বনানী বাবলি : অন্বেষা : হ্যালো সবুজ, কী আশ্চর্য? এতদিন কোথায় ডুব দিয়েছিলে? ঠিক আছো তো?
সবুজ : আছি এইতো … কোথায় তুমি?
অন্বেষা : আমি বাংলাদেশে … কোথায় থাকবো আর? তুমি উধাও দেখি একেবারে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কোথাও দেখি না তোমাকে …না টুইটার না ফেইসবুক।
সবুজ : এতদিন পরে মনে হলো আমাকে? খোঁজ তো নিলে না … বেঁচে আছি কী মরেই গেছি।
অন্বেষা : ইশ ঢং … মেয়েদের মতো আবেগী কথা … আরে বাবা আজ তো করলাম… নিজের ঝামেলায় নিজেই মরছি … বলো … তাড়াতাড়ি বলো কোথায় ছিলে এতদিন?

সবুজ : জেনে আর কী করবে? কী করছো?
অন্বেষা : এইতো তোমার সাথে কথা শেষ করেই যাবো একটু কেনাকাটা করতে, ছোট ভাইবোনদের একটু কক্সবাজার ঘুরিয়ে আনবো ওদের কয়টা ভালো জামা কাপড় দরকার …. আমাকে ছাড়া কোথাও যেতে চায় না এরা।
সবুজ : কত বছর যাই না দেশে …
অন্বেষা : আচ্ছা … ঘুরে যাও একবার বাংলাদেশে।
তবে বোরখা গায়ে সমুদ্র সৈকতের পানিতে নামা মেয়েদেরকে দেখে আবার মূর্ছা যেয়ো না।
সবুজ : এই বাংলাদেশের সাথে আমার পরিচয় নেই।
অন্বেষা : এই শিশু দুইটার ছবি দেখো।
এই শিশুদের শৈশব কেড়ে নিলো কে?

সবুজ: হিজাব দিয়েও তো বাঁচতে পারছে না … ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা পড়ুয়া সাহসী নুসরাত বাঁচতে পারে নাই… তনুর মাথায় হিজাব ছিলো এবং এখন অনেকের মাথাতেই হিজাব বা বোরখা গায়ে তাই বলে ওরা কি নিরাপদ সমাজে? লম্পট আর ধর্মান্ধদের লম্বা হিংস্র হাত প্রথমেই আঘাত করে মেয়েদেরকে অনেক মেয়েরা হিজাব বা বোরখা এই গরমেও বহন করে নেয় সামাজিক চাপে কিংবা ভয়ে …
অন্বেষা : না অনেকে ভাবে এটা ওদের চয়েস। থাক বাদ দাও এসব বলে আর লাভ নেই বরং একটা।
ছবি দেখো সেই সময় আর এই সময়ের আফগানিস্তানের ছবি। আর সামাজিক মিডিয়ার অনেকের ওয়ালেই পাবে মাত্র সত্তর দশকের আর বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের ছবির তুলনা।

সবুজ : হা হা হা এটা যদি চয়েস হতো তাহলে ইরানে হিজাব বোরখার বিরুদ্ধে আন্দোলন হতো না, আন্দোলন করে জেলে যেতে হতো না সেখানে, আফগানিস্তানে বোরখা, হিজাব, নেকাব ছাড়া বের হলে গুলি করে এখন ক্স নয়তো পাথর নিক্ষেপ করে, ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে শরিয়া আইন এবং হিজাব বোরখা না পরলে মেয়েদেরকে শরিয়া পুলিশ পিছু নেয় এবং লাঠি দিয়ে আঘাত করে। এখনো পদ্মার চরসহ আরো অনেক প্রত্যন্ত গ্রাম বা কিছু কিছু পার্বত্য এলাকায় যেয়ে দেখো যেখানে সেই মেয়েদের গায়ে বøাউজ নেই, পাহাড়ি মেয়েদের সংস্কৃতি অনুসারে উর্ধাঙ্গে কাপড় নেই… সেখানে ধর্ষণও নেই … ধর্ষণের পোকা অসুস্থ মাথায় তৈরী হয় অসুস্থ সমাজের লক্ষণ হলো মেয়েদের উপর অন্যায় অত্যাচার …
অন্বেষা : হুমম।

সবুজ : গত ঈদের দিন ছিলো শুক্রবার, সপ্তাহের শেষ দিন। আমার কলিগ জড়মবৎ অফিসে এসেই দেখি মেজাজ খারাপ। জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার? সে বলে, ‘সকাল আটটার সময় দলে দলে সাদা লং ড্রেস গায়ে দিয়ে (জোব্বা) রাস্তা পার হচ্ছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে মসজিদে যাওয়ার জন্য। ওদের কারণে পথে চলন্ত গাড়ি থামাতে হয়েছে। আমি সাত মিনিট লেইট অফিসে, ওদের জন্য।” এখানে সাধারণত রাস্তা পার হওয়ার ক্রস ওয়াক দিয়ে রাস্তা পারাপার করে পথচারীরা। কী ভেবে ওরা এই উন্নত দেশ কানাডা এসেও এই নিয়ম ভঙ্গ করে সে ওরাই জানে।
অন্বেষা : আর এখানে নামাজ পড়ে রাস্তা বন্ধ করে, গাড়ি চলাচল বন্ধ করে।
সবুজ : যার যার উৎসব বা ধর্ম তার তার কিন্তু অন্য মানুষকে বিরক্ত করার মধ্যে তো কোনো ছওয়াব নেই বরং আমার কলিগের মতো অন্য ড্রাইভাররাও মনে মনে গালিই দিয়েছে ওই জোব্বা পড়া বেয়াকুফদের।
অন্বেষা : জানি না দেশ কোন দিকে যাচ্ছে।

সবুজ : আমাদের বাংলার ইতিহাস, আমাদের বাংলার সংস্কৃতি এই হিজাব দিয়ে শুরু হয়নি আর আমাদের আবহাওয়া আরবের মতো নয় যে বালুর ঝড় থেকে রক্ষার জন্য বড়ো বড়ো জোব্বা আর বোরখা হিজাব দিয়ে ঢাকতে হবে। তবে ভুলে যেও না ওরা কিন্তু এখন ‘মিস আরব’ পাঠাচ্ছে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায়?
কী গো? মনে আছে? এই যে দেখো চিরন্তন গ্রামের মেয়ের ছবি ১৯৭৩ সালের এবং এই এক টাকা ১৯৭৯ সালের পরে উঠিয়ে নেয়া হয় মৌলবাদীদের কারণে …কারণ ঐ টাকা পকেটে থাকলে যে নামাজ হয় না?
অন্বেষা : হুমম দেখলাম… দেখলে তো সেইদিন জীবিকার তাগিদে এক গ্রামের মেয়েকে… দুধ বিক্রি করতে বের হতে হয় বাজারে এবং মাথায় হিজাব ছিলো মেয়েটির কিন্তু বাজারে জোব্বা গায়ে দেয়া লোক আক্রমণ করে জনসমক্ষে … অপমান… হেনস্থা করে কিন্তু প্রতিবাদ কোথায়? হিজাব তো এই মেয়েটিকে রক্ষা করতে পারলো না।

সবুজ : হ্যাঁ দেখেছি ভিডিওটা। ঘটনাটা ঘটেছে কুমিল্লার বুড়িরপাড় বাজারে যেটা ছিলো দেবিদ্বার উপজেলাতে। আরে ঐগুলি তো মনুষ্য আকৃতির জীব। টাঙ্গাইলের সখীপুরে গিয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কী কাজটা করলেন? নারী ইউএনও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ খানের মরদেহকে রাষ্ট্রীয় সম্মান গার্ড অফ অনার দেয়ার সময় বাধা দিলেন সবার সামনে তিনি এবং পুরুষ কর্মকর্তা সুপারিশ রাখেন।
অন্বেষা : হ্যাঁ পড়েছি খবরটা।
সবুজ : তাই তো তোমাকে বলছি পোকা তো মাথায় ক্স এই ঘুণ পোকার চাষ হচ্ছে বাংলাদেশে … পুরা সমাজকে শেষ করে দিচ্ছে এবং প্রথম আঘাত মেয়েদের দিকেই আসে …আমরা আছি হিজাব-বোরখা নিয়ে আর দেশের বাইরের উন্নত বিশ্বের মেয়েরা দেখো আজ তারা ঘর পরিষ্কারের কাজে রোবট ব্যবহার করছে … আমি নিজেও কিনেছি একটা ছোট্ট Robovac (vacuum cleaner) আমার দৈনন্দিন দিনকে সহজ করার জন্য আর আমরা বসে আছি এখনো এই সব হিজাব নিয়ে …
মুক্ত হোক সবার মাথার কেশদাম —
আকাশ ছুঁয়ে যাক কুন্তলরাশি ..
অন্বেষা : আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম তোমার কাব্য।

সবুজ : কাব্য নয়… পারলে লিখতাম …পারি না লিখতে তাই শুধু পড়ি… গত কয়েক মাসের মধ্যে বেশ কয়েকটা বই পড়লাম খুশবন্ত সিংয়ের ‘দিল্লী’, সমরেশ বসুর ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’, হুমায়ুন আজাদের ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’ তারপর…
অন্বেষা : আরে থামো থামো এই গল্পগুলিতে গল্পের প্রধান পুরুষ চরিত্রের নারীর প্রতি ভালোবাসার কথা যতো না ফুটে উঠেছে তার চেয়েও এসেছে শারীরিক আনন্দ খুঁজে নেওয়ার কথা … হ্যাঁ ধরে নাও এই বইগুলি কোনো নারী লেখকের… প্রথমেই পাঠকেরা আক্রমণ করবে সেই নারী লেখককে যে এই ধরণের ব্যক্তিগত ঘটনা ঘটেছে বলেই লিখতে পেরেছে এবং বলবে দেহ সর্বস্ব গল্প, বাজারে বই বিক্রির জন্য নিঃসন্দেহে উত্তম বই …। পুরুষের six pack শরীর নিয়ে খোলা মেলা লিখলে পাঠক সহজভাবে মেনে নেয়ার মতো সমাজ কি তৈরী হয়েছে আমাদের?
সবুজ: আরে বাবা থামো থামো।
অন্বেষা : কিন্তু পুরুষ লেখক লিখলে সব ঠিক আছে। নবনীতা দেব সেন একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন এইসব। এই ক্ষেত্রে এমনকি এই নারী লেখকটি তাঁর পরিবার থেকেও কোনো রকম সাপোর্ট পাবে না।
সবুজ : জানো অনু, এই মুহূর্তে মনে হলো আম্রপালীর গল্প। যে অনিন্দ্য সুন্দরী জন্মেছিলেন আজ থেকে সেই ২৫০০ বছর আগে ভারতের বৈশালীতে (বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের মধ্যে) কিন্তু রাষ্ট্র তাঁকে বানিয়েছিলো নগরবধূ অর্থাৎ পতিতা। সেই রাষ্ট্রের সমাজপতিদের আদেশ অনুসারে আম্রপালীকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না এবং সে হবে সবার ভোগের সামগ্রী।
অন্বেষা : কী সুন্দর সমাধান? একমাত্র পুরুষরাই দিতে পারে এতো সুন্দর সমাধান।

সবুজ : আচ্ছা … তোমরা মেয়েরা নিশ্চই খুব খুশি চীফ হিট অফিসার মেয়ে নিয়োগ দেয়াতে এবং মেয়ের যোগ্যতাও আছে … কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নেয়া। পরিবেশ নিয়ে ‘নগর পিতা’ (so called words) চিন্তিত বিধায় নিজের মেয়েকেই এই নিয়োগ দিয়েছেন …

অন্বেষা : কী বলতে চাও?
সবুজ : না মানে বুশরা আফরিন … মেয়েটির বাবা আতিকুল ইসলাম হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত ঢাকা উত্তরের মেয়র যার অধীনে রাতের আঁধারে গাছ কেটে পরিবেশবাদীদের সমালোচনার মুখে এখন এবং মজার কথা হলো সেই মেয়র ও তার কর্মকর্তারা গাছ কাটার স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছে …
অন্বেষা : বুঝলাম তো … ঝেড়ে কাশি দাও …কী বলতে চাও আসল কথা বলো।

সবুজ : আরে এতো ধমক দিলে বলি কী করে? সামাজিক মাধ্যমে দেখি দুই ভাগ হয়ে গেছে এই নিয়োগের ব্যাপারে। কিছু বাঙালি একটা জিনিসই বুঝতে পারে না যে একটা কথা আছে conflict of interest… এখানে উন্নত দেশে হলে কী হতো জানো? মেয়েটি প্রথমেই এই পদ সবিনয়ে ফিরিয়ে দিতো যেহেতু তার বাবা এখানে মেয়র। আর যদি নিয়োগ হওয়ার পরে এই বিতর্কের সৃষ্টি হতো তাহলে সে পদত্যাগ করতো। কারণ এখানে দেশ সেবার চেয়েও ব্যক্তিস্বার্থের সাথে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা বিপুল পরিমানে থেকে যায় এবং সেটার কারণেই এই তত্ত¡টির সৃষ্টি।

অন্বেষা : তোমার ঐ conflict of interest নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই …এইবার যেতে হবে .. ভালো থেকো।
সবুজ : ঠিক আছে, অনু … মাঝে মাঝে হারিয়ে যাওয়ার পর তোমার একটা ফোন কল আমার কাছে বড়ো মধুর লাগে…
টরন্টো, কানাডা
তথ্যসূত্র: কথোপকথন: সবুজ ও অন্বেষা গল্পগ্রন্থ (প্রথম পর্ব) প্রকাশিত হয় ফেব্রæয়ারী, ২০২৩ সালে শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে। সংগ্রহের ঠিকানা: শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা এবং https://www.rokomari.com