ভজন সরকার : (প্রথম পর্বের পরে)
বেশ খানিকটা অবাকই হলাম। শত্রুর আসনে বসিয়ে রেখেছি যাদের এতোকাল ধরে। অথচ কী বিনয় আর সৌজন্যবোধ এদের। কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না অনেক কিছুই। ধন্যবাদ জানিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের দিকে এগিয়ে গেলাম ধীরে ধীরে।

একটু পরেই আন্তঃরাজ্য সড়ক পথ ১৯০ ধরে বাসটি বাফেলো সিটির দিকে চলতে শুরু করে দিলো। বাইরে তাকিয়ে আছি প্রথম দেখার অনুভ‚তির জন্যে। একেবারে নিবিড় প্রতিবেশী সুলভ বন্ধুত্ব, অথচ প্রথম দেখাতেই মনে হয় নিজ নিজ বৈচিত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি দু’টো দেশ। রাস্তার সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে রাষ্ট্রব্যবস্থার ধরণটুকুও আলাদা। আমেরিকাতে বাইরে তাকালেই রাস্তাগুলোকে মনে হয় একটু বেশি চওড়া।

কানাডাতে যেখানে মাত্র দু’এক লেনের সড়ক পথ-একমাত্র কিছু আন্তঃ রাজ্য মহাসড়ক বাদ দিলে। অথচ সীমান্তের এপারেই দেখা যাচ্ছে অসংখ্য লেনের সর্পিল সড়কগুলো। আশপাশের ঘর বাড়িগুলো কেমন দারিদ্র্যে চিহ্ন বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনে হয়। জানালা দিয়ে বাইরের মানুষজনের পোশাক পরিচ্ছদেও তেমন আভিজাত্যের ছাপ নেই। বরং কিছু কালো মানুষের উদ্ভট পোশাকের চলাফেরা দেখে আপাত মন খারাপ করেই বাইরে থেকে চোখ নামিয়ে আনলাম।

অসংখ্য অজানা, অচেনা স্মৃতিরা আমাকে এমন ভাবে ভিড় করে ধরেছিলো সেদিন যে, কখন যে পাশের সিটে এক যাত্রী এসে বসেছে সেটা খেয়ালই করিনি। নিজেকে জানালার দিকে আরও একটু সরিয়ে নিলাম আমি। প্রায় চল্লিশের কোঠায় পৌঁছানো এক ভদ্রলোক হাতের ব্যাগপত্র মাথার উপরের নিদিষ্ট জায়গায় রেখে বসলেন পাশে। মাঝারি গড়ন, একটু ফর্সাটে গায়ের রং। দেখলে সহজে মনে হয় পাকিস্তান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের হবেন।

হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি আশরাফ, আশরাফ আল এলাহি।’

নিজের পরিচয় দিয়ে আবারও আমি বাইরে তাকালাম। বাসটি তখন আন্তঃরাজ্য সড়ক পথ ১৯০ ধরে বাফেলো সিটি বাস টার্মিনালে পৌঁছে গেছে।
যে রাস্তায় মোড় নিয়ে বাসটি টার্মিনালে ঢুকে গেল, তার পাশেই বিরাটাকায় ঝকঝকে তকতকে একটা ভবন। ছাদ পর্যন্ত উঁচু বিশাল কাঁচে ঘেরা ভবনগুলো দেখলেই সহজেই বোঝা যায় এগুলো চার্চ। মাথার উপরে বিশালাকায় ক্রস চিহ্ন আর চত্ত¡রের সুনিপুনভাবে ছেঁটে রাখা গাছগুলো সহজেই আশপাশের অন্যান্য ভবনগুলো থেকে চার্চগুলোকে পৃথক করে রাখে। এ ক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম দেখলাম না। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করেও ধর্মের প্রভাব থেকে যে মানুষকে পৃথক করা যায়নি, আমেরিকার এই পরম যত্নে লালন করা চার্চগুলো তার সাক্ষ্যই বহন করছে।

টার্মিনালে অনেকেই বাস থেকে নেমে গেলেন। আমি আর সহযাত্রী আশরাফ বাসেই বসে রইলাম। মাত্র বছরখানিক প্রবাসে থেকে বুঝেছি শ্বেতাঙ্গ ছাড়া ভিন্ন কোনো বর্ণের দুই জন মানুষ একত্র হলেই একটু প্রাণ খুলে কথা বলতে চেষ্টা করে। এর পেছনের কারণ ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণে বলা যায়। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়েছে, অশ্বেতাঙ্গ মানুষগুলোও একধরনের বৈষম্য পোষণ করে নিজেদের মধ্যে। প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী হলে তো কথাই নেই। নিজের অজ্ঞাতেই শ্বেতাঙ্গ মানুষদেরকে দেয়ালের অন্য প্রান্তে ঠেলে দিয়েই আমরা একটু নিশ্চিন্ত হই। একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেই। একটু মনের মত করে নিজেদের সুখ দুঃখকে ভাগাভাগি করি। ঠিক আমাদের দেখে আসা, শিখে আসা মানসিকতার মতই।

তুমিই অসংখ্যবার বলতে, ‘আমরা সা¤প্রদায?িকতাকে কিভাবে প্রতিনিয়ত লালন করে চলেছি নিজেদের অজান্তেই। আমাদের কথাবার্তায়, হাবে ভাবে ভংগীতে অন্য স¤প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে এমন ভাবে কথা বলছি যে, তাতে স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিচ্ছি আমরা আলাদা।’
আমি প্রশ্ন করতাম, ‘যেমন?’
‘যেমন অনেকেই বলি, উনি হিন্দু হলেও খুব ভালো। আবার বলি, উনি মুসলমান অথচ কী ভাল মানুষ।’
আমি প্রশ্ন করতাম, ‘এতে দোষের কিছু আছে?’

‘দোষের এই যে, উনাকে ভাল বলে বুঝিয়ে দিচ্ছি, আসলে উনিই ভাল, অন্য সব হিন্দু কিংবা মুসলমান খারাপ। তাছাড়া শুধু এটাই নয়, আমরা নিজের বর্ণের কিংবা গোত্রের মানুষজন দেখলে কেমন নৈকট্য বোধ করি। অনেকেই আবার নিরাপদও বোধ করি। করি না কি?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ করি। এটা বোধ হয় খুব সহজাত। স¤প্রদায় কেন, অন্য পেশার মানুষজনেরাও নিজ নিজ মানুষের কাছে কী রকম স্বচ্ছন্দ বোধ করে, তুমিই বলো।’

আমার খোঁচাটা ঠিকই বুঝতে তুমি। মুখে মুগ্ধতার দ্যূতি ছড়িয়ে বলতে, ‘বুঝেছি, আমি আর আমার ডাক্তার বন্ধুদের সামনে ডাক্তারি আলাপ করবো না। তুমি থাকলে তো নয়ই। আর যাই হই, সা¤প্রদায়িকতার অপবাদ আর নিতে চাই না, বুঝলে।’
আমি তোমার দিকে একটু সরে এসে তোমাকে ভালোবাসতে চেষ্টা করতাম হাতে হাতের স্পর্শটুকু লাগতেই তুমি বলতে, ‘কী অসভ্যতা হচ্ছে, শুনি?’
হঠাৎ খেয়াল হলো পাশের ছিটে বসা আশরাফ আল এলাহি আমাকে ডাকার চেষ্টা করছে। আমি হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশের কোনো এক নির্জন স্থানে তোমার সান্নিধ্য থেকে নিষ্ঠুরের মতো নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এলাম মুহুর্তেই আশরাফের কাছে।
তখনও বাস ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে বাফেলো বাস টার্মিনালে। আশরাফকে বললাম, ‘দুঃখিত, তুমি কি কিছু বলছিলে আমাকে?’
আশরাফ বলল,‘বলছিলাম, তুমি নামবে কিনা?’

‘না, এই কিছু সময় আগেই তো নামতে হলো ইমিগ্রেশনে। তুমি কি কানাডা থেকে আসছো?’, আমি প্রশ্ন করলাম।
‘না, কানাডা যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু পারলাম না। যেতে দিলো না কানাডা ইমিগ্রেশন। তা থাক সে কথা। তুমি কি মুসলমান?’, আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করলো আশরাফ।
এটা বোধ হয় পাকিস্তানী কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানের একটা কমন প্রশ্ন। এশিয়ান চেহারা দেখলেই এই ব্যক্তিগত প্রশ্নটা করবেই। তাছাড়া বাংলাদেশী শুনলে তো কথাই নেই। আমি বরাবরের মত এবারও এড়িয়ে যাবার মতো ক’রে উত্তর দিলাম, ‘কেন বলতো, মুসলমান হলে তোমার কি কোন সুবিধে হবে?’
আশরাফ আমার বিরক্তি বুঝলো। অনেকে যদিও সেটাও বোঝে না। বারবার দুঃখিত দুঃখিত বলতে লাগলো। আমি আশরাফকে একটু সহজ করার জন্য অন্য প্রসংগে চলে গেলাম।
বললাম, ‘তুমি বুঝি অনেকদিন থেকে আমেরিকা আছো?’

তারপর আশরাফ বলে যেতে লাগলো অনর্গল ওর অভিবাসনের পেছনের কাহিনী। কিছুক্ষন আগের আমার খোঁচাটা ও অতি সহজেই হজম করে নিলো।
আশরাফ এসেছে পাকিস্তান থেকে। ওর জন্ম যদিও ইরানে। ওর বাবা শাহের অনুসারী কমিউনিষ্ট। ১৯৭৯ সালে খোমেনীর তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের সময় হাজার হাজার শাহের অনুসারীকে খুন করা হয়। সে সময় আশরাফের বয়স বিশ বছর। পরিবারে সাথে তেহরান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আসে আশরাফ। তারপর সেখান থেকে আমেরিকা আসে ১৯৯০ সালে। সে থেকে আমেরিকাতেই আছে। কিন্তু প্রচন্ড আমেরিকাবিরোধী। আমেরিকাতে মুসলমানদের কোনো আশা ভরসা নেই। আমেরিকানরা হাড়ে-মাংশে মুসলমান বিদ্ধেষী। আশরাফের এহেন অন্তহীন অভিযোগের পাহাড়।
আমি প্রশ্ন করি,‘পাকিস্তান থেকে চলে এলে কেনো? কিংবা ইরানেও তো চলে যেতে পারতে ?’

আশরাফ পাকিস্তানকে আর নিরাপদ মনে করে না। কারণ, শিয়া স¤প্রদায়কে পাকিস্তানে সুন্নি মুসলমানেরা তো হামেশাই মেরে ফেলছে। শিয়াদের মসজিদে বোমা মারছে। মিছিলে গুলি করে পাখির মত মানুষ মারছে। এসব তো হচ্ছে সরকারি মদদেই। আর ইরানেও শাহের পর তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। খোমেনী ইসলামী বিপ্লবের নামে ইরানকে শাহের সময় থেকেও অনেক পেছনে নিয়ে গেছে।
আশরাফ নিজের জন্মভ‚মিকে আর নিরাপদ মনে করে না। নিরাপদ মনে করছে না আরেক ইসলামী দেশ পাকিস্তানকেও। নিজের স¤প্রদায় অর্থ্যাৎ শিয়া স¤প্রদায়ও তাকে আর নিরাপত্তা দিতে পারছে না। বেঁচে থাকার জন্য তাই আমেরিকাতেই আশ্রয় নিয়েছে আশরাফ।
নিজের জন্মভ‚মি তাকে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা দিতে পারেনি। সেই নিরাপত্তাটুকু দিয়েছে যে আমেরিকা, তাকেও শত্রুর আসনে বসিয়েছে আশরাফ। বাফেলো থেকে নিউইয়র্ক সিটি তখনও অনেকটা দূর। প্রায় সাত- আট ঘন্টার রাস্তা। আমার পাশে বসা সহযাত্রীর সুসান্নিধ্য লাভের আশায় আশরাফকে আর কোনো অপ্রিয় সত্য কথা বললাম না।

শুধু বললাম, ‘তোমাকে তো বলাই হয়নি। আমি বাংলাদেশের মানুষ। তুমি হয়তো জানো, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীবাহিনী ত্রিশ লক্ষ মানুষ মেরেছিলো। আর তার অধিকাংশই মুসলমান। আর তুমি আজ যে আমেরিকাতে তোমার মুসলমান ভাইদের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছ এদের কিন্তু প্রায় সবাই অমুসলিম। তাহ’লে কি হলো ব্যাপারটা? মুসলমানদের কাছ থেকে প্রাণ বাঁচাতে তোমাকে আশ্রয় ভিক্ষে করতে হয়েছে অমুসলিমদের কাছে। কিছুক্ষণ আগে তুমি যে আমাকে জিজ্ঞাস করলে আমি মুসলমান কিনা? আমি মুসলমান কি অমুসলমান সেটা কি খুব মূখ্য?’
আশরাফ আল এলাহি আমার কথা কতোটুকু হ্নদয়ে ধারণ করতে পারলো বোঝা গেলো না। বাফেলো টার্মিনাল ছাড়িয়ে বাসটি আবারও আন্তঃরাজ্য সড়ক পথ ১৯০ ধরে চলা শুরু করে দিলো নিউইয়র্ক সিটির দিকে।

আমি আবারও তোমার কথাই ভাবতে লাগলাম! সেই পেছনে ফেলে আসা তোমার কথাই! (সমাপ্ত)
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)