নাদিরা তাবাসসুম : শীতকালের মধ্য রাত্রি। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। রাস্তাঘাটে লোক চলাচল সীমিত। এত রাতে দুজন মানুষ হারিস এবং রিপন ফ্যাক্টরির কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছে। একসাথে কাজ এবং কাজ শেষে বাসায় ফেরা দুজনের মাঝে একটা বন্ধুত্ব সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে। সাবওয়ে ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে দুজনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে।

হারিস- আজ মনে হচ্ছে বাসায় ফিরতে অনেক দেরী হবে। সবাই ঘুমিয়ে থাকবে। কি আর করা চলো ওই বেঞ্চটাতে গিয়ে বসি।
রিপন- একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে এভাবে মধ্যরাত অবধি আমরা যে পরিশ্রম করে যাচ্ছি কিসের জন্য বলো? নিশ্চয়ই অর্থ উপার্জনের জন্য। স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটু ভালোভাবে সংসারটা চালিয়ে নেয়ার জন্য। অথচ দেখো কিছু মানুষের অর্থ, বিত্ত ও সম্পদ অঢেল পরিমাণে থাকা সত্তে¡ও যে হতাশা নিরাশায় আত্মহত্যা করতে পারে এ আমার জানা ছিল না। সেদিন দেশ থেকে ফোনে আলাপকালে আমার এক আত্মীয়া জানালো যে তাদের এক প্রতিবেশী ধনাঢ্য মধ্যবয়সী ব্যবসায়ী পারিবারিক সমস্যা এবং ব্যবসায়ে প্রতারিত হয়ে হতাশাগ্রস্থ অবস্থায় আত্মহত্যা করেছেন। বিশাল এক বাসায় একাই থাকতেন। কারন পরিবার দেশের বাইরে থাকতো।

হারিস- হ্যাঁ আমিও শুনেছি। এরকম কত যে দুর্ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে, কিছু জানাজানি হয় আবার অনেক ঘটনা অজানাই থেকে যায়। উচ্চশিক্ষিত ধনী পরিবারের মেয়েরাও বিভিন্ন পারিবারিক কলহের কারনে আত্মহত্যা করছে অথবা স্বামী কর্তৃক খুন হচ্ছে – এধরনের বেশ কিছু ঘটনা ঐ আত্মীয়া বলেছে।

রিপন- আমার পরিচিত একজন খালাম্মা আছেন । ওনার মেয়েটার এক উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছিল। কয়েক মাস যেতে না যেতেই নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া ও সংঘাত শুরু হয়। মেয়েটি অনেক সহ্য করে থাকে এবং আত্মীয়স্বজনদের দিয়ে বিভিন্ন উপায়ে কাউন্সেলিং করে। ইতোমধ্যে তিন তিনটে মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু ছেলেটির উগ্র মেজাজ এবং নৃশংস আচরণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। চাকরী শেষে ঘরে ফিরে স্ত্রীর কোন কাজে সাহায্য তো করত না বরং ছোট ছোট বিষয় নিয়ে চীৎকার চেঁচামেচি ও গালমন্দ করতো। তিনটি বাচ্চা কেন মেয়ে হয়ে জন্মালো এ নিয়ে স্ত্রীকে দোষারোপ করত। বাচ্চাগুলো ভয়ে কান্নাকাটি করলে তাদেরকেও মারধোর শুরু করত। অবশেষে আত্মীয়স্বজনদের মীমাংসা এবং আইনী সহায়তা নিয়ে মেয়েটি বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা হয়ে যায়।

হারিস- আমি এক ভাইকে চিনি তিনি তার স্ত্রীর অধিক সন্দেহপরায়ণতা এবং প্রতারণার দায় কাঁধে নিয়ে আলাদা বসবাস করছে। ছেলে মেয়ে তার স্ত্রীর সাথে থাকে। তিনি পনেরো বিশ বছর ধরে সংসার করেও স্ত্রীর বিশ্বাস এবং ভালোবাসা অর্জন করতে পারেননি। ভদ্রলোকের একটা বদ অভ্যাস ছিলো কোথাও কোন মহিলার সাথে পরিচয় হলেই তার সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কে জড়িয়ে যেতেন যা স্ত্রী কেন পরিবার ও সমাজের সকলের কাছে নিন্দনীয়।

রিপন- আমার খুব অবাক লাগে। বর্তমানে এ কেমন যুগে এসে পৌঁছালাম যখন সর্বত্রই শুধু উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশ্বাসহীনতা এবং প্রতারণার ফাঁদে আটকে গিয়ে সহজ সরল মানুষের নিত্য আহাজারি চলছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে উঠে এ কেমন অসভ্য ও বর্বরতার নজির দেখছে বিশ্ব। আবেগ, অনুভূতি, দয়া, মায়া ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। সকল সম্পর্কগুলো শিথিল থেকে শিথিলিতর হয়ে যাচ্ছে প্রবল সবার্থন্ধতার কাছে। নৈতিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় আদর্শের লালন করাকে আমরা সেকেলে বলে সরিয়ে দিয়ে প্রকৃত সত্য থেকে নিজেরাই দূরে সরে যাচ্ছি। প্রযুক্তির চোখ ধাঁধানো উৎকর্ষ মানুষকে ধীরে ধীরে দুর্বল ও তাতে নির্ভরশীল করে তুলছে।

হারিস- আমরা সত্যই মনে হয় শেষ যুগে বাস করছি। মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতি ও পরিবেশের অবস্থাও আশংকাজনভাবে অশান্ত ও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী ভাইরাস মহামারী প্রকোপ-এর সাথে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ভূমিকম্প, টর্ণেডো, বন্যা, অগ্ন্যূৎপাত, যুদ্ধ- বিগ্রহের তান্ডব চলছে।

রিপন- আমাদের মা-বাবারা এজন্যে সব সময় যে কথা বলতেন সেটা হলো ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি নীতিজ্ঞান এবং ধর্মীয় আদর্শের শিক্ষা দিয়ে বড় করে তোলা উচিত। ওনারা সেভাবে চেষ্টাও করতেন। কিন্তু বর্তমান আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় নিমগ্ন আজকাল আমরা কিছু অভিভাবকেরা সেদিকটা চিন্তা করছি না আবার অনেকে আমরা দুদিকেই মনযোগ দিতে গিয়ে তাদেরকে দ্বিধান্বিত করে ফেলছি।
হারিস – ঠিক বলেছো। ইংরেজী ‘Religion’ শব্দটা এসেছে দুটো ল্যাটিন শব্দ ‘জব’ (again) আর ‘lig’ (join or connect) অর্থাৎ মানব জগতের সাথে পবিত্র জগতের সংযোগ। ধর্ম হলো ‘way of life’ বা জীবন বিধান যা জীবনের প্রতিটি স্তরে নীতি ও সুশৃঙ্খলভাবে নিজেকে পরিচালনা করতে শেখায়। পণ্ডিতদের মতে, ধর্ম এমন বিশ্বাস পদ্ধতি যা আল্লাহর উপাসনা, আচার অনুষ্ঠান এবং নৈতিক বিধিবিধান-এর সাথে সংশ্লিষ্ট। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যতই উন্নতি ঘটছে ততই মানুষের কাছে আল্লাহতায়ালার অস্তিত্ব সুস্পষ্ট হতে চলেছে। বর্তমান যুগে অনেক ফিজিসিষ্ট এবং এস্ট্রোফিজিসিষ্টদের মতো এস্ট্রোফিজিসিষ্ট ডক্টর হুগ রস বলেছেন science continues reveal God, God reavealed in both Scripture and Nature” বিখ্যাত আমেরিকান পদার্থবিদ মিচিও কাকু ‘স্ট্রিং থিওরি ‘‘থিওরি অফ এভরিথিং’ কে বলেছেন ‘গড একুয়েশন’। বিখ্যাত পদার্থবিদ আলবার্ট আইন্সটাইন-এর মতে “Science without Religion is lame, Religion without Science is blind“ সুতরাং মানুষের সুশৃংখল্ভাবে বেঁচে থাকার জন্য দুটোরই প্রয়োজন রয়েছে।

আর ‘সকল মানুষ একই দল্ভূক্ত ছিল, তারপর আল্লাহ নবীদেরকে প্রেরণ করলেন সুসংবাদতা ও সতর্ককারীরূপে, আর সাথে সত্য কিতাবও দিলেন, যেন মতভেদযুক্ত বিষয়গুলোর মীমাংসা করতে পারেন। বস্তুত কিতাবের ব্যাপারে অন্য কেউ মতবিরোধ করেনি স্পষ্ট নিদর্শন আসার পর। শুধুমাত্র কিতাবধারীরা নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষ্বশতঃ এটাতে মতভেদ করেছিল, আল্লাহ মুমিন্দেরকে স্বীয় ইচ্ছায় মতভেদযুক্ত বিষয়ে সত্যের সন্ধান দিয়েছেন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পরিচালিত করেন সরল পথে’ (সূরা বাকারাঃ আয়াত ২১৩)। সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম ধর্ম হলো মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার মনোনীত ধর্ম। এ প্রসঙ্গে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরাআনে তিনি বলেন ‘আর এরই অসিয়ত করেছে ইব্রাহীম ও ইয়াকুব তার পুত্রদেরকে ,”হে সন্তানেরা ! আল্লাহ তোমাদের দ্বীন মনোনীত করেছেন। অতএব তোমরা মরোনা, মুসলমান না হয়ে” (সূরা বাকারাঃ আয়াত ১৩২) এবং সূরা আল-ইমরান আয়াত ৮৫-তে তিনি আরও বলেন ‘আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য দ্বীন অন্বেষণ করে তা কখনও কবুল করা হবে না, আর সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হবে‘।

রিপন- নৈতিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলার বিষয়ে আমার স্ত্রী অত্যন্ত সচেতন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে খুব চিন্তা করে। আমিও এবিষয়ে সহযোগিতা করি বাকী আল্লাহ ভরসা। কারন ভবিষ্যৎ একমাত্র আল্লাহ জানেন।
হারিস- তোমার ভাবীও ঠিক তাই। সেভাবে ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঐ যে দেখো ট্রেনটা কেমন ধীর গতিতে আসছে। চলো গিয়ে বসি [দুজনে ট্রেনে উঠে সীট নিয়ে বসে] তবে রিপন, তোমার ভাবী যে কথাটা বিশ্বাস করে তা হলো – বর্তমানে আমরা হয়তো সঠিক পদ্ধতিতে ছেলেমেয়ে বড় করার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছি কিন্তু ভবিষ্যৎ একেবারেই অনিশ্চিত বিধায় কার জীবনে কি ঘটবে বা জীবন কিভাবে অতিবাহিত হবে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন। আমরা বর্তমানে শুধু পরিশ্রম করে যেতে পারি। কারণ ‘কষ্টের মাঝেই আছে স্বস্তি‘।