ডঃ বাহারুল হক : গত ২৫ ডিসেম্বর আমি আর আমার স্ত্রী ঘর থেকে বের হলাম অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে। টরন্টো এয়ারপোর্ট থেকে বিমান ছাড়বে দুপুর ২টা ১০ মিনিটে। আমরা তার ৩ ঘন্টা আগেই পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টে। গিয়ে তো অবাক। এয়ারপোর্টের ডিপার্চার উইং লোকে লোকারণ্য। যেমন যাত্রী তেমনই লাগেজের ছড়াছড়ি। কি ব্যাপার? বুঝলাম- খুবই স্বাভাবিক। চরম প্রতিকুল আবহাওয়ার জন্য আগের দিন সব ফ্লাইট ক্যান্সেল হওয়াতে আজ এয়ারপোর্টের এই হাল। আমরা চেক-ইন, সিকিউরিটি চেকিং হয়ে বোডিং-এর জন্য গেটে বসে আছি। কিন্তু বোর্ডিং-এর জন্য ডাক পড়ছে না। ডিলে। ২টায় জানালো ৩টায় ছাড়বে। ২টা ৪০ মিনিটে বললো ৪টায় ছাড়বে। খোঁজ নিয়ে জানলাম ২৪ ডিসেম্বরের অর্থাৎ আগের দিনের ভয়াবহ তুষার ঝড়ে এয়ার্পোর্টের লাগেজ ক্যারিং বেল্ট সিস্টেম অকেজো হয়ে গেছে। সেই সিস্টেম কার্যকর না হলে কোন বিমান ছাড়বে না। তবে শিগ্রই কার্যকর হবে বলে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ আশা করছে। যাই হোক, আমাদের কপাল খুললো। বিমানে উঠার ডাক এলো; আমরা উঠে যার যার সিটে বসলাম। ক্যাথি প্যাসিফিক এয়ার লাইন্সের বিশাল বোইং বিমান ৪০০ শত যাত্রী নিয়ে বিকাল ৪:৩৬ মিনিট সময় আকাশে উঠলো। এবার বিমান হংকং এর পথে আকাশে চলতে থাকবে টানা পনের ঘন্টা ৩০ মিনিট। আথিতিয়তায় এই এয়ারলাইন্সের খ্যাতি আছে। বিমানের সুবেশি সুশ্রী ক্যাবিন কর্মীদের কর্ম চঞ্চলতা আমাকে জানিয়ে দিচ্ছিল এরা যাত্রীদের নিরাশ করবে না। আসলেও তাই হয়েছে। উড়ার পর থেকে আমরা কোন না কোন রকমের খাদ্য গ্রহণ কর্মে নিযুক্ত ছিলাম। ফুল মিল, হাফ মিলতো পেয়েছি সময় মত অসময়ে চেয়েও পেয়েছি নানা রকম পানীয়। খানা পিনা যেমনই হোক ইকোনমি ক্লাসের যাত্রী হয়ে উড়ন্ত বিমানে একটানা পনের ঘন্টা ৩০ মিনিট বসে থাকা সীমাহীন কষ্টের; বিশেষ করে যাত্রী যদি ষাটোর্ধ বয়সী এবং সুস্থ কেউ না হন। হাত পা পিঠ সর্বত্র কষ্টের ছোপ রেখে ২৬ তারিখ সন্ধ্যা বেলায় আমাদের বিমান ল্যান্ড করলো হংকং বিমানবন্দরে। হংকং এয়ারপোর্টে ট্র্যাঞ্জিট প্যাসেঞ্জার হিসেবে আমাদের থাকার কথা ৫ ঘন্টা। কিন্তু টরন্টো এয়ারপোর্টে আড়াই ঘন্টা লেট হওয়াতে আমরা হংকং এয়ারপোর্টে ব্যায় করার জন্য মাত্র আড়াই ঘন্টা সময় পেলাম। ফলে কোন বিশ্রাম নেয়ার সময় আর পেলাম না। ট্র্যাঞ্জিট লাউঞ্জে প্রবেশ করার অল্পক্ষণ পরই আমাদের রওয়ানা দিতে হলো সেই গেটের দিকে যে গেট দিয়ে আমরা প্রবেশ করবো সিডনীগামী বিমানে। বলে রাখি টরন্টো থেকে বিমান বোঝাই হয়ে হংকং আসা সব যাত্রীদের ড্যাস্টিনেশন কিন্তু এক নয়। যাত্রীদের কেউ যাচ্ছে সিডনী, কেউ মুন্বাই, কেউ ঢাকা, কেউ পার্থ,— এরকম। আমাদের বিমান ছাড়লো স্থানীয় সময় রাত ১১টা ৫০ মিনিটে। এবার প্লেনে বসে থাকতে হবে টানা ৯ ঘন্টা। নয় ঘন্টা পর ২৭ তারিখ দুপুর ১২টায় আমরা পৌঁছলাম সিডনী এয়ারপোর্টে। বিমান থেকে নামলেই দেখা মিললো আমার জন্য অপেক্ষারত রিয়াদের। রিয়াদ বাংলাদেশি এক যুবক যে মোবিলিটি এসিস্ট্যান্ট হিসেবে গেটে আমার অপেক্ষায় ছিল। রিয়াদ অত্যান্ত আন্তরিক আর কর্তব্যপরায়ণ একটা ছেলে। আমাদেরকে বের হবার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া তার দায়িত্ব। সে দায়িত্ব রিয়াদ অত্যান্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে এই যুবক। রিয়াদ আমাদের নিয়ে লাগেজ ডেলিভারি রুমে প্রবেশ করলো। আমাকে একটা বেঞ্চে বসিয়ে সে আমার স্ত্রীসহ লাগেজ সংগ্রহ করতে গেল।

অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। ওরা আর আমার কাছে আসছে না। কি করছে তারা তা দেখতে আমি নিজে গেলাম লাগেজ কক্ষে। গিয়ে তো আমি অবাক। ওরা দুই জন গভীর উৎকন্ঠা নিয়ে বেল্টের চার পাশে হাঁটছে। কি ব্যাপার জানতে চাইলে রিয়াদ বললো আমাদের লাগেজ আসে নাই। শুধু আমাদের নয় দেখলাম আরো কিছু যাত্রী সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন লাগেজের আশায়। তাদের লাগেজও আসছে না। লাগেজ বেল্টের মুভমেন্ট বন্ধ হয়ে গেল। অর্থাৎ আর কোন লাগেজ নাই। এবার যারা লাগেজ পায়নি তারা একত্র হলো। খবর পেয়ে সংশ্লিস্ট বিভাগের লোক এলো। তাকে সবাই তাদের হারানোর খবর জানালো। তিনি প্রত্যেকের কথা শুনলেন এবং কাগজপত্র দিয়ে লাগেজ না আসার বিষয়টি লিপিবদ্ধ করলেন। লাগেজ আসলে লাগেজ যার যার বাসায় পৌঁছে দেয়া হবে বলে তিনি চলে গেলেন। রিয়াদ আমাদের জন্য অনেক সময় ব্যায় করলো। তারপর আমাদের নিয়ে হাঁটতে থাকলো একেবারে বের হয়ে যাওয়ার পথ ধরে।

বাহিরে গাড়ি নিয়ে আমার কো-ব্রাদার সাজ্জাদ আমাদের অপেক্ষায় ছিল। আমাদের দেখে সাজ্জাদ এগিয়ে এলো। রিয়াদ যেন এতক্ষণে ভার মুক্ত হলো। আমাদের এখান পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া রিয়াদের দায়িত্বের মধ্যে ছিল না। আমাদের প্রতি তার ভালোবাসাই তাকে এতদুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। রিয়াদের মঙ্গল কামনা করি প্রতিক্ষণ। মহান আল্লাহর অন্তহীন রহমত নিরন্তর তার উপর বর্ষিত হোক। লাগেজের জন্য অশেষ চিন্তা মাথায় নিয়ে খালি হাতে আমরা সাজ্জাদের গাড়িতে উঠে বসলাম। সাজ্জাদ বার বার বলে যাচ্ছে- না, দুলাভাই চিন্তা করবেন না; লাগেজ পেয়ে যাবেন। কিন্তু আমি কিছুতেই চিন্তা মুক্ত হতে পারছি না। তাছাড়া, এ মুহুর্তে চিন্তা হলো আমরা দুইজন এখন কি পরবো! পরনের কাপড় ছাড়া তো আর কোন কাপড় চোপড় নাই। সবইতো লাগেজে। সিডনীর রাস্তা ঘাট বেশ সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। রাস্তায় যানবাহন কম। ফলে কোথাও আমরা যানযটের মুখোমুখি হইনি। মাত্র আধ ঘন্টা সময় ব্যায় হলো সিডনী থেকে ব্যাংকস টাউনে অবস্থিত সাজ্জাদের বাসায় আমাদের পৌঁছতে।

এতদিন ভেবেছিলাম টরন্টো বুঝি খুব অক্সিজেন সমৃদ্ধ শহর। আজ সিডনী দেখে বুঝলাম সিডনী টরন্টোকে টেক্কা দিয়েছে। সিডনীতে গাছের সংখ্যা টরন্টো থেকে ঢের বেশি। সব রাস্তার দুই পাশে আছে শুধু গাছ আর গাছ। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়লো বটলব্রাশ, সিডনী হোয়াইট গাম, ম্যাকাডেমিয়া, সিডনী রেড গাম, সিল্কি ওক, নরফক পাইন এ সকল গাছ। দুই বোনের দেখা হলো। তাদের আবেগ উচ্ছাস দেখে অভিভুত হলাম। আমার স্ত্রী বোনের কাপড় পরে দিন শুরু করলো। আমি গেলাম একটা শপিং সেন্টারে। একান্তভাবে প্রয়োজন বুঝে নিজের জন্য কিছু কাপড় কিনলাম। সেগুলো দিয়ে এখানে দিন শুরুও করলাম আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন এয়ারপোর্ট থেকে ফোন বা মেইল আসবে।
আমাদের তরফ থেকেও সেখানে বার বার ফোন যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আমেরিকা থেকে আমার ভাই জানালো দুঃসংবাদ; টরন্টো এয়ারপোর্টে লাগেজের পাহাড়। বিভিন্ন ফ্লাইটের অসংখ্য যাত্রী লাগেজ হারা। তুষার ঝড়ে বাতিল হওয়া ফ্লাইটের যাত্রীদের জন্য ফ্লাইট রিসিডিউল করতে টরন্টো এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ হিমসিম খাচ্ছে। এর মধ্যে অকেজো হয়ে গেছে এয়ারপোর্টের লাগেজ বেল্ট। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ তাই বেদিশা। এয়ারপোর্টের এ দুরাবস্থার খবর টরন্টো স্টার পত্রিকায় উঠেছে। আমার ভাইয়ের ধারণা লাগেজ পেতে আমাদের অনেক সময় লাগবে। কি আর করবো!

কিছুই করার নাই অপেক্ষার প্রহর গোণা ছাড়া। আমরা মোট ত্রিশ ঘন্টা জার্নি করে এসেছি। ফলে সীমাহীন ক্লান্ত। দুপুরের খানা খেয়ে বিছানায় পড়েই ঘুম। রাতে উঠে খানা খেয়ে আবার ঘুম। এ ঘুম ভাংলো পাখির চেঁচামেছি শব্দে। সাজ্জাদের বাসার পাশেই ছোট একটা মাঠ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি নানা রকম পাখি সে মাঠে। ঘর থেকে বের হলাম। উদ্দেশ্য হলো সকাল বেলায় একটু হাঁটা আর পাখি দেখা। মাঠে গিয়ে হাজির হলাম; মাঠতো নয় যেন পাখির অভয়ারন্য। নানা রকম পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠে। তম্মধ্যে কাকাতুয়াই প্রধান। মাথায় ঝুটি আর গায়ে সাদা পালক নিয়ে স্বাস্থবান এ পাখি কেন বার বার গাছে উঠছে আর মাঠে নামছে বুঝতে পারলাম না। কাকাতুয়া ছাড়া মাঠে আরো পেলাম কবুতর আর বিন চিকেন। এদের কোন শব্দ নেই। গাছে উঠতে নামতে ডানার একটু শব্দ হয়। কিন্তু কাকাতুয়ার কর্কষ শব্দে আমি ভারি বিরক্তি বোধ করি। খেয়াল করলাম, গাছে যখন বসে তখন সবাই যার যার স্পাউস নিয়েই বসে। চুপচাপ বসে থাকে না।

ঠোঁটের সাথে ঠোঁট ঘষে; একে অন্যের গলার, ডানার পালকে মুখ ঘষে। আমি এসব দেখে চলে গেলাম পাশের পার্কে। সেখানে ফ্রীহ্যান্ড ব্যায়ামের ব্যবস্থা আছে। আমি সে ব্যবস্থা কাজে লাগালাম। নতুন এক মহাদেশে এভাবেই আমার দিনেরর শুরু।

আমি এখন পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে। এখন এখানে গ্রীষ্মকাল; আলো ভরা প্রলম্বিত দিন। তাপমাত্রা ২০/২১ ডিগ্রী। ঝিরি ঝিরি বাতাস দিনের গায়ে হাত বুলাচ্ছে সারাক্ষণ। আমি ভাবছি আমার ছেলের কথা যাকে রেখে এসেছি বার হাজার মাইল দুরে উত্তর গোলার্ধের দেশ কানাডা। কানাডায় এখন শীত কাল। বরফের সাদা চাদরে ঢাকা জুবুথুবু শহর টরন্টোতে হয়তো এখন বরফ পড়ছে। বরফের সাথে বয়ে চলা হীম শীতল বাতাস সে বরফকে শক্ত করে দিচ্ছে। আমার ছেলে হয়তো এ মুহুর্তে শাবল হাতে নেমে পড়েছে ড্রাইভওয়ের বরফ পরিস্কার করতে। কি কঠিন জীবন!