ফরিদ আহমেদ : একটা মাত্র কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। সেটাও আবার অসমাপ্ত। এর দুই খণ্ড লিখেছিলেন তিনি। তৃতীয় খণ্ডটা অন্য একজন লিখে এই কাব্যগাথাকে সম্পূর্ণ করেছিলো তাঁর মৃত্যুর বিশ বছর পরে। অথচ এই এক অসমাপ্ত কাব্যগ্রন্থ দিয়ে মধ্যযুগের অন্যতম সেরা কবির স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। যাঁর কথা বলছি, তাঁর নাম কবি দৌলত কাজী। আর যে কাব্যগ্রন্থটা তিনি অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে যান সেটা হচ্ছে ‘লোরচন্দ্রাণী ও সতীময়না’।

দৌলত কাজীর জন্ম চট্টগ্রামের রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে। ১৬০০ কিংবা ১৬০১ সালে। তাঁর জন্মসাল নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। কবি অল্প বয়সেই নানা শাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়ে ওঠেন। গেঁয়ো যোগী যেমন ভিখ পায় না, তিনিও এতো পাণ্ডিত্য নিয়েও এলাকায় পাত্তা পাচ্ছিলেন না। ওই অঞ্চলে তাঁর সমকক্ষ পণ্ডিত কেউ না থাকার পরেও পুরনো পণ্ডিতেরা তাঁর পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত ছিলো। এই জাঁকিয়ে বসা বৃদ্ধদের কারণে প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিপত্তি পাওয়া যাবে না, এটা ভেবে চট্টগ্রাম ছেড়ে আরাকানে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। আরাকানের রোসাং রাজসভায় তখন অসংখ্য কবি সাহিত্যিকদের ভিড়। সেখানে তাঁদের সমাদর করা হয়, পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। এই সংবাদই তরুণ কবিকে মাতৃভ‚মি পরিত্যাগ করে আরকানে আসতে উদ্বুদ্ধ করে।

কথিত আছে, একবার রাজসভার পণ্ডিতদের মধ্যে কোনো একটা বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। অনেকক্ষণ ধরেও তর্কের কোনো মীমাংসা হচ্ছিলো না। শেষে দৌলত কাজী বললেন যে, তর্কের সমাধান তাঁর কাছে রয়েছে। তরুণ কবির এই দাবিকে ভালো চোখে দেখে নাই এখানেও বৃদ্ধ পণ্ডিতেরা। হাতি ঘোড়া গেলো তল, মশা বলে কতো জল, টাইপের কথা বলে তাঁকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এবং উপহাস করতেও ছাড়ে না তাঁরা। শেষে রাজমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে হট্টগোল থামে। তিনি দৌলত কাজীকে তাঁর মত প্রকাশ করার সুযোগ করে দেন। তিনি তখন তর্কের সমাধান করে দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। তারপর তাঁর জন্য সহজ হয়ে যায় রাজসভায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার কাজ।

এর বাইরে আরেকটা গল্প প্রচলিত আছে যে, আরাকান রাজার সমর সচিব আশরাফ খান কাব্যরসিক ছিলেন। তিনি মাঝে মাঝেই সভা করে কাব্য আলোচনা করতেন। এ রকমই এক সভায় হিন্দি কবি সাধনের রচিত ‘সতী ময়না’ শোনার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। দৌলত কাজী তাঁর সেই আশা পূরণ করেন। এই গল্পের সত্যতা থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট। কারণ, তিনি নিজেও এই ‘সতী ময়না’ কাব্যই লিখেছিলেন।

সতী ময়নার কাহিনি সেই সময়কার তুলনায় বেশ খানিকটা জটিল এবং আধুনিকই বলা চলে। অপূর্ব সুন্দরী নবযৌবনা রাজকুমারী ময়নাবতীর সাথে বিয়ে হয়েছিলো রাজকুমার লোরের। বিয়ের পরে তাদের মধুচন্দ্রিমা ছিলো প্রবল আসক্তিময় এবং চরম আনন্দে পরিপূর্ণ। সুখ এবং সম্ভোগে কাটতে থাকে তাদের জীবন। এই সময় তারা পরস্পরের প্রেমে এমনই আসক্ত ছিলো যে তিলেক বিচ্ছেদ হলেই মন আকুল হয়ে উঠতো। কিন্তু, এই সুখ এবং সম্ভোগের আনন্দ একদিন শেষ হয়ে এলো। শুধু ময়নাবতীতে মন আর সন্তুষ্ট হতে পারছিলো না লোরের। হবেই বা কী করে? “যুবক পুরুষ জাতি নিঠুর দুরান্ত, এক পুষ্পে নহে জান মধুকর শান্ত।”

এক পুষ্পে অসন্তুষ্ট লোর তখন অন্য পুষ্প খোঁজার দিকে মন দিয়েছে। মধুকরের মতো পুষ্প থেকে পুষ্পে ঘুরে বেড়াবে সে। সেটা করতে গিয়ে প্রথমেই নট-নটীতে মজে গেলো সে। কুঞ্জবনে চলতে লাগলো সোহাগ-সম্ভোগ। রাজপাট, সংসার সব লোপাট গেলো, লোরের কোনো হুশ থাকলো না। সেগুলোর দায়িত্ব গিয়ে পড়লো বিরহিণী ময়নাবতীর কাঁধে।

ঠিক এই সময়েই অন্য এক রাজ্যের রাজকন্যা ছিলো চন্দ্রাণী। চন্দ্রাণীর বাবা তার সাথে বিয়ে দিয়েছিলো এক ব্রাহ্মণের সাথে। সেই ব্রাহ্মণ বা বামন ছিলো বেজায় এক বীর। এমন এক বীরের সাথে বসবাস আনন্দদায়ক হবার কথা ছিলো চন্দ্রাণীর জন্য। কিন্তু, সেটা হলো না। সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। বীররসে পরিপূর্ণ হলেও বামনের রতিরস ছিলো একেবারেই শুষ্ক। নপুংসক স্বামী পেয়ে চন্দ্রাণীর মানসিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়লো। বেশ অনেকবার চেষ্টা করেও স্বামীর রতিরস জাগাতে ব্যর্থ হয়ে তাকে পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলো।

এক পুষ্প তার মধুভাণ্ডার নিয়ে বসে আছে দানের প্রতীক্ষায়, আর অন্যদিকে এক মধুকর লোর বসে আছে সবকিছু লোপাট করে নিয়ে যাবার নেশায়। এই দুজনের মিলিত হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেখা হতে লাগলো গোপনে গোপনে তাদের। এই গোপন নেশাতেও মন মজে না তাদের। শেষে একদিন চন্দ্রাণীকে নিয়ে পালিয়ে গেলো লোর।

লোরের পলায়নের পরে ময়নাবতীর দিন কাটে শোকে এবং দুঃখে। নিঃসঙ্গ এক একাকী জীবন প্রতীক্ষা কেটে যেতে থাকে লোরে জন্য।
কবি দৌলত কাজী এই কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন ১৬২২ সাল থেকে ১৬৩৮ সালের মধ্যে। ১৬৩৮ সালে তিনি যখন মারা যান, তখন এটা অসমাপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। দুই খণ্ড লিখেছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর বিশ বছর পরে মহাপণ্ডিত কবি আলাওল সেটা সমাপ্ত করেন তৃতীয় খণ্ড লেখার মাধ্যমে।

এক কাব্যগন্থ দুইজনে লিখলে যা হয়, তাই ঘটেছিলো এখানেও। প্রথম দুই খণ্ডের সঙ্গে খাপ খায়নি এর তৃতীয় খণ্ড। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে এই লেখার মাধ্যমে দুজনের কবিত্ব শক্তির একটা তুলনা এসে গিয়েছিলো। আলাওলকে ধরা হয় মধ্য যুগের শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে। মুহাম্মদ এনামুল হক এবং আবদুল করিম সাহিত্য-বিশারদ দৌলত কাজীকে আলাওলের সমকক্ষ কিংবা তাঁর চেয়েও শক্তিশালী কবি হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। তাঁরা লিখেছেন,
“কোথাও কোথাও দৃষ্ট হয়, কবি দৌলত কাজী আলাওলের প্রায় সমকক্ষ কবি। আমাদের মনে হয়, একটিমাত্র অসমাপ্ত কাব্যে কবি দৌলত যে কবিত্ব সুধা-ধারা বহাইয়া দিয়াছেন ও অমর প্রতিভার নিদর্শন রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা আলাওলের রাশীকৃতি অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যেও পাওয়া যায় না। আলাওল কবিত্বের দিক দিয়া দৌলত কাজী হইতে নিঃসন্দেহভাবে নিকৃষ্ট। স্বয়ং কবি আলাওল “সতী ময়নার” পরিসমাপ্তিতে এ কথা স্বীকার করিয়াছেন। যিনি “সতী ময়নার” দুই কবি লিখিত অংশ দুইটি একটু নিবিষ্টভাবে পাঠ করিবেন, তিনি পরের মুখে ঝাল না খাইয়া, পরিষ্কাররূপে দেখিতে পাইবেন, দুই কবির রচনায় কতখানি পার্থক্য বিদ্যমান।”

কবি দৌলত কাজী আলাওলের চেয়েও বড় কবি ছিলেন, কী ছিলেন না, এই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় মধ্যযুগের অন্যতম সেরা এবং শক্তিশালী কবি ছিলেন তিনি। আমাদের দুর্ভাগ্য অতি অল্প বয়সে এই কবির অকাল মৃত্যু ঘটেছিলো। সেটা না হলে, নিঃসন্দেহে তাঁর হাত দিয়ে ‘সতী ময়নার’ মতো আরো অনেক মুক্তো মাণিক্য বের হয়ে আসতো।