সাহিদুল আলম টুকু : আমি যতবার কলকাতা গিয়েছি সুশীলদা (কবি প্রাবন্ধিক সম্পাদক সুশীল সাহা) এমন সব অসামান্য মানুষের কাছে আমাকে নিয়ে গেছেন, পরিচয় করে দিয়েছেন যা আমার মত সামান্য মানুষের পরম পাওয়া।

তাদের সান্নিধ্য, তাঁদের সাথে কথা বলা, আড্ডা দেয়া আমার জীবনে মূল্যবান স্মৃতি।
তাঁদের মধ্য ছিলেন শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর কবিতার সাথে পূর্বেই পরিচয় হয়েছিল কামাল ভাইয়ের (কবি আবৃত্তিকার মোহাম্মদ কামাল) কন্ঠে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কবিতা “বাবরের প্রার্থনা” শোনার মধ্য দিয়ে-
“এই তো জানু পেতে বসেছি পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত
ধ্বংশ করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।”
(প্রথম স্তবক)

কিন্তু কবি শঙ্খ ঘোষের সাথে প্রথম দেখা হয়, পরিচয় হয় ২০১৪ সালের ২৩শে ডিসেম্বর। সুশীলদা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সল্ট লেকের বাড়িতে। আমাদের সাথে সুশীলদার মেয়ে রাকাও ছিল। আমরা বসার ঘরে বসার একটু পর কবি আসেলেন। ধবধবে শাদা পাঞ্জাবী আর ধুতি পরিহিত। চোখে চশমা। আমরা দাঁড়ালাম। কবি স্মিত হেসে হাতের ইশারায় আমাদের বসতে বললেন।

আমরা বসলাম। আমি কবি’র দিকে তাঁকিয়ে আছি মুগ্ধ হয়ে। সুশীলদা পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সম্পর্কে ছোট একটা ভূমিকা দিয়ে। কবি স্মিত হাসছেন আর শুনছেন। আমি সনৎ সারের (শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সনৎকুমার সাহা) ছাত্র শুনে একটু প্রশ্রয় দিলেন চোখের কোণে। আমাদের আপ্যায়ন করলেন খুব আন্তরিকতার সঙ্গে। কবিতা পাঠ করে শোনালেন। তাঁর একটি কবিতা গ্রন্থে আমার জন্য স্বাক্ষর (অটোগ্রাফ) দিলেন। রাকা গান করলো। রবীন্দ্র সঙ্গীত। কি যে সুন্দর একটা বিকেল কেটেছিল সেদিন – বড় আনন্দে। কবির স্মিত হাসিতে রসে ভরপুর তাঁর কথামালায় কি যে মুগ্ধ হয়েছিলাম তা শুধু আমার হৃদয়ই জানে।
প্রণাম করে ফেরার সময় কবি দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন – আমরা নীচে না নামা পর্যন্ত। আমি সেবার কলকাতা থেকে ফিরে একটা কবিতা লিখেছিলাম ‘কলকাতা’ শিরোনামে। সেখানে দুটি লাইন আছে

“আমার কাছে কলকাতা মানে
শঙ্খ ঘোষের শঙ্খ ধ্বনির কবিতা শোনা”

সুশীলদার কাছে থেকে প্রতিনিয়তই তাঁর খবর জানতাম। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৭শে ফেব্রæয়ারি সল্ট লেকের সেই বাড়িতে কবি’র সাথে দেখা প্রাক দুপুরের কোন এক সময়ে।
সুশীলদা আর আমি পৌঁছে জানতে পারলাম কবি খুব অসুস্থ্য। দেখা করা মানে তাঁকে যদি কষ্ট দেয়া – এই ভেবে আমরা ফিরে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা এসেছি জেনে কবি আমাদেরকে একটু বসতে বললেন। তারপর তাঁর শোবার ঘরে আমাদের ডাকলেন। উনি কষ্ট করে বিছানায় বসলেন। তেমন কোন কথা বলতে পারলেন না। শুধু দর্শন করে প্রণাম করে বিদায় নিয়ে ফিরে আসলাম সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম মহীরুহ কবি শঙ্খ ঘোষের কাছ থেকে।

আর তিনি আমাদের সকলের কাছ থেকে চির বিদায় নিলেন ২০২১ সালের ২১শে এপ্রিলে। তাঁর মৃত্যুর খবর জানার পর তাঁকে দেখা শেষবারের ছবিই আমার হৃদয়ে ফুটে উঠল। মর্মে বেদনা অনুভব করলাম।

বাংলা ভাষা সাহিত্যে তাঁর অমৃত কবিতায় তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন। অতল শ্রদ্ধা ও প্রণাম কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর অবিনস্বর আত্মার অসীম শান্তি কামনা করি।