মনজুর মাহমুদ : স্কারবোরোর ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েক বন্ধু একটি ব্রিজের নিচে কোনো এক ব্যক্তিকে দেখে থামলো। কথা বলার এক পর্যায়ে সে জানায়, ভারতে পরিবারের সাথে তার একটু ফোনে কথা বলা দরকার। বন্ধুরা রাজি হয়ে তাকে বাসায় পৌঁছে দিতে চাইলে সে বলে, থাকার মতো কোনো জায়গা তার নেই, চারদিন ধরে এই ব্রিজের নিচেই আছে। বন্ধুরা তাকে স্যালভেশন আর্মির এক আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে গেলে কিছুদিন থাকার ব্যবস্থা হয়। সেখানে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে জানায়, কিচেনার শহরের কনটেসা কলেজের ছাত্র সে।

তীব্র আবাসন সংকটে আর্থিক সামর্থ্যের অনেক বেশি ব্যয় করেও একটু মাথা গোঁজার জায়গা না পাওয়া কিংবা এভাবে ব্রিজের নীচে বা খোলা জায়গায় তাবু পেতে দিন কাটানো, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে বিক্ষোভ এবং ছাত্র-ছাত্রী ও কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি অবস্থান, শহর জুড়ে অসংখ্য গৃহহীন মানুষের অসংলগ্ন আচরণ – খন্ড খন্ড এসব চিত্র মানুষকে যেন নতুন এক কানাডার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে!

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ফুড ব্যাংকে মানুষের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশের বড় বড় গ্রোসারি স্টোরগুলোর কর্তৃপক্ষের সাথে প্রধানমন্ত্রীসহ প্রভাবশালী মন্ত্রীদের একের পর এক বৈঠক — পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অভিবাসী হতে ইচ্ছুক লক্ষ কোটি মানুষের কাছে স্বপ্নের দেশ কানাডাতে কেমন যেন বেমানান সব ঘটনা! জরিপ বলছে, জীবন যাপনের ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতিতে কানাডার ৫৩ শতাংশ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখন অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছে। বেসরকারি একটি সংস্থার হিসাব মতে, মর্টগেজের সুদ ও অন্যান্য খরচ বেড়ে যাবার কারণে গত এক বছরে টরেন্টোতে কোনো কোনো বাড়ির মালিকের মাসিক ব্যয় ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। আর বাড়ির দাম বেশি হওয়ার পাশাপাশি রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসনের কারণে একই সময়ে ভাড়া বেড়েছে ২২ শতাংশ।

এদিকে, সরকারি সংস্থা পরিসংখ্যান কানাডার হিসাবে, গত এক বছরে শুধুমাত্র গ্রোসারি খরচ বেড়েছে ৯ শতাংশের বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু জিনিসের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। টিকে থাকতে যথেষ্ট আয় করতে না পেরে কর্মজীবী মানুষের অনেককেই দ্বারস্থ হতে হচ্ছে ফুড ব্যাংকের।

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একটি ফুড ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এড্রিয়ান বেইন জানান, “খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এ বছর আমাদের গ্রাহক সংখ্যা ৭০ শতাংশ বেড়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদেরকে একটা বড় ধরণের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।” নিউ মার্কেট ফুড প্যান্ট্রির এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, পরিস্থিতিতে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, পেশাজীবী মানুষরাও এখন ফুড ব্যাংকের খাবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সামর্থ্যের বেশি বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে নতুন অভিবাসী, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা ছাড়াও কর্মরত অনেক মানুষ এখন ফুড ব্যাংকের খাবারের ওপর নির্ভরশীল।

টরেন্টো ডাউন টাউনের বাসিন্দা স্যু এলেন আগে কখনো ফুড ব্যাংকে না গেলেও খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রতি সপ্তাহে সেখান থেকে কিছু কিছু খাবার সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি বলেন, “আয় তেমন না বাড়লেও খরচ তো দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন মাঝে মধ্যেই সপ্তাহের কোনো কোনো দিন আমরা রাতের খাবার খাই না।”

নায়াগ্রা অঞ্চলের স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান ফার্মওয়ার্কার হাব প্রতি বছর মৌসুমী শ্রমিকদের মাঝে কাপড়, খাবার এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিনামূল্যে বিতরণ করে আসছে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান জুলিয়া বাক্সটন-কক্স বলেন, দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। আর এ কারণে অনেক বেশি শ্রমিক এ বছর সাহায্যের জন্য আসছে। গত বছরের চেয়ে তাদের সংখ্যা ২৭ শতাংশ বেশি।

তিনি বলেন, “খাদ্য উৎপাদনে এসব শ্রমিক অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু নূন্যতম মজুরিতে এখন আর টিকে থাকা যাচ্ছে না। পরিতাপের বিষয়, তারাই আজ ক্ষুধার্ত যারা আমাদের খাদ্যের যোগান দিতে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে।”

বেঁচে থাকতে ন্যূনতম মজুরি যথেষ্ট নয়। পূর্ণকালীন কাজের পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ বা বাড়তি রোজগারের জন্য কিছু একটা করা এতদিনে অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে। তবে চলমান পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যাংক বা ব্যক্তিগত ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা এবং খেলাপি হওয়ার প্রবণতা সাধারণ মানুষের জীবনে নতুন এক মাত্রা যোগ করছে।

ওয়েলকাম টু কানাডা। এদেশে কেউ এসে পৌঁছলে তাকে ‘কানাডাতে তোমাকে স্বাগতম’ বলার রেওয়াজ আছে। শাব্দিক অর্থ যাই হোক না কেনো এদেশে উন্নত, নিরাপদ জীবনের আশায় সদ্য পৌঁছানো মানুষকে বরণ করে নেয়া বা উৎসাহ দেয়াটাই এর মূল বার্তা। বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতির উত্থান-পতন বোঝাতে সময়ের মাপকাঠিতে চক্রাকারে এর গতি প্রকৃতির (বিজনেস সাইকেল) উদাহরণ দিয়ে থাকেন। অর্থ যাই হোক না ‘ওয়েলকাম টু কানাডা’র মূল বার্তাও কি উল্টে গিয়ে সময়ের ব্যবধানে অর্থনীতির এই বিশেষ উদাহরণের মধ্যে পড়বে?