মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

একাশি…
২০১২ – ১৩ সালের নেতৃত্বের প্রচারণার অধিকাংশই হয়েছে কানাডার কনকনে শীতের সময়। ঐ সময়ের অধিকাংশই আমি কাটিয়েছিলাম কানাডার পশ্চিম দিকে। সেই সময়ের অনেক মনে রাখার মত স্মৃতি আমার মানসপটে গেঁথে আছে। তবে কাম্পলুপ্স এর এক শীতার্ত সন্ধ্যার ঘটনা আমার অন্য সব স্মৃতিকে বারে বারে ছাপিয়ে যায়। সেই দিনগুলোর মতই সেটা ছিল এক দিন যখন সূর্য উঠার পর খুব তাড়াতাড়িই সেটা অস্ত গিয়েছিল। আমরা এত দূরে ছিলাম যে সে এলাকায় লিবারেল এর নাম গন্ধ তেমন ছিল না। ওকানাগান এ সারাদিন প্রচারণা চালাবার পর আমরা প্রচারণার ভলিন্টিয়ার্সদের সাথে একটা মিনিভ্যানে করে অসোইয়ুস এবং কেলোওয়ানা হয়ে উত্তর দিকে কোকুইহাল্লার দিকে যাচ্ছিলাম। আমরা থম্পসন রিভার্স ইউনিভার্সিটি’তে একটা ছোট রুম ভাড়া নিয়েছিলাম, আমাদের পরিকল্পনায় ছিল এলাকার অল্প কয়েকজন কিন্তু নিবেদিত প্রাণ লিবারেল কর্মীদের সাথে আলাপ করবো। আমরা সেই জায়গায় উপস্থিত হবার মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমার এই প্রচারণায় যিনি আমাদের সাথে সব সময় আছেন, সেই গ্যারি ব্যাটস এর কাছে একটা ফোন এলো। ফোনটা এসেছে সেখানকার আয়োজনের দায়িত্ব যার ছিল, তাঁর কাছ থেকে। তিনি জানালেন, একটা সমস্যায় পড়েছেন তিনি। এই সমস্যায় তিনি কিছুটা হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি গ্যারিকে বললেন, তাদের প্রত্যাশার চেয়ে পাঁচ শ জন বেশী উপস্থিত হয়ে গেছে, এখন একটা বড় জায়গা না নেবার কোন বিকল্প নেই।

সেই মানুষগুলোর অনেকেই এসেছিল লিবারেল পার্টি সম্পর্কে জানতে, আর অন্যরা এসেছিল নিজেদের অপ্রাপ্তি থেকে। যাদের মধ্যে ঔৎসুক্য ছিল, তারা লিবারেল পার্টি সম্পর্কে খুব ভালো কিছু জানতো না, আর তারা যেটা জানতো সেটা লিবারেল পার্টি সম্পর্কে সঠিক কিছু নয়। আমি তাদের সাথে প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে এই পার্টি এবং এর পরিকল্পনা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা দিয়েছিলাম, যেটা আমি সব সময় আমার প্রচারণায় করে থাকি। এদের মধ্যে একজন ছাত্র আমাকে প্রশ্ন করেছিল,‘রাজনীতি কিভাবে করতে হবে সেটা আমি আমার বাবার জীবন থেকে কেমন শিখেছি’। আমি শুধু বলেছিলাম,‘যখন আমি স্যালমন আর্ম (ব্রিটিশ কলম্বিয়ার একটা ছোট শহর)এ, তখন আমি আমার পাঁচ আঙ্গুল নাড়িয়ে সবাইকে আপন করতে চাই।’ আমার প্রচারণায় অনেক সময়ই আমার নিরস কৌতুকের মাধ্যমে সবাইকে আমার আসল কথাটা বুঝাতে ব্যর্থ হই, কিন্তু এটা বলার পর লক্ষ্য করলাম সবাই আনন্দ আর হাসিতে উচ্ছ¡সিত হয়ে পড়লো।

আমার সু² পর্যালোচনায় আমি অনুধাবন করতে পারলাম, সেই জমায়েত হওয়া মানুষগুলোর অনেকেই এসেছে তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে। তারা যে দলকে পছন্দ করে তাদের প্রতিনিধিদের অটোয়ায় পাঠিয়েছিল, তারা তাদের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য কিছুই করে নি এবং সেই পার্টিও তাদের চিন্তা ভাবনা বা প্রত্যশাকে কোন মূল্য দেয় নি। কনজারভেটিভ পার্টি বার বারই উচ্চারণ করে, তাদের এই সাফল্যের জন্য তারা প্রধানত ঋণী তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে, কিন্তু হার্পার মূলত এই তৃণমূল পর্যায়ের মানুষদের ব্যবহার করেছে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদ পরিষ্কার করার জন্য। এটা সত্য, গত কয়েক দশকে কোন সরকারই এই মানুষদের নিয়ে ভাবেন নি, এবং এমপি’দের তেমন কোন ক্ষমতায়ন হতে দেয় নি, এবং এই আধুনিক যুগে সংসদীয় গণতন্ত্রকে সফল হতে দেয় নি। বলা হয়, বর্তমান সরকার ব্যস্ত নতুন নতুন বক্তব্য দেয়া আর পার্টির শৃংখলাকে আরও মজবুত করায়। আমি জানি, এই মানুষগুলো এগুলো শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমি এগুলো আমার প্রচারণা চালাতে গিয়ে বার বার শুনেছি। সব শেষে আমি সেই একই কথা বলেছিলাম, যা কানাডার পশ্চিম দিকের প্রচারণায় আমি সব সময়ই উল্লেখ করতাম,‘আপনার অটোয়ায় আপনাদের প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য ভালো মানুষকে নির্বাচিত করুন। আপনারা কখনই শুধু স্টিফেন হার্পারের কথা আপনাদের কমিউনিটিতে বাজতে দিয়েন না।’
আমার এই কথাটা বলার পর, আমি কখনই এক সাথে এত মানুষকে মাথা নেড়ে আমাকে সমর্থন করতে দেখিনি।

কানাডার মানুষ সব সময় জানতে চায়, সত্যি সত্যিই কি তাদের ভোটের মূল্য আছে! ‘পার্লামেন্ট কিভাবে কাজ করে’– এ বিষয়টা বলার জন্য সেই রাতে সবাইকে উপস্থিত হওয়ার আয়োজন করা হয় নি। আসলে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তারা যাদেরকে নির্বাচিত করে পার্লামেন্ট এ পাঠান তাঁরা কিভাবে তাদের প্রত্যাশাকে পার্লামেন্ট এ উপস্থাপিত করে। অথবা যারা নির্বাচিত হন, তাঁরা কিভাবে তাঁদের এলাকার মানুষের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়ে সেই মত কাজ করে এবং তাদের প্রয়োজনকে মিটানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

জনগণ এখন বুঝতে পারে বিগত সময়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে প্রত্যাশিত বিষয়গুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তারা জানে যখন তাদের এমপি কথা বলেন, সেটার মধ্যে তাঁদের এক ব্যর্থতার চিহ্ন দেখা যায়, তাঁরা সত্যিকারভাবে বা বলিষ্ঠভাবে কিছু বলতে পারে না, অথচ এমন কিছু বলার কথা ছিল তাঁদের। মিস্টার হার্পারের একগুঁয়েমির ফলে তাঁর ককাস থেকে শুরু করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সেই সব প্রতিনিধিরা এখন আর তেমন কিছুই করতে পারেন না। আমি মনে করি, নেতা নির্বাচনে এটা একটা মারাত্মক ভুল, আর সেই কারণেই আমার কিছু বিশেষ পরিকল্পনা আছে, যা এই সমস্যার সমাধান করার জন্য কার্যকরী ভ‚মিকা পালন করবে।

কাম্পলুপ্স এর এক আদিবাসী নেতা জাস্টিন ট্রুডোকে বরণ করে নিচ্ছেন

অবশ্যই এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। জনগণের জানা প্রয়োজন যখন তারা লিবারেল পার্টিকে ভোট দিবে, তখন তারা লিবারেল পার্টির মূল্যবোধ এবং এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলিকে তারা সমর্থন করছে। যদিও পার্টির শৃঙ্খলা এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় সীমিত সংখ্যক ভোটারের কাছে থাকা প্রয়োজন, বিশেষ করে ভালোভাবে দেখা উচিৎ কোন কিছু কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডমস এর সাথে সাংঘর্ষিক হচ্ছে কিনা, অথবা বাজেট প্রণয়ন ও অন্যান্য কিছু বিষয় মানুষের জন্য ইতিবাচক হচ্ছে কিনা।

আর এর জন্য দরকার যে সব বড় বড় বিষয়গুলো সত্যিই আমাদের জীবনে গুরুত্ব বহন করে, সেগুলোর প্রতি আমাদের অবিচল, চিন্তাশীল এবং আবেগপ্রবণ থাকা থাকা উচিৎ। অনেক সময় সমঝোতার ইচ্ছাপ্রকাশ মানুষের জীবনের একটা বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষ করে রাজনীতির ক্ষেত্রে কেউ যদি নিজের পার্টির মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে এই সমঝোতা করে, তবে সেটা দীর্ঘমেয়াদী এক সফলতা বয়ে আনে। আমি আমার নেতৃত্বের প্রচারণার সময় প্রায় পার্টির অন্যদের সাথে তর্ক করতাম, কানাডার অধিকাংশ মানুষ জানে না, কিসের উপর লিবারেল পার্টি দাঁড়িয়ে আছে, এমনকি লিবারেল পার্টি আসলেই কী করতে চায়। আমি তাঁদেরকে প্রায় বলতাম, এর জন্য যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে, লিবারেল পার্টির মূল মূল্যবোধকে সব সময় সবার সামনে তুলে ধরা উচিৎ এবং সেই মত আমাদের সামনে এগিয়ে চলা। এর ফলে যদি, আমাদের সামনে কোন অসফলতা আসে, এমনকি আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হই, তারপরও আমাদের সেই মত সামনের পথে এগিয়ে চলা উচিৎ।