ের পরিমাণও বেড়ে চলে ক্রমশ। আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি কাজ করতে সমর্থ সে। নিজ গ্রাম ও পাশের গ্রামগুলো নিয়ে দুই থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় প্রতি বাড়ি তার অল্প বিস্তর চেনা হোয়ে গেছে গত এক বছরে। ঘাটে আসা-যাওয়া করে এসকল যাত্রীদের কাছে নাদের আলী সুপরিচিত তার সহজ সরল ব্যবহারের জন্য। একবার স্টিমার ঘাটে ভিরলে অনেক যাত্রীর সাথে তাদের গ্রামের কেরামত মিয়ার পরিবারও নেমে আসে। কেরামত মিয়া, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান। সবার হাতেই কম-বেশি মালামাল ছিল। এত মালামাল দেখে নাদের আলী ভাবলো হয়তো তারা শহর থেকে একেবারেই চলে এসেছে তাদের গ্রামের বাড়িতে। কেরামত মিয়া শহরে গিয়ে দর্জির কাজ করে ভালোই উপার্জন করত, সংসারে স্বচ্ছলতা ছিল। কিন্তু, হঠাৎ এমন কী হলো তল্পি-তল্পা গুছিয়ে চলে আসতে হলো তাকে গ্রামের বাড়িত? কেরামত মিয়া সম্পর্কে চাচা হন নাদের আলীর। গোলাপির হাতের আস্ত একটি গোলাপ ফুল আঁকা টিনের ট্রাংকটা বেশ ভারিই মনে হলো নাদেরের। তাই, কাছে গিয়ে চাচা-চাচিকে সালাম জানিয়ে গোলাপির হাতের ট্রাংকটি নিজ হাতে নিয়ে নিল। কেরামত চাচার হাত থেকেও একটি বোঝা নিল সে। নানান গল্প করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের গাছ-গাছালি দিয়ে ঘেরা বাড়িতে পৌঁছে গেল। নাদের তার হাতের ট্রাংক ও বোঝা নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসতে চাইলে কেরামত চাচা ও চাচি এক সাথে থামিয়ে দিয়ে একটু বসতে বললো। কিছুক্ষণ পর গোলাপি নাদেরের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসলো। নাদের আলী এবার খুব কাছ থেকে তার মুখমন্ডল দেখার সুযোগ পেল। গোলাপি যেন আগের চাইতে আরো বেশি সুন্দর হোয়ে উঠেছে। খাবার দিতে দিতে গোলাপি নাদের আলীর বাড়ির সবার কুশলাদি জানতে চাইলো। চলে আসার সময় কেরামত চাচা তার জামার পকেটে কিছু টাকা ভরে দিল। নাদের আলীতো কিছুতেই নিবে না কিন্তু, কেরামত চাচাও নাছোরবান্দা। শেষ অব্দি নাদেরকে হার মানতে হল। ফিরে আসতে আসতে একটি বিষয় একটু হলেও যেন ভাবিয়ে তুললো। অনেক দিনের অদেখা গোলাপি এ কয়েক বছরের ব্যবধানে কতটাইনা বদলে গেছে। বয়স বারার সাথে সাথে তার রূপ লাবণ্যের ছটা গোলাপিকে আরও মায়াবী করে তুলেছে। চঞ্চলতা কমলেও চোখের দৃষ্টিতে প্রখরতা বেরেছে অনেক। নাদের আলী চায় গোলাপির সে দৃষ্টির গভীরে পৌঁছতে।

শরতের মৃদু হাওয়ায় দোলে কাশ বন, দোলে নাদের আলীর মন। আর ক’দিন বাদেই রায়দের বাড়িতে বাজবে ঢাক, চলবে যাত্রা পালা, জমবে মেলা বকুল তলা। গোলাপি এবারও মেলায় আসবে, যাত্রা দেখবে। এবার কিছু বাড়তি টাকা জমিয়েছে নাদের আলী। গোলাপির সোহাগী দু’হাত ভরে লাল রেশমি চুরি পড়াবে সে। কপালে কাচ টিপ, চুলের ফিতা, নাক-ফুল, কানের দুল, রক্তজবা আলতা সবকিছু দিয়ে তাকে সাজাতে চায় নাদের আলী।

নাদের আলীর এ সুপ্ত ইচ্ছা শিহরণ জাগায় মনে।শাখে শাখে পাখি ডাকে, ফুল ফোটে।
কিন্তু, গোলাপির হঠাৎ চলে যাওয়াটা অপ্রত্যাশিত দুঃখ বোধকে উচকে দেয় নাদের আলীকে। বিগত কয়েক দিনের ওর এলোমেলো আচরণ, পাংশুটে মুখ স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকানোর মুহূর্তগুলো নাদের আলী মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে। গোলাপির নিরীহ, সরল মুখচ্ছবি কেমন করে হঠাৎ এমন বদলে যেতে পারে সেটাই এ কদিন ভেবে ভেবে আসছিল সে। তার অনিচ্ছাকৃত অবহেলা নাদের আলীকে কষ্ট দিচ্ছিলো বার বার। আজ চাচার সাথে বাজারে দেখা না হলে জানা হতো না এর মূল কারণ। চাঁদপুর থেকে গোলাপির খালাতো ভাই এসেছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। একটি বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে গোলাপির। তাই, কালই তাকে চাঁদপুর যেতে হবে ওর ভাইয়ের সাথে। ফুল হোয়ে ফোটার প্রত্যাশা নিয়ে যে কলি উন্মুখ ছিল এতদিন সে কি অকালেই ঝরে যাবে নাদের আলীর সোহাগী শাখা-প্রশাখা থেকে? কী এক অব্যক্ত বেদনায় নাদের আলীর দেহ – মন ব্যথিত। সেই সকাল থেকেই স্টিমার ঘাটে বসে আছে নাদের আলী। কোন কাজে মন টানে না শুধু রমজান চাচার দোকানের কয়েক কাপ চা আর বিস্কুট দিয়ে সকাল -দুপুরের ক্ষুধা নিবারনের চেষ্টা চালিয়েছে। বিকেলের স্টিমারে গোলাপি চলে যাচ্ছে ভাগ্যকুল থেকে চাঁদপুর, চলে যাচ্ছে নাদের আলীর হৃদয়ের ক‚ল থেকে অন্য এক অচেনা, অজানার ক‚লে।বার দুয়েক স্টিমারের ভোঁ শব্দ শুনতে পেল নাদের। কিছু ক্ষণের মধ্যেই স্টিমার ঘাটে এসে ভিরবে। কেরামত চাচার ডাক শুনে পিছনে ফিরে তাকালো, সাথে খালাতো ভাই ও গোলাপিকে দেখতে পেলো। গোলাপি তার নত বিমর্ষ মুখটি তুলে অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো নাদের আলীর চোখের সীমানার অসীমে। যে চোখের শব্দ হীন ভাষা ছিল, নাদের আলী যেন সে চোখের নৈশব্দকে শব্দময় করে অনুভব করলো হৃদয় মাঝে। এ ব্যথা কিসে প্রশমিত হবে জানে না নাদের আলী। নদীর যেমন পার ভেঙে যায় নাদের আলীর মনও বুঝি তেমনি ভাবে ভেঙে খান খান, টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে সে মুহূর্তে। নাদের আলীর হৃদয় -নদী বড়ই খরস্রোতা শধু পার ভেঙে যায় অনবরত, ভালোবাসার চর জাগে না কোন কালেও। গোলাপি ও তার ভাই স্টিমারে উঠে গেল। কিছুক্ষণ পর বার দুয়েক ভোঁ শব্দ করে প্রপেলারে গতি এনে চলতে শুরু করে দিল স্টিমার। নদীর জল দু’ভাগ করে প্রপেলারে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে ক্রমশই দূরে চলে যাচ্ছে, দৃষ্টির অগোচরে। নাদের আলীর হৃদয়-নদী নিস্তরংগ, ঢেউ হীন, খরস্রোতা – এ পার ভাঙে ওপার গড়ে তোলা হয় না। কিছু ক্ষণ পর পার্শ্ববর্তী মাঠে চলে যায় সে, একাকী থাকতে চায়। সবুজ ঘাসের বিছানায় শুয়ে শুয়ে অদৃশ্যমান স্টিমারের প্রপেলারের চির পরিচিত শব্দটা শুনতে চায় নাদের আলী। যে শব্দের সাথে মিশে আছে একটি বিয়োগান্তক সুর। শুয়ে শুয়ে সে আকাশ দেখে, মেঘে ঢাকা তারা দেখে। একাদশীর চাঁদটাও বুঝি অনেকটা ঢেকে গেছে ঠিক যেমন গোলাপির মুখটিও ব্যথা আর বিষন্নতায় ঢেকে গিয়েছিল বিদায় বেলায়।প্রপেলারের শব্দ, একটি একাকী বিষন্ন চাঁদ-মুখ নাদের আলীর স্মৃতির কোলাজে স্থির হয়ে রইলো চিরদিনের জন্য।

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা