ভজন সরকার : প্রথম প্রজন্মের অধিকাংশ অভিবাসী বিশেষকরে যারা আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপের অন্যান্য দেশে থাকেন, তাঁদের কথাই বলছি। তাঁদের কথাই বলছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যারা এই সব উন্নত দেশে আবাস গেড়েছেন। বলাই বাহুল্য আমি নিজেও এদেরই একজন। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে এইসব অভিবাসীদের অধিকাংশেরই বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সাথে একমত নই এবং খুব বেশি উচ্চাকাঙ্খা রাখি না।

অথচ বাংলাদেশ থেকে যারা অভিবাসী হয়ে নয় বরং কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে এসেছেন, সেই সব বিপুল সংখ্যক খেটে-খাওয়া মানুষের অবদান সে তুলনায় অনেক বেশি। কারণ এই বিপুল সংখ্যক মানুষেরাই বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেনের এই সব তথাকথিত শিক্ষিত অভিবাসী-যাদের অধিকাংশই আর দেশে ফিরে যাবেন না কখনোই, তাঁদের বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা তাই অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। আর এই সব অভিবাসীদের দ্বিচারিতার কারণগুলোও বড় কৌতুহল উদ্দীপক।

প্রথমত, এই বিশেষ শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষগুলোর বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা ও শিক্ষাগ্রহনের সময় ৭৫ থেকে পরবর্তী দুই-তিন দশক, যখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের কথা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ এবং বংগবন্ধুর নেতৃত্বে যে আধুনিক ও বৈষম্যহীন একটি সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা চলেছিল, ৭৫ পরবর্তী সময়ে রেডিও-টিভি-সংবাদপত্র-পাঠ্যপুস্তক সবখানে সে ইতিহাস অনুচ্চারিত ছিল। আর এটাও তো পরীক্ষিত সত্য যে, শৈশব-কৈশোর-যৌবনের এ শিক্ষাগুলোই পরবর্তী জীবনে রেখাপাত এবং দেশাত্মবোধের মনোভূমি সৃষ্টি করে।
তাই স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের মানুষগুলোর অধিকাংশেরই বেড়ে ওঠা এক বৈরী পরিবেশে। সে কারণেই, সে সময়ে বেড়ে ওঠা অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই এক ধরণের সুক্ষ্ণ পাকিস্তানপ্রীতি ও ভারতবিদ্বেষী মনোভাব আছে, যার অন্য নাম সা¤প্রদায়িকতা। আর কানাডা, আমেরিকাসহ উন্নত প্রবাসের মুক্ত পরিবেশে সেই পাকিস্তানপ্রীতির চর্চা, বিকাশ ও প্রকাশ তাই বাহ্যত দৃশ্যমান। সে কারণেই, এইসব দেশের অভিবাসী বাংলাদেশী মানুষগুলোর অধিকাংশেরই অবস্থান ১৯৭১-এর স্বাধীনতার পক্ষের দল ও মতের বিপরীতে। অথচ এই অভিবাসী জীবনে তাঁরা সমর্থন করেন উদার এবং কিয়দংশ কমিউনিষ্ট ভাবাদর্শে বিশ্বাসী দলগুলোকে। বাংলাদেশে কট্ট্রর মৌলবাদী দলের নেতা কী করে অভিবাসী জীবনে প্রগতিশীল কিংবা কমিউনিস্টদের সাপোর্ট করতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয় একেবারেই!
দ্বিতীয়ত, এই সব দেশে বাস করা বাংলাদেশী প্রবাসীদের খুবই কম সংখ্যকই বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। কারণ, এ সব উন্নত দেশে চাকুরীর সীমাবদ্ধতা এবং ট্যাক্স ব্যবস্থা এমন যে, অর্থ জমিয়ে নিজ দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো প্রকারান্তরে অসম্ভব। বরং বাংলাদেশ থেকে অর্থ-সম্পদ সহজেই এই সব উন্নত দেশে আনা যায় উদারনৈতিক নিয়মনীতির ফাঁক-ফোকর গলে। তদুপরি এই অভিবাসীরাই দেশে যাওয়ার সময় স্নো-পাউডার-শ্যাম্পু-লোশন নিয়ে যান ঢাউস সাইজের লাগেজে ভরে। বিদেশে কেনা এই সব স্নো-পাউডারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশী।

তৃতীয়ত, তথাকথিত উন্নত দেশে অভিবাসী হিসেবে বাস করা এ মানুষগুলোর অধিকাংশই হিপোক্র্যাট। যা বলেন, করেন তার বিপরীত। যেমন, সারাক্ষণ নীতিকথা বলেন অথচ আইন-কানুনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সব ধরণের অপকর্ম করে থাকেন। সেটা কখনো ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া। কিংবা কখনো বিদেশের মুক্ত ও আপাত সহজ পদ্ধতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে অকল্পনীয় মিথ্যে তথ্যের সুযোগ নেওয়া।

তাই তো এই অভিবাসীরা সারাক্ষণ বাংলাদেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠ, ব্যাংকের টাকা লুটসহ সব কিছুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাংদেহী মনোভাব। অথচ নিজেই জমি-জেরাত-বাড়িঘর-ধন- সম্পত্তি বিক্রি করে হুন্ডি কিংবা অবৈধ পন্থায় কোটি কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসব দেশে বাড়িঘর কর্নে। এক ভদ্রলোক সেদিন বলছিলেন, যদি ঢাকা এয়ারপোর্টের বহির্গমনের সময় এই কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেনের তথাকথিত শিক্ষিত অভিবাসীদের চিরুণী তল্লাশি করা হোত তবে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অনেক অর্থ ঠেকানো যেত। সেই সাথে হুন্ডি তো আছেই। আছে এই সব দেশে গজিয়ে ওঠা ‘বেগম পাড়ার’ অর্থ পাচারের সাথে অনেক অভিবাসীর সংশ্লিষ্টতাও।

চতুর্থত, এই সব দেশে বাসকরা প্রবাসীদের অধিকাংশই নানান কারণে ধর্মীয় মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। আর সে মৌলবাদী চিন্তা-চেতনা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে এই অভিবাসীদের অনেকেই সচেষ্ট হয়। এ নিয়ে অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে যা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছে। উন্নত দেশে বাস করে মত-প্রকাশ এবং বাক-স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করেন। অথচ এই অভিবাসীরাই নিজ দেশের অন্য ধর্মবিশ্বাসী কিংবা অন্য রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন।
এতক্ষণ উন্নত দেশে বাস করা যে অভিবাসীদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলাম, তাঁদের সবাই প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী। অধিকাংশই শিক্ষিত এবং উচ্চ-শিক্ষিত। বাংলাদেশে সরকারী বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এসেছেন। বিগত শতকের আশির দশকে গজিয়ে ওঠা মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। বিজ্ঞান পড়েছেন, মুখস্থ করেছেন, উচ্চ নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন। কিন্তু মানবিকতা শেখেননি, দেশপ্রেম শেখেননি। শিখেছেন সা¤প্রদায়িক কুপমন্ডুকতা।

তুলনামূলক বিচারে অশিক্ষিত কিংবা অর্ধ-শিক্ষিত যে মানুষগুলো কর্মসংস্থানের জন্য মধ্য-প্রাচ্য এবং মালয়েশিয়াসহ নানান দেশে গিয়েছেন, তাঁদের অবদান উন্নত দেশে বাসকরা অভিবাসীদের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ নামক অপশাসন এবং জনসংখ্যার ভারে নিমজ্জিত একটি জনপদের যে ঈর্ষণীয় উন্নতি, তার পেছনের অবদান এই খেটে খাওয়া এবং রিমিটেন্স পাঠানো মানুষগুলোর। অথচ বাংলাদেশে এই প্রবাসী শ্রমজীবি মানুষেরাই হয়রানি হোন এয়ারপোর্টসহ সরকারী নানা অফিসে। আমরা একবারও ভেবে দেখি না, এই প্রবাসী জনশক্তির জন্যই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল আছে।

হঠাৎ করেই এই ‘প্রবাসী বনাম অভিবাসী’ চরিত্র চিত্রায়ণের কারণ কী, এ প্রশ্ন অনেকে করতেই পারেন। এ প্রশ্নের পেছনের কারণ এক ভদ্রলোকের আত্মবীক্ষণ। বাংলাদেশে স¤প্রতি গজিয়ে ওঠা ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান নিয়ে বলতে গিয়ে ভদ্রলোক প্রবাসী বাংলাদেশীদের কথা বলছিলেন। আমি বললাম, অবশ্যই বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবি প্রবাসীরা ধর্মীয় লেবাসের পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। কারণ, বিদেশ থেকে শুধু পেট্রো-ডলারই তো পাঠানো হয় না, সাথে খুরমা-খেঁজুর-হিজাব-নেকাবও পাঠানো হয়। কিন্তু উন্নত দেশে পাকাপাকিভাবে বাস করা অভিবাসীরাও ধর্মীয় মৌলবাদ বিস্তারে কম অবদান রাখেন না। সে রোজ-নামচা লিখতেই উপরের কথাগুলোর অবতারণা।

১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরষ্কার পেলেন ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের জন্য। আমরা সবাই জানি, ঈশ্বর ভাবনা এবং বিমূর্ত চিন্তাচেতনার এক কাব্যিক উপস্থাপনা এই ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা, যা নোবেল কমিটি তথা পাশ্চাত্যের পন্ডিতদের ভালো লেগেছিল। তারপরেই যেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যকথায় দিক পরিবর্তন আনলেন। ১৯১৬ সালেই লিখলেন কাব্যগ্রন্থ ‘বলাকা’। রবীন্দ্রনাথের বহুল পঠিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম, যেখানে কবি যৌবনের জয়গান এবং বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগুনোর কথা বললেন। ‘বলাকা’ কাব্যের অন্যতম একটি কবিতা, ‘দূর হতে কী শুনিস মৃত্যুর গর্জন, ওরে দীন’। সেখানে একটি পংক্তি আছে, “ওরে ভাই, কার নিন্দা করো তুমি। মাথা করো নত। এ তোমার, এ আমার পাপ।”

বর্তমানে বাংলাদেশের এ সামাজিক অবক্ষয় এবং ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানের পেছনে কারো অবদান কম নয়। বরং ব্যর্থতার পাল্লা দন্ডিতের দায় ভার নিয়ে সমান্তরাল অক্ষেই ঝুলছে সবার কাঁধে।

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, ওন্টারিও)