শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : ঘোড়ার পিঠে বসার ভঙ্গিতে সে বসেছিল গাছের একটা বড় ডালে, সম্রাটের রাজকীয় শকট বহরের দিকে মুখ করে, সে তার পিতৃপুরুষ বয়োজ্যেষ্ঠদের অনুকরণ করে সম্রাটকে জানাচ্ছিল সম্মান সূচক সালাম, একটা হাত উঁচু করে। আর অন্য হাতটা দিয়ে গাছের গায়ের ছোট ছোট গর্ত থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কি যেন বের করছিল অবিরাম! আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করার পর ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হলো। সে খুঁটে খুঁটে গাছের বাকলের ফাঁক থেকে এক ধরনের সাদা রঙের কীট বের করে আনছিল। সে চিবাচ্ছিল কোন কিছু, তার মুখের মধ্যে চিবানো খাবার ছিল ঐ গাছের সাদা পোকাগুলো। ব্যাপারটা বুঝার পর, আমার আরেকটু হলেই বমি হয়ে যেতো! আমি নিরাপত্তা রক্ষীকে প্রশ্ন করলাম, “ঐ ছেলেটা কেনো পোকা খাচ্ছে?”, নিরাপত্তা রক্ষী বললো, “ওর ক্ষিদে পেয়েছে! ওর বাড়িতে খাদ্য শস্য ফুরিয়ে গেছে, ওর কাছে খাওয়ার মতো আছে এ পোকাগুলোই! গ্রামাঞ্চলে সবার অবস্থাই এমন! উল্টা পাল্টা জিনিস খেয়ে জীবন বাঁচায় মানুষ। যখন আসে দুর্ভিক্ষ, তখন গাছে পোকাও অবশিষ্ট থাকে না। মানুষ সব খেয়ে ফেলে, এমন কি গাছের বাকলও টেনে ছিঁড়ে খায়, এমনও সময় আসে, খাওয়ার জন্য গাছের বাকলও অবশিষ্ট থাকে না। তখন সবাই বসত বাড়ি ছেড়ে চলে যায় অন্যত্র। ভিক্ষা করে জীবন বাঁচায়। যদি ভিক্ষা করতে যাওয়ার পথে অতিরিক্ত ক্ষুধা পায় তবে, ওরা ভক্ষণ করে পথের পাশের হলুদ ধূলি। ক্রমাগত এই অখাদ্য খেয়ে ফুলে উঠে ওদের পেট, এক পর্যায়ে মারা পরে অনেকেই!
জাঁহাপনা, আপনি একটু আগে যে হাড়গোড়গুলো দেখেছেন, সেগুলো গরুর হাড্ডি নয়, বরং খেতে না পেয়ে মরে যাওয়া মানুষের হাড়!”

মরা মানুষদের কথা শুনে আমি নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলাম, আমার মুখে কোন কথা রইলো না। আলোচনার এই বিষয়টা আমার অপছন্দের।
কিন্তু কেনো জানি মানুষ জন সব সময়ই এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলতে পছন্দ করে। আমি হঠাত করেই বক বক্ করতে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীটির গালে কোষে একটা চড় মারলাম, যার অর্থ ওকে সতর্ক করে দেয়া, যাতে সে মরা মানুষের বিষয়ে আর কোন কথা না বলে।

কিছুক্ষণ পর গাড়ি বহর বাঁকা চাঁদ হ্রদের পাড়ে পৌঁছালো। আমার মনটা আবার ভালো হয়ে উঠলো। গোধূলি বেলায় সূর্যাস্তের রঙ্গীন আভা প্রতিফলিত হচ্ছিলো বাঁকা চাঁদ হ্রদের পানিতে, বর্ণিল আকাশ আর পানি হয়ে যাচ্ছিল একাকার। হ্রদের কিনারায় থাকা নলখাগড়া আর জলজ ঘাসের ঝোপগুলো দেখে মনে হচ্ছে, ওরা যেন ঢেউয়ের দোলা আর মৃদু মন্দ বাতাসে উড়ছে! নলখাগড়ার নরম পাতাগুলো যেন পানকৌড়ি পাখীগুলোর সাথে এক যোগে পাক খাচ্ছে বাতাসে।

হ্রদের তীরের আকাশ অর্ধেক সোনালী হলুদ, আর অর্ধেক নিখুঁত শুভ্র সাদা! পানির পাশে বাসা বেধেছে এক ঝাঁক বুনো হাঁস যাদের আছে অতীব সুন্দর উজ্জ্বল পালক, যা কি না আমাকে আরও বেশি বিস্ময় ভরা আনন্দে অভিভূত করলো। গাড়িগুলোর কাঠের চাকা আর ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ পাখীগুলোকে করলো খানিকটা সন্ত্রস্ত, কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে হাঁসগুলো সোজা উড়ে আসলো আমার রাজকীয় শকট বরাবর! আমি কোচোয়ানকে গাড়ি থামাবার নির্দেশ দিলাম, ধনুক হাতে নিয়ে লাফ দিয়ে রাজকীয় শকট থেকে নেমে আসলাম। একটা সাদা মাথাওয়ালা হাঁস আমার নজর কাড়ালো, আমার হাতের আড় ধনুক টান দেয়ার শব্দের সাথে সাথে ওটা পাক খেয়ে মাটিতে নেমে আসলো। আমি আনন্দে উচ্চ স্বরে চিত্কার করে উঠলাম। এক পাশে বসা ইয়েন লাঙ ইতিমধ্যেই তী² নজর রাখছিল, ওর দ্রুত চলা হাত মুহূর্তে তুলে আনতে গেলো তীর বিদ্ধ বুনো হাঁসটাকে।

এক হাতে হাঁসটাকে উপরে উঠিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে সে।
“জাঁহাপনা, এটা একটা মাদী হাঁস।”, আমি ইয়েন লাঙ-কে ঐ হাঁসটা কোলের উপর রেখে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে বললাম। একটু পরে আমরা পৌঁছাবো রাজকীয় সরাই খানায়। “ওখানে গিয়ে এটার গোস্তো রান্না করতে বলবো”, আমি ইয়েন লাঙ-কে উদ্দেশ্য করে এ কথাগুলো বললাম। ইয়েন লাঙ আমার নির্দেশ মান্য করে আহত হাঁসটাকে কোলে নিয়ে ওর পরনের জামা দিয়ে ঢেকে নিয়ে বসলো। আমি দেখলাম ওর গায়ের জামাটা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হাঁসটার রক্তে টক টকে লাল হয়ে উঠেছে।

বাঁকা চাঁদ হ্রদের পাড়ে অপ্রত্যাশিতভাবেই আমার জন্য এসেছিলো আনন্দঘন সময়। বেশ কিছুক্ষণ থেমে দাঁড়িয়ে ছিলো রাজকীয় শকট বহর। সবাই অধীর আগ্রহে প্রত্যক্ষ করছিলো আমার তীর ছোঁড়ার দক্ষতা, ধনুকের ছিলায় টান দিয়ে ধরার ভঙ্গি! কিন্তু হায়, পরবর্তীতে আমার ছোঁড়া বেশ কয়েকটা তীর লক্ষ্য ভেদে ব্যর্থ হয়েছে, রাগ আর ক্ষোভে আমি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি আমার হাতের আড় ধনুকটা। আমার মনে পড়ছে অনেক দিন আগে নৈকট্য পাহাড় গুরু গৃহে অধ্যয়ন করার সময় বাঁকা চাঁদ হ্রদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা সম্বলিত একটা কবিতা প্রায়ই আবৃত্তি করতাম। আমি অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না কবিতার পুরো একটা শ্লোক! ঠিক মতো মনে না করতে পেরে আমি নিজের মতো আবৃত্তি করলাম, একটা প্রায় ছন্দ বিহীন পঙতি : বাঁকা চাঁদ হ্রদের পাড়ে গোধূলির বেলায় সূর্য পরেছে হেলে,
সিয়ে রাজ ছুঁড়ছে তীর বুনো হাঁসের দিকে ডানে-বামে হেলেদুলে!

আমার আবৃত্তি শুনে রাজকীয় শকট বহরে থাকা বেসামরিক আমলারা অপ্রত্যাশিতভাবেই হাততালি দিয়ে প্রকাশ করলেন উল্লাস! দেশের নিরাপত্তা পরিষদের সচিব ওয়াং কাও উদ্যান ছাওনিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব করলেন, যেখানে আছে একটা প্রাচীন শিলা খণ্ড যার উপর খোদাই করে লেখা আছে বেশ কিছু কথা, এ প্রস্তর খণ্ডটাকে এই এলাকার সবাই খুব সম্মানের চোখে দেখে। আমি সানন্দে সম্মতি দিলাম। এক দল লোকসহ আসলাম উদ্যান ছাওনির নীচে। দেখলাম প্রস্তর খণ্ডের উপর খোদাই করা লেখাগুলো ক্ষয় হয়ে একেবারে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। উদ্যান ছাওনির খুঁটির গায়ে কালো কালি দিয়ে মোটা তুলির আঁচড়ে কিছু লেখা চোখে পড়লো, সম্ভবত কোন জ্ঞানী মানুষ লিখেছেন কথাগুলো। বাতাস আর বৃষ্টির ছাঁটে এ কথাগুলোও মলিন আর অস্পষ্ট হয়ে গেছে। সবার কাছেই অবাক করা একটা ব্যাপার চোখে পড়লো, উদ্যান ছাওনির এক পাশে বাঁশ বনের ভেতরে নলখাগড়ার তৈরী একটা কুঁড়ে ঘর। এমন জায়গায় এমন একটা ঘর কে বানিয়েছে, কি কারণে বানিয়েছে বুঝা যাচ্ছে না! বাঁকা চাঁদ হ্রদ এলাকার সরকারি আমলাদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন, “নলখাগড়ার কুটিরের সামনে তো অদ্ভুত কিছু পদ চিহ্ন দেখা যাচ্ছে!”, কয়েক জন এগিয়ে গেলেন ঐ কুটিরের দিকে, নলখাগড়ার বেড়ার তৈরী দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে ঢুকলেন ভিতরে। তারা জানালেন যে, ঘরটা শূন্য, কেউ নেই ভিতরে। একটা বাতি উঁচু করে ধরে দেখলেন ঘরের ভেতরটা। তাদের মধ্যে একজন হঠাত করেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে চিত্কার করে উঠলেন, “কুটিরের দেয়ালে কিছু লেখা দেখা যাচ্ছে! জাঁহাপনা, আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।”

আমি দ্রুত কুটিরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। একটা সরু আলোর হ্যাজাক বাতির রশ্মি ফেলে দেয়ালের গায়ে আমি দেখতে পেলাম সেই অদ্ভুত শিলালিপি, “সিয়ে সম্রাটের অধ্যয়ন দপ্তর”! হাতের লেখার ধরন দেখে সাথে সাথেই আমি ধরতে পারলাম এটা সন্ন্যাসী চুয়ে খোং-এর লেখা। আমার বিশ্বাস রাজ প্রাসাদ থেকে তাঁর নিজ এলাকা তিক্ত বাঁশ পাহাড়ে যাওয়ার পথে আমার উদ্দেশ্যেই তিনি এ কথা লিখে গেছেন, আমি যেন লেখাপড়া বাদ না দেই! সত্যিকার অর্থে এটা ছিল আমার প্রতি তাঁর একটা সতর্ক বার্তা। এই ব্যাপারটা আমার সাথে এখানে আসা মানুষ জন যাতে উপলব্ধি না করতে পারে সে জন্য খুব হালকাভাবে আমি বললাম, “খুব সাধারণ ছোট খাটো একটা বিষয়, অবাক হওয়ার কি আছে? এটা সম্ভবত কোন ধর্ম যাজক সন্ন্যাসীর লেখা, তুলি আর কালি দিয়ে অক্ষর লেখায় যার দক্ষতা নাই। হাতের লেখা সুন্দর নয় একেবারেই!”

কুটিরের নীচে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম একটা দৃশ্যের কথা, গেরুয়া রঙের পোশাক পরা এক জন সন্ন্যাসী তুষার ঝরা রাতে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছেন, আমি যেন চোখ বুজে দেখতে পাচ্ছি চুয়ে খোং এর শীর্ণকায় দেহ আর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া অস্পষ্ট মুখটা, তাঁর অভিব্যক্তির ভাষা আমার উপলব্ধির বাইরে। আমি জানি না, জ্ঞান চর্চার প্রতি প্রবল আসক্ত এই মানুষটার ভাগ্যে কি ঘটেছে! এই সন্ন্যাসী মানুষটি কি ইতিমধ্যেই বহু দূরের তিক্ত বাঁশ মন্দিরে গিয়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন? উনি কি শুরু করেছেন ওনার একাকী কঠোর তপস্যা? একটা ছোট্ট বাতির আলোয় তিনি কি জোরে জোরে পড়ছেন কনফুসিয়াসের দর্শন, একটা জীর্ণ পাতার পুস্তক থেকে! যার পৃষ্ঠাগুলোতে আক্রমণ করেছে সাদা রঙের ছত্রাক!
রাত্রি যাপন করলাম হুই চৌ-এর রাজকীয় সরাইখানায়। হুই চৌ এলাকার সীমানার মধ্যে এখন দেখা দিয়েছে মহামারী। আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাজ সরাই এর চার পাশে সোমরাজ দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছেন। সোমরাজ হচ্ছে এক জাতের তিক্ত উদ্ভিদ। আগুন থেকে কুন্ডলী পাকিয়ে ধূয়া উঠছিলো। বের হচ্ছিলো ঝাঁঝালো গন্ধ, যা নাকে যাওয়ার পর আমি হাঁচি থামাতে পারছিলাম না। সরাইখানায় আমার থাকার রাজকীয় কক্ষের সবগুলো জানালা ও দরজা রেশমের তৈরী কাপড় দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে। যা কিনা সব কক্ষের সব খানে সৃষ্টি করছে একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী এ সব কিছুই করা হয়েছে মহামারীর আক্রমণ থেকে রাজকীয় সরাই খানাকে রক্ষা করার জন্য। আমার মনটা বিরক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে, যা আমি প্রকাশ করতে পারছিলাম না। হুই চৌ এর রাজ সরাইতে এ রকম দুর্ভাগা পরিবেশের মধ্যে রাত যাপন করতে হবে, এমনটা আমি কখনোই কল্পনা করি নাই। আমার জন্য যা ছিলো একেবারেই অপ্রত্যাশিত। অবশ্য আমার সেবায় নিয়োজিত সঙ্গীগণ আমাকে জানিয়েছে যে পশ্চিম সীমান্তে ফং হুয়াং গিরিপথে যেতে হলে এটাই হচ্ছে এক মাত্র রাস্তা, অন্য কোন বিকল্প পথ নাই!

আমি আর ইয়েন লাঙ সুতা টানাটানির খেলা খেললাম কিছুক্ষণ। তারপর শুয়ে পরলাম, ইয়েন লাঙ-কে নির্দেশ দিলাম আমার পাশে শুয়ে পরতে। একটা চমত্কার হালকা পুদিনা পাতার সুবাস পাওয়া যেত ইয়েন লাঙের শরীর থেকে, হুই চৌ এর রাজকীয় সরাইখানার কটু ঝাঁঝালো গন্ধবাহী বাতাসে ইয়েন লাঙের দেহের পুদিনা পাতার সুবাস গেছে পুরোপুরিভাবে হারিয়ে।

আমরা ফিন চৌ শহরে পৌঁছিয়েই পেলাম চন্দ্র বছরের দ্বাদশ তম ‘লা’ মাসের আট তারিখ। অনেক দূর থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম ফিন চৌ শহর থেকে আসা হৈচৈ আর সেই সাথে কাঁসা আর ঢোলের শব্দ, তারের যন্ত্র বাদনের আওয়াজ যা ছিলো একটা উত্সব দিবসের নির্দেশক। আমি আগেই শুনেছিলাম ফিন চৌ হচ্ছে সিয়ে দেশের সীমানার মধ্যে থাকা অন্যতম সম্পদশালী এলাকা।

পশ্চিম অঞ্চলের সুবাদার হচ্ছেন চাও ইয়াং। সিয়ে রাষ্ট্রের পশ্চিম অঞ্চল হচ্ছে বিশেষ মর্যাদা প্রাপ্ত ঐশ্বর্যশালী এলাকা। ফিন চৌ এলাকার মানুষ রেশমের কাপড় বুনার কাজে খুবই দক্ষ। তা ছাড়া এই এলাকাবাসীর ব্যবসায়িক বুদ্ধির তী²তার সুনাম বহু অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিরাজমান।

আমাদের শকট বহর ফিন চৌ এর নগর তোরণের কাছাকাছি চলে এসেছে। দৃষ্টি খানিকটা উপরের দিকে প্রসারিত করলেই চোখে পড়ছে নগর তোরণের উপরিভাগে রাখা একটা আনুভূমিক ধাতব পাত, যার উপর স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে চীনা ভাষার চারটা অক্ষর : “ফিন চৌ ফু তি”, যার ভাবার্থ “ঐশ্বর্যের ভূমি ফিন চৌ”! শোনা যায় ভূতপূর্ব সম্রাটের জীবদ্দশায়, সম্রাট তাঁর চাচা পশ্চিম অঞ্চলের সুবাদার চাও ইয়াং-এর কাছে স্বর্ণাক্ষর খোচিত এই আনুভূমিক ধাতব পাতটি দাবি করেছিলেন। সুবাদার অত্যন্ত কৌশলী বার্তা দিয়ে প্রয়াত সম্রাটের আবদার প্রত্যাখান করেন। এই পর্যায়ে ক্রুদ্ধ সম্রাট গভীর রাতে গোপনে এক দল দ্রæতগামী অশ্বারোহী সেনা প্রেরণ করেছিলেন। এই সেনারা বিশেষ ধরণের মই ব্যবহার করে নগর প্রাকারের উপরে উঠার সময় তীরের আঘাতে একের পর এক পরে যায় মাটিতে। শোনা যায় ঐ রাতে সুবাদার চাও ইয়াং নিজে নগর তোরণের মিনারে প্রহরারত সৈন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন। যারা স্বর্ণাক্ষর খোচিত ধাতব পাতটি লুট করতে এসেছিল, সেই দুর্বৃত্তরা সবাই পশ্চিম সুবাদার চাও ইয়াং এর বিষাক্ত তীরের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছিলো।
পশ্চিম অঞ্চলের সুবাদার চাও ইয়াং এবং সিয়ে রাজ প্রাসাদের মধ্যাকার বিদ্বেষাত্মক সম্পর্ক দীর্ঘ দিন যাবত এ পর্যায়েই রয়ে গেছে।

আমার সাথে আসা সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ প্রত্যেকেই পশ্চিম অঞ্চলের যে কোন ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছেন। তারা গোটা রাজকীয় শকট বহরকে ছদ্ম আবরণে আবৃত করলেন। রাজকীয় শকট বহর ফিন চৌ এর নগর তোরণ দিয়ে শহরে ঢুকবার সময় যেন পরিণত হয়েছে একটা বাণিজ্য কাফেলায়। ছদ্মবেশী রাজকীয় শকট বহর শহরের নানা রাস্তা ও অলিগলি পরিভ্রমণ করে সবশেষে গিয়ে পৌঁছালো, মেরামত কার্যক্রম চলতে থাকা চোখ ধাঁধানো ঐশ্বর্যশালী ফিন চৌ এর রাজকীয় পান্থ নিবাসে। আমাদের এই অপ্রত্যাশিত আগমনের সংবাদটা স্বাভাবিকভাবেই, আপাতদৃষ্টিতে পশ্চিম সুবাদার চাও ইয়াং এর অগোচরেই আছে বলে মনে হচ্ছে।

ফিন চৌ এর রাজকীয় পান্থ নিবাসে শহর থেকে আসা বাদ্য বাজনা, যার মধ্যে মূলত ঢোলের আওয়াজের কারণে আমি কোন কিছু মন দিয়ে চিন্তা করতে পারছিলাম না, আমি খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পরছিলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ছদ্মবেশে ইয়েন লাঙ-কে সাথে নিয়ে পান্থ নিবাসের বাইরে যাওয়ার। পশ্চিম সুবাদার চাও ইয়াং এর প্রবৃদ্ধি সমৃদ্ধি আর ঐশ্বর্যের মাত্রা গোপনে গোপনে পরিদর্শন আর পরিমাপ করার কোন আগ্রহ আমার নাই। আমার আগ্রহ, সাধারণ মানুষ কি ভাবে আনন্দ ঘন পরিবেশে চন্দ্র বছরের দ্বাদশ তম মাসের আট তারিখের ‘লাপা’ উত্সব পালন করে, তা দেখার। কি ভাবে ফিন চৌ এর সাধারণ মানুষ নিজেদের কাজে আত্মনিবেদিত, কাজের মধ্যে তারা খুঁজে পায় আনন্দ! আমি জানতে চাই, বুঝতে চাই!

দিনের আলো কমে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। আমি এবং ইয়েন লাঙ প্রত্যেকে ‘যাও আও’ নামের জামা পাল্টিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে গোপনে পান্থ নিবাসের সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পরলাম। ইয়েন লাঙ বললো যে, সে আগে একবার ফিন চৌ-তে এসেছিল, ওর বাবার সাথে কাঁচা লোহার কড়াই ও হাঁড়ি পাতিল বিক্রি করার জন্য। সে শহরের অলি গোলি চেনে, আমাকে পথ দেখিয়ে শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারবে।

মাত্র কয়েকটা কারখানার ভিতর থেকে রেশমের সুতা কাটা আর কাপড় বুনার ঘটাং ঘটাং আওয়াজ শুনা যাচ্ছিলো। উত্সবের জন্যই সবাই ছুটিতে গেছে, ফিন চৌ-র রাস্তা ঘাটে ভীড় নেই, রাস্তা ঘাট ফাঁকা! মানুষ জনের কর্ম ব্যস্ততা নেই। রাস্তা আর বিভিন্ন এলাকার সাথে সংযোগকারী সড়কগুলো পাথর দিয়ে বাঁধানো, শীতের বেলায় ডুবে যাওয়া সূর্যের অস্পষ্ট আভায়ও বুঝা যাচ্ছে এখানকার রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে তকতকে!

ইয়েন লাঙ আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বড় ঘন্টা ঘড়ির ছাওনিতে। এই জায়গাটা এখন বেশ জমজমাট, প্রচুর মানুষ ভীড় করেছে এখানে। পথে দেখলাম একটা ছোট মদের দোকান, দোকানদার তাড়াহুড়া করে দোকান বন্ধ করছে। দোকান মালিকের অবয়বের লাল রঙ ইঙ্গিত করছে যে লোকটা পুরোপুরি মাতাল হয়ে আছে। সে একটা কাঠের তক্তপোশের উপর দাঁড়িয়ে দোকানের নাম ফলকটা নামিয়ে আনছে। সে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে খানিকটা নাচের মুদ্রার ভঙ্গি করে চেঁচিয়ে বললো, “তাড়াতাড়ি আসেন! সর্পিল ড্রাগন নাচের দল খুব শীঘ্রই বড় ঘন্টা ঘড়ি ছাওনি অতিক্রম করতে করতে যাবে!”

আমি সারা জীবনে প্রথম বারের মতো এই ফিন চৌ শহরে এক টানা দুই লি পথ না থেমে হাঁটলাম। অগণিত মানুষের ভীড়ের মধ্যে ইয়েন লাঙ আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে বড় ঘন্টা ঘড়ির ছাওনির মধ্যে ঢুকলো। আমার পায়ের পাতায় এরই মধ্যে ফোসকা পরেছে। কেউই আমাকে এবং ইয়েন লাঙ-কে লক্ষ্য করছে না। উন্মত্ত উল্লাস আর আনন্দে মগ্ন মানুষের ভীড়ের জোয়ারে যেন ভাসছে বড় ঘন্টা ঘড়ির ছাওনিটা। পুরো সময়টা আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম, আমার পা ঝিনঝিন করছিলো, পায়ে ব্যথা পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিলো যে কোন সময় কেউ আমার পায়ের পাতা দুটো মাড়িয়ে চলে যাবে। আমার জীবনে এই প্রথম বারের মতো আমি রাজকীয় মর্যাদার আবরণ ছিন্ন করে দাঁড়িয়েছি সাধারণ মানুষের ভীড়ের মধ্যে। উত্সবের আমেজে বিভোর মানুষের স্রোতের দোলায় আমার দেহটাও যেন দোলা খেয়ে একবার যাচ্ছে পূবে আরেক বার যাচ্ছে পশ্চিমে। আমার জন্য এখন বাধ্যতামূলক কাজ হচ্ছে শক্ত করে ইয়েন লাঙের বাহুটা ধরে রাখা। আমি ভয় পাচ্ছি, আমি না আবার ওকে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে ফেলি। ইয়েন লাঙ-কে তুলনা করছি কাদার মধ্যে ছুটে চলা টাকি মাছের সাথে। মানুষের ভীড় ভেদ করে সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে ক্ষিপ্র গতিতে চলার তী² দক্ষতা আছে ওর।
“জাঁহাপনা, ভয় পাবেন না। ‘লা পা’ উত্সবের সময় মানুষের ভীড় হয়, এটাই স্বাভাবিক।” সে ঘাড় বাঁকা করে তার মুখটা আমার কানের পাশে এনে বললো, “আমি জাঁহাপনাকে সবগুলো মজার জিনিস দেখাবো। প্রথমে দেখবেন মাটির উপরের মজার জিনিসগুলো। এরপর দেখবেন পানির উপরের মজাদার ব্যাপারগুলো। সবশেষে আমরা যাবো শহরের মধ্যে ওখানকার মজাদার জিনিসপত্রগুলো দেখতে!”

এবারের এই ছদ্ম বেশ ধরে রাস্তায় বেরিয়ে আসার ব্যপারটা আমার জন্য গুরুত্ব বহ। কারণ এ অভিজ্ঞতা বাইরের পৃথিবীকে দেখার জন্য আমার অক্ষি যুগলকে যেন খুলে দিয়েছে! আমি তুলনা করতে পারছি ফিন চৌ শহরের আনন্দ ঘন পরিবেশের সাথে হুই চৌ শহরের নিরানন্দ আর বিমর্ষতার। দুই শহরের বৈশিষ্ট্যের মাঝে আছে সুস্পষ্ট ব্যাবধাণ। (চলবে)