বিদ্যুৎ সরকার : ঢোল বাজছে সাথে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রও। মাঠের এক কোণে মানুষ বৃত্তাকারে বসে, দাঁড়িয়ে। কিসের আলামত, রঘুর বড় কৌতুহল। একবার কাছে গিয়ে দেখে আসার ভীষণ সাধ তার। সপ্তাহের দুটি হাঁটেই সে আসবে, বৃষ্টি-বাদল ঝড়-তুফান কোন কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারে না। হাঁটে এমন কিছু কিছু বিষয় ঘটে থাকে যা তার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। ওষুধের ক্যানভাস, সাপের খেলা, বানরের নাচ, কবিগান, পুঁথি পাঠ, হারানো দিনের হিন্দি ও বাংলা ফিল্মগান গেয়ে গেয়ে টোটকা ওষুধ বিক্রি, সর্ব রোগের তাবিজ, আরও কত কি! এসব দেখতে ও শুনতে রঘুর ভাল লাগে, প্রাণ জুড়ায়। আনন্দ খুঁজে পাওয়ার একটা বিরাট দিক তার কাছে। হঠাৎ মাইকের আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে রঘু। কী বলছে মাইকে? বার কয়েক চেষ্টা করে তবেই সে জানতে পারলো পরের হাঁট থেকেই রথখলা মাঠে হতে যাচ্ছে লক্ষণ দাসের নামকরা সেই সার্কাস। সবাই চেনে একনামে ‘লক্ষণ দাসের সার্কাস’। প্রতি বছরই শীত মৌসুমে কোন না কোন সার্কাস বা যাত্রা দল এখানে এসে তাঁবু গারবে। সার্কাস বা যাত্রা চলাকালে ছোট-খাটো একটা মেলা আমেজ সৃষ্টি হয় এর চার পাশ ঘিরে। তখন ছোট বড় সবার মনেই শিহরণ জাগে, জাগে ভালোবাসার চর। নবান্নের সুঘ্রাণে ম ম করে প্রতিটি গ্রাম। গ্রামবাসীদের ট্যাকে টাকা আসে, আসে আনন্দের উচ্ছ্বাস।

যাত্রা দলের কোন পালাই তার মিস হয় না। এমন কি, কিছু কিছু ভাললাগা ডায়েলগ মুখস্ত হয়ে যায় লঘুর। নদীর অপর পাড়ে বসে যাত্রার আসর, এপাড়েতে সার্কাস। দু’টোতেই তার আগ্রহের কমতি নেই। মন চাঙ্গা করার এক মহা ওষুধ যেন রঘুর। তাই বলে মনিবের কোন কাজেই খামতি নেই মোটেও। মনিবও খুশি হয়ে যাত্রা বা সার্কাস দেখার বারতি পয়সাটা হাতে গুজে দেয় নিয়মিত। এতে করে দু’জনের সম্পর্কের টানাপোড়েন হতে দেখা যায় না কখনো। দশ বছরের কাজের নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা তাকে এ সুনাম অর্জনে সহায়তা করেছে ভীষণভাবে। সুমন বনিক রঘুর প্রিয় মনিব। শুধু প্রিয় বললে অনেকটা কম বলা হবে, ‘পরম প্রিয়’ শব্দটাই এখানে বেশ মানান। সুমন বনিক আপাদমস্তক একজন ব্যবসায়ী, একটি রাইস মিল চলে রাত-দিন, বাজারে চালের আরত। দু’টোর দেখভাল তাকেই করতে হয়। ব্যস্ত থাকতে হয় সপ্তাহে সাত দিনই। মাঝে মাঝে ছুটি কাটায় নির্ভেজাল ছুটি। তখন কোন কাজ নয়, শুধুই আরাম আয়েশ। বিপত্মীক সুমন বনিক দ্বিতীয় বার বিয়ের ব্যাপারটা কোন কালেই আমলে নেয়নি। তার মতে একবারই প্রেম-ভালোবাসা, একবারই বিয়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে বিষন্নতায় আক্রান্ত হলে বন্ধু সান্নিধ্যে চলে যায় সুমন বনিক। সে রাতগুলোতে তার ফিরে আসতে গভীর রাত হয়ে যায়। বিশ্বস্ত রঘু বসে থাকে মনিবের ফিরে আসার অপেক্ষায়। রঘু ইদানিংকালে কিছুটা আঁচ করতে পারে মনিবের নিশিযাপনের বিষয়গুলো। মনিবের মুখের ঝাঝালো গন্ধ, অসংলগ্ন কথা, আবেগী আচরণ সোহাগী সংলাপ রঘুকে ভাবতে শিখিয়েছে একাকিত্ব মানুষকে কেমন করে কোথায় টেনে নিয়ে যায়। তিন রুমের দুটি ছোট, মাঝখানে একটি বড় যেখানে মনিব থাকে। ছোট দুটির একটিতে রঘু এবং অপরটি অতিথি এলে শোবার জন্য। তিন রুমের বাসায় ওরা দুজনই একাকি। একাত্তরের যুদ্ধে রঘু তার পরিবারে সবাইকে হারিয়াছে। শুধু, সেই বেঁচে আছে বড় স্বার্থপরের ন্যায়। তাই দুঃখের বোঝাটুকু তাকেই টেনে নিয়ে যেতে হবে আজীবন। বিপতœীক সুমন মন খারাপের রাতগুলোতে মনের মাঝে সুখ খুঁজে নিতে রাতভর শুয়ে, আধো ঘুমিয়ে ঘুরেফিরে শুনবে শুধু এন্টনি ফিরিংগির ‘আমি যে জলসাঘরে…’ কিংবা নিশিপদ্ম ছবির ‘ওরা যে যা বলুক…’ গান দুটি।

আজও তাকে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ছুটে যেতে হবে রথখলা মাঠে। ওখানে যে অপেক্ষা করছে তার জান পাখি ছায়া।

লক্ষণ দাস সার্কাসের একমাত্র তারকা সুন্দরী কসরতকারি ছায়া রাণী। তার রূপ লাবণ্যে ও দড়ির উপর খেলা দেখানোর দক্ষতায় ভীষণভাবে মজেছে যে রঘু। দর্শকের প্রথম সারিতে যে করেই হোক তাকে থাকতে হবে। যতবার ছায়া খেলা দেখাতে আসবে ততবার তার সাথে চোখাচোখি হবে রঘুর। ছায়ার চোখের ভাষা তার অজানা নয়। সে চোখের গভীরে লুকিয়ে আছে ভাল লাগার ধারাপাত। মাঝেমধ্যে দিনের বেলায় ছায়ার সাথে দেখা হোয়েছে, কথা হোয়েছে এটা ওটা উপহার বিনিময় হোয়েছে দুজনের। এভাবে ছায়ার মায়ায় আটকে যাওয়ার নামই কি ভালোবাসা? ভালোবাসার পরবর্তী পদক্ষেপ আটকে আছে এক অদৃশ্যমান বেড়াজালে। এ জাল ছিন্ন করে এখন ছায়াকে কাছে টেনে নেবার দায়িত্বটুকু তো রঘুরই। তার সমস্ত শক্তি যেন শুষে নিয়েছে কেউ। কিছু দিন ছুটি নিয়েছে ছায়া, এরই মধ্যে রঘুকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের।

আজই তাকে নিয়ে হাজির হতে হবে মনিবের সম্মুখে। নিশ্চয়ই না করবে না বরঞ্চ, খুশিই হবে। অনেক দিনইতো রঘুকে বলেছে বিয়ে করে ঘরে বৌ আনতে। থাকা খাওয়ার দায়িত্বটুকু সুমন বনিক নিয়ে নেবে তাতে সন্দেহ নেই। তবুও একটা ভয় নিয়ত কাজ করে মনের অলিন্দে! রঘু এও জানে ‘লজ্জা, ঘৃণা, ভয় এই তিন থাকতে নয়।’ যেমন করেই হোক আজ ছায়াকে নিয়ে সরাসরি মনিবের সামনেই দাঁড়াবে। কপালের লিখন যাই থাকুক, কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলবে কেমনে! গায়ে মেখে একরোখা বাতাস সে আজ এর শেষ সীমানায় পৌঁছাতে চায়। যে কোন মূল্যে ছায়ার মায়ায় আবদ্ধ হতে চায় রঘু।

রঘু ও ছায়া মনিবের কাছে এসে প্রণাম করতেই দুহাতে দুজনকে কাছে টেনে নিল সুমন বনিক। সে তার নিজ গলা থেকে একটি সোনার চেইন খুলে নিয়ে ছায়ার গলায় পড়িয়ে দিল। অবাক হোয়ে ওরা দুজন একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল বার বার। সুমনকে রাতের খাবারের বিশেষ আয়োজন করতে বলা হয়। খাবার শেষে মিষ্টিমুখ। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর সুমন রঘুকে বললেন অতিথি রুমে ছায়ার শোবার ব্যবস্থা করতে। আলমারিতে ধোয়া বিছানার চাঁদর ও মশারী তোলা আছে ওগুলো নামিয়ে নিতে বলে সে তার নিজ ঘরে চলে গেল। যেহেতু দুজনের বিয়ে হতে এখনো বাকি তাই, আলাদাভাবে অবস্থান করাই সমীচিন। বিষয়টি তিনজনের কাছেই পরিষ্কার। মনিবের মহানুভবতার তুলনা হয় না। আরো কিছুক্ষণ দুজনে কুজনে ভালোবাসা বিনিময় করে যার যার শোবার ঘরে চলে গেল। রঘু শুয়ে শুয়ে কতনা কিছু ভেবে ভেবে ঘুমকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এক মাস পরেই ছায়াকে বিয়ে করে বৌ বানিয়ে আপন করে ঘরে তুলে নেবে। কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে আরও কত কী? এক সময় সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লো, গভীর ঘুমে।

গভীর রাতে ছায়া কারোর হাতের পরশ পেল তার দেহে। শরীরের আনাচে-কানাচেতে হাতরিয়ে হাতরিয়ে কী খুঁজে বেরাচ্ছে? আহা বেচারা রঘু! মনিবের এতো ভয়! আর কটাদিন পর তো এমনিতেই সব পেয়ে যাবে না চাইতেই। আদর করে যে ফিসফিসিয়ে কিছু বলবে তারও জো নেই। ওর ঠোঁট দুটো দিয়ে ছায়ার ঠোঁট চেপে ধরলো আলতো করে, এমনকি জিভও। ছায়াও নিজকে আর ধরে রাখতে পারছিলো না। রঘুর সাথে সেও হয়ে উঠলো অপ্রতিরোধ্য। গোপনে, সংগোপনে এমন করে ভালোবাসতে কার না ভাল লাগে, তাও আবার বিবাহপূর্ব অভিসার। সুখ বুঝি এমন করেই খুঁজে নিতে হয়। এক সময় সব ভালোবাসা, সব আনন্দ সুখ কেন্দ্রিভুত হয়ে মিলিয়ে গেল বুঝি এক স্বর্গালোকে। দুজনেই ফিরে এলো নিজ নিজ অবস্থানে। রাত কেন অনেক দেরি করে ভোর হয় না? তবুও আজকের ভোরটা বুঝি অন্য রকম বর্ণে, গন্ধে ভরপুর ওদের কাছে।

রঘু-ছায়ার বিয়ে হোয়েছে আজ দুমাস। বিয়ে আয়োজনের সার্বিক দায়িত্ব সুমন বনিক একাই সামলিয়েছেন। আদর আপ্যায়ন, সাজ-সরঞ্জাম সবকিছুই পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল। আগত অতিথিবৃন্দ যেমন খুশি, তেমনি খুশি নববিবাহিত বর-কণে। স্বভাবতই সবার আনন্দ-সুখ প্রভাবিত করেছে সুমন বনিকের অন্তরের প্রান্তরে।

কিছুদিন ধরে ছায়ার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, খেতে গেলে দু-এক বার মুখে খাওয়া নিয়ে পড়ে আর খেতে পারছে না। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে রাতের বেলায়। শেষ অব্দি রঘু ছায়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার ছায়ার সব কিছু শুনে কয়েকটি টেষ্ট দিল। পরদিন টেষ্টের জন্য ওকে ল্যাবে নিয়ে যায় রঘু। দুদিন বাদে রিপোর্ট আনতে গেলে ডাক্তার হেসে স্বাগত জানিয়ে বললো যে ছায়া তিন মাসের অন্তসত্বা। এখন থেকে তার বিশেষ কেয়ার নেয়া দরকার।

রঘু হিসাবে মিলাতে ব্যর্থ, কেমন করে এমন হলো! ছায়ার সাথে ওর বিয়ে আজ দুমাস কাল। অথচ, ডাক্তারের পরীক্ষার ফলাফল বলে ছায়া তিন মাসের অন্তসত্বা? তিন মাস আগে যখন এ বাসায় আসে তখন তো তাদের বিয়েই হয়নি! রঘুর জীবনের অংক অমিমাংসিত রয়ে যায়। সততা, বিশ্বাস, নৈতিকতা কেন বার বার একটি বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে রঘুর সম্মুখে এসে দাঁড়ায়? প্রেম কি নোটন নোটন পায়রাগুলোর বাকুম বাকুম ডাক? ভালোবাসা কি একুরিয়ামের গোল্ড ফিস, ধরা-ছোয়ার বাইরের উপলব্দি? নাকি রঘু নিজেই আজ রং মেখে সং সেজে সার্কাসের মস্ত এক ক্লাউন বনে গেছে নিজের অজান্তে?