স্বপন কুমার সিকদার : “বৈশ্বিক উষ্ণায়নের যুগ শেষ হয়ে গেছে। আমরা এখন এমন একটা যুগে প্রবেশ করেছি যেখানে সবকিছু প্রচণ্ড তাপে পানির মতো টগবগ করে ফুটছে। এখনও বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে এর জন্য আমাদের খুবই দ্রুত কোনও পদক্ষেপ নিতে হবে” – আন্তনিও গুতেরেস, জাতিসংঘ মহাসচিব।

জলবায়ু হলো একটা এলাকার দীর্ঘমেয়াদী আবহাওয়ার ধরন। অন্যদিকে আবহাওয়া হলো একটি এলাকার ঘন্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে বায়ুমন্ডলের অবস্থা যেমন এর তাপমাত্রা, আদ্রতা, বাতাস, বৃষ্টি, বরফ, বন্যা, বরফ-ঝড়, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, তাপ-প্রবাহ ইত্যাদির অবস্থা। আবহাওয়া ঘন্টায় ঘন্টায়, দিনে দিনে, মাসে মাসে বা বছরে বছরে পরিবর্তন হতে পারে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা অনুযায়ী একটি এলাকার কমপক্ষে ত্রিশ বছরের আবহাওয়ার ধরনই হলো ঐ এলাকার জলবায়ু। সংক্ষেপে বা সাধারণভাবে জলবায়ু হলো ‘গড় আবহাওয়া’। যে সমস্ত ফ্যাক্টর আবহাওয়ার পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে তা হলো তাপমাত্রা, আদ্রতা, বারিপাত, বরফপাত, বাতাস, সমুদ্র স্রোত, সৌর বিকিরন, ভ‚মির বন্ধুরতা, ভ‚মির বা স্থানের উচ্চতা, অক্ষাংশ ইত্যাদি। যে সমস্ত মানবসৃষ্ট ফ্যাক্টর বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ও আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে তা হলো জীবাষ্ম জ্বালানী যেমন কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেলের ব্যবহার, বন উজাড় করণ বা বন প্রজ্বলন, কৃষি, শহুরে করন, গাড়ী এবং ফ্যাক্টরী থেকে নির্গত ধোঁয়া বা গ্যাস ইত্যাদি। যে সমস্ত প্রাকৃতিক কারণ আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে তা হলো সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবীর কক্ষপথ ও ঢাল, পৃথিবীর ঘূর্নন, সমুদ্র স্রোত, আগ্নেয়গিরির উদগীরন ইত্যাদি।

জলবায়ু পরিবর্তন হলো কয়েক দশক বা আরো দীর্ঘ সময় ধরে একটি এলাকার আবহাওয়ার ধরন বা প্যাটার্নে পরিবর্তন। এটা হলো কয়েক দশক বা আরো দীর্ঘ সময় ধরে জলবায়ু সিস্টেমের পরিসংখ্যানগত পরিবর্তন। বিগত প্রায় ১৮০০ সাল থেকে জ্বালানী হিসাবে কয়লা, গ্যাস ও খনিজ তেল জাতীয় জীবাষ্ম জ্বালানীর ব্যবহার প্রাথমিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। জীবাষ্ম জ্বালানীর প্রজ্বলন গ্রীনহাউস গ্যাস সৃষ্টি করে যা পৃথিবীর চতুর্দিকে জড়ানো কম্বলের মতো কাজ করে, সূর্যের তাপ আটকায় ও উঞ্চতা বৃদ্ধি করে।

সৃষ্ট গ্রীনহাউস গ্যাস যা জলবায়ু পরিবর্তনে কাজ করে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেন। গাড়ী চালানোর জন্য খনিজ তেলের ব্যবহার, ভবনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য কয়লার ব্যবহার, ভ‚মি ও বন পরিস্কার করন তথা প্রজ্বলন কার্বন-ডাই- অক্সাইড সৃষ্টি করে। আবর্জনার জন্য ল্যান্ডফিল (বর্জ্য ফেলার স্থান বা গর্ত) সমূহ মিথেন গ্যাসের প্রধান উৎস। এনার্জি, শিল্প, পরিবহন,ভবন, কৃষি এবং ভ‚মির ব্যবহার গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরন বা সৃষ্টির উৎসের মধ্যে অন্যতম।

“পরিবেশকে বাঁচানোর পরিকল্পনাই হলো, মানুষকে বাঁচানোর পরিকল্পনা”- স্টিওয়ার্ট ওডাল

গেøাবেল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উঞ্চতা জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিত যা পৃথিবীর দীর্ঘ মেয়াদী তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে। প্রধানতঃ মানুষের জীবাষ্ম জ্বালানীর ব্যবহার ও কৃষি কার্য্যাদির জন্য বন উজাড় করণ বা প্রজ্বলন বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধির জন্য দায়ী। প্রাক-শিল্প সময়কাল থেকে (১৮৫০ সাল থেকে ১৯০০ সাল ) গ্রীনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। গ্লোবেল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উঞ্চতা ঘটে যখন বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য বায়ুদুষনকারী বস্তুসমূহ জমা হয় এবং তা সূর্য কিরণ ও সৌর বিকিরন শোষন করে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্রতর ঝড় ও বন্যা সৃষ্টি হয় যা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও ঘরবাড়ী ধ্বংস করে। হিমবাহ ও বরফের শীটের গলন বা তরলীকরন সমুদ্রপৃষ্টের পানির লেভেলের উচ্চতা বৃদ্ধি করে যা বন্যা ও উপক‚লীয় ভূমি ডুবে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা গাছপালা ও প্রাণীর বেঁচে থাকা বা টিকে থাকায় সমস্যা সৃষ্টি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য ক্ষতিকর যে সব দিক তার মধ্যে তীব্র খরা, মারাত্মক অগ্নিকান্ড, জীব বৈচিত্রের হ্রাস বা বিলুপ্তি ইত্যাদি।

এর অন্যান্য ক্ষতিকর প্রভাব হলো, এটা ইকোসিস্টেমের উপর চাপ সৃষ্টি করে, আগাছা ও পোকার উপদ্রব বাড়ায়, বারি, বরফ বা শিলাপাতে পরিবর্তন আনে, লবনাক্ততা বৃদ্ধি বা লবনাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটায় ইত্যাদি। এই পরিবর্তন একটি বড় ধরনের সমস্যা কারণ এর ফলশ্রুতিতে পরিবেশে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। দ্রুততর গতিতে হিমবাহের গলন, উত্তর মেরুর চতুর্দিকে আর্কটিক সমুদ্রে দ্রুততর গতিতে বরফের গলন এবং পারমাফ্রস্ট বা ভূগর্ভস্থ চিরহিমায়িত অঞ্চলের গলনের ফলে শক্তিশালী গ্রীনহাউস গ্যাস মিথেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড সৃষ্টি করা ও বায়ুমন্ডলে ছড়ানো বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধির কুফলের কয়েকটি উদাহারণ।

যদি বৈশ্বিক এনার্জি বা শক্তির চাহিদার প্রয়োজনীয়তা দ্রæত বাড়তে থাকে এবং আমরা তা জীবাষ্ম জ্বালানী দিয়ে মিটাতে থাকি, তবে এই শতাব্দীর শেষে মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট কার্বন- ডাই- অক্সাইডের বাৎসরিক পরিমান ৭৫ বিলিয়ন টন বা ততোধিক এবং বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৮০০ পিপিএম বা ততোধিক হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য, বিশ্ব আবহাওয়। সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমাবেশ বা ঘনত্ব ৪১৩ পিপিএম-এ পৌঁছে যা প্রাক-শিল্প সময়কালের (১৭৫০ সালের পূর্বে) চেয়ে ১৪৯% বেশি। তবে বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধির কিছু সুফল আর্কটিক, এনার্কটিক, সাইবেরিয়া এবং অন্যান্য বরফাচ্ছদিত অঞ্চলের জন্য রয়েছে যেখানে মৃদু জলবায়ু বিরাজ করা ও অধিক গাছপালা জন্মাতে পরে।

গ্রীনহাউস-প্রভাব বায়ুমন্ডল ও সূর্যের কিরণের কারণে ক্রমাগতভাবে ঘটছে। কিওটো (Kzoto) প্রটোকল অনুযায়ী সরাসরি সাতটি গ্যাস গ্রীনহাউস গ্যাসের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। (কিওটো প্রটোকল হলো শিল্পোন্নত দেশসমূহের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি যা বাধ্যতামূলক গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরনের উপর সীমা নির্ধারণ করে)। গ্যাস সমূহ হচ্ছে: কার্বন- ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, হাইড্রোফ্লুরোকার্বন, পারফ্লুরোকার্বন, সারফার হেক্সাফ্লুরাইড এবং নাইট্রোজেন ট্রাইফ্লুরাইড। গ্রীনহাউস গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে সূর্য্য থেকে ইনফ্রারেড রেডিয়েশন (IR) শোষন করে এবং ছাড়ে। তার মধ্য থেকে কিছু তাপ বায়ুমন্ডল ভেদ করে সূর্য্যের তাপের সাথে পৃথিবীতে পৌঁছে।

সৌর বিকিরন, সূর্য্যের কিরনে উঞ্চ হয় এমন কিছুর উপর প্রভাবের কারনে, জলবায়ু পরিবর্তনে একটি গুরুত্বপ্র্ণূ উপাদান হিসাবে কাজ করে। সৌর বিকিরন এখানে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে ও বায়ুমন্ডলে অধিক কার্বন – ডাই – অক্সাইডের ফলে অধিক সৌর বিকিরন শোষিত হয়। এই ইনফ্রারেড রেডিয়েশন (IR) পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ভিতর দিয়ে পৃথিবী পৃষ্ঠে পৌঁছে তা থেকে লাফিয়ে বা পৃথিবী পৃষ্ঠে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে আবার মহাকাশে ফেরৎ আসে। কিন্তু এই ইনফ্রারেড এনার্জি, পৃথিবীর চতুর্দিকে গ্রীনহাউস গ্যাসের কম্বলের মতো আবরনের কারনে অবরুদ্ধ হয় এবং পৃথিবীর পৃষ্ঠকে উঞ্চ করে। বায়ু মন্ডলে অধিক কার্বন – ডাই – অক্সাইডের ফলে অধিক সৌর বিকিরন শোষিত হয়, পৃথিবীতে পৌঁছে, অবরুদ্ধ হয় ও অধিক উঞ্চতা সৃষ্ঠি করে।

সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রীনহাউস গ্যাস হলো সারফার হেক্সাফ্লুরাইড (বিদ্যমান শক্তিশালী গ্রীনহাউস গ্যাস) যার বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধির সক্ষমতা যদি কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সক্ষমতাকে বেইস লাইন ধরা হয় তবে তার চেয়ে ২৩,৯০০ গুন বেশী। অর্থাৎ বায়ুমন্ডলে এক টন সালফার হেক্সাফ্লুরাইড থাকা মানে হলো ২৩,৯০০ টন কার্বন – ডাই – অক্সাইড থাকা। বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরিমানের হলো কার্বন – ডাই – অক্সাইড। অল্প পরিমানে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড বিদ্যমান বা নিঃসরিত/নির্গমিত হয়। এই গ্যাসগুলো বায়ুমন্ডলে বিশেষ করে জীবাষ্ম জ্বালানী যেমন কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রজ্বলনের ফলে সৃষ্ট। অতীত থেকে ধরলে বর্তমানে বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমান বা ঘনত্ব সবচেয়ে বেশী। পৃথিবী এখন ১৮০০ সালের শেষের দিকের তুলনায় প্রায় ১.১ সেঃ বেশী উত্তপ্ত।

যাহাহউক, ইহা হলো নাসার (NASA) হিসাব মতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং প্রত্যেক দেশের বাস্তব অবস্থা প্রভাবিত করে এমন আঞ্চলিক ফ্যাক্টরের কারনে ভিন্ন হতে পারে। রেকর্ড অনুযায়ী গত দশক (২০১১ – ২০২০ সাল) ছিল সবচেয়ে বেশী উঞ্চ। অনেকে মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন প্রধানতঃ বুঝায় উঞ্চ তাপমাত্রা। কিন্তু বাস্তবে এখানে ঘটনার মাত্র শুরু। প্রত্যেক দেশকে প্রাকৃতিক বিপর্য্যয় বা দুর্যোগ যেমন মারাত্মক বন্যা বা প্রচন্ড সাইক্লোনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আঞ্চলিক ফ্যাক্টর সমূহের নিয়ন্ত্রনে অবশ্যই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

প্রশ্ন হতে পারে কিভাবে কার্বন – ডাই – অক্সাইড পৃথিবীর উপরিভাগে চতুর্দিকে মহাশূন্যে কম্বলের মতো আচ্ছাদন তৈরী করে যেখানে কার্বন – ডাই – অক্সাইড স্বাভাবিক তাপ ও চাপে বাতাসের চেয়ে ১.৫৩ গুন ভারী। উত্তর হলো কার্বন – ডাই -অক্সাইড একটি গ্যাস।

বায়ুমন্ডলীয় গ্যাস সমূহ ভালভাবে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে, স্তর স্তর ভাবে নয়। গ্যাসের কণাসমূহ স্তরে স্তরে থিতানোর চেয়ে বরঞ্চ মেশানো অবস্থায় বিদ্যমান। বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুধু ইহার আনবিক ওজন অনুযায়ী যে স্থানে বা স্তরে বা যে উচ্চতায় থাকার কথা সেখানে না থেকে প্রধানতঃ বিক্ষেপন এবং শক্তিশালী উর্ধদিকে ও নিন্মদিকে বায়ুর স্রোতের কারনে তার চেয়ে অধিক উচ্চতায় সমন্বিত বা একীভ‚ত অবস্থায় থাকতে বলা যায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে । কার্বন-ডাই-অক্সাইড গুরুত্বপূর্ণ। কার্বন-ডাই-অক্সাইড পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রীনহাউস গ্যাস।

আবার কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যতীত পৃথিবীর প্রাকৃতিক গ্রীনহাউস প্রভাব, ভ‚পৃষ্টের গড় তাপমাত্রা হিমাংক বা হিমায়িত হয় এমন তাপমাত্রার উপরে রাখা বা থাকা অসম্ভব হয়ে দাড়াত বা খুবই দুর্বল হতো। কিন্তু বায়ুমন্ডলে অধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড যোগ করে আমরা প্রাকৃতিক গ্রীনহাউস প্রভাবকে সুপারচার্জিত করছি বা বাড়িয়ে দিচ্ছি যার ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার কারন হচ্ছে।
NOAA (National Oceanic and Atmospheric Administration)-এর পর্য্যবেক্ষন অনুযায়ী, ২০২১ সালে কেবল মাত্র কার্বন-ডাই-অক্সাইড মানব সৃষ্ট যাবতীয় গ্রীনহাউস গ্যাসের মধ্যে মোট দুই-তৃতীয়াংশ তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবের জ্ন্য দায়ী।

সারা পৃথিবী জুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন বড় ধরনের ক্ষতি করছে। পর্য্যবেক্ষনে দেখা গেছে, ভারতের হিমালয় এলাকায় অধিকাংশ হিমবাহ দ্রুত গলে যাচ্ছে। Geological Survey of India, Institute of Himalayan Geology, National Centre for Polar and Ocean Research, National Institute of Hydrology, Space Application Centre কর্তৃক পরিচালিত জরীপ অনুযায়ী,তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়ের হিমবাহের নানাধর্মী, ত্বরান্বিত ও বহু পরিমান ক্ষতি হচ্ছে। রিপোর্ট অনুযায়ী হিমালয়ের হিমবাহ আগামী ২১০০ সালের মধ্যে দু-তৃতীয়াংশ গলে বা হারিয়ে যেতে পারে।

NOAA – এর প্রতিবেদন অনুযায়ী আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের উপক‚লীয় রেখা বরাবর সমুদ্রের পানির স্তরের উচ্চতা ২০৫০ সালের মধ্যে এক ফুট বেড়ে যেতে পারে। হিমবাহের গলন, অনিশ্চিত ও অপ্রত্যাশিত আবহাওয়ার ধরন, পরিবর্তনশীল বৃষ্টিপাতের প্যাটার্ন বা ধরন ও ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা মানুষ,বন্য প্রাণী বা জীবজন্তু ও গাছপালা ইত্যাদি তথা পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

বায়ুমন্ডলে যেখানে ১৯৬০ সালে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান ছিল ৩১৬.৯১ পিপিএম সেখানে ২০২১ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ৪১৬.৪৫ পিপিএম। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করচ্ছে এমন পাঁচটি দেশ হচ্ছে চীন (৩০%), যুক্তরাষ্ট্র (১৫%), ভারত (৭%), রাশিয়া (৫%), জাপান (৪%)।

আমাদেরকে বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাস ছাড়া বা নিঃসরন করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও এনার্জি বা শক্তি সংরক্ষন বা সাশ্রয়ে সতর্ক বা যত্নবান হতে হবে। বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। স¤প্রতি কানাডা সরকার ঘোষনা করেন, কানাডায় ২০৩৫ ইংরেজীর পর কেউ পেট্রোল বা ডিজেল চালিত কোন গাড়ী ব্যবসায়িক কাজ ছাড়া অন্য কোন কাজে ব্যবহার করতে পারবেন না। নূতন নির্মিত গাড়ী ২০৩৫ সনের মধ্যে শূন্য গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন যুক্ত হতে হবে। কানাডায় গাড়ীর গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন ২০২৬ সনের মধ্যে ২০%, ২০৩০ সনের মধ্যে ৬০%, এবং ২০৩৫ সনের মধ্যে ১০০% কমাতে হবে।

এই পৃথিবীকে ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য আমাদের বাসযোগ্য করে রাখতে হবে। সুকান্তের সাথে সুর মিলিয়ে আমরাও যেন বলি , “এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি”। “এটা শুধু আমাদের সামষ্টিক নয় বরং ব্যক্তিগত দায়িত্বও পরিবেশকে রক্ষা করা যেখানে আমরা বাস করি” দালাই লামা। যিনি পরিবেশকে ভালোবাসতে জানে তিনি সত্যিই ভালোবাসার মানে বোঝেন।“যদি আরো বেশি বাচতে চান তবে পরিবেশকে আগে বাচান” ব্রিলিয়ান রিড। “তুমি যেমনটা পেয়েছিলে তার চেয়ে একটু ভালো রেখো যাও তাহলেই তো পরিবেশ রক্ষা পাবে” সিডনি সেলডন। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা যদি পরিবেশের যত্ন নিই. পরিবেশও আমাদের যত্ন নেবে।

জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৬ বা জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন-২৬) বিশ্ব নেতারা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে রাখতে একমত হন। জলবায়ু পরিবর্তন রোধের নিমিত্তে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার, মিথেন গ্যাস নিগর্মন, পেট্রোল ও ডিজেলের ব্যবহার হ্রাস করা; নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার ও বৃক্ষরোপণ বৃদ্ধি. বায়ু থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস দূরীকরণ ও দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ডিকার্বোনাইজেশন প্রযুক্তিও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব নেতাদের প্রস্তাবিত নিট জিরো বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। জলবায়ু পরিবর্তন এখন এক কঠিন বাস্তবতা, একটা চ্যালেঞ্জ। আমাদের সবার জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জোরালো প্রচেষ্টা নেয়া প্রয়োজন। বিজ্ঞানীগনের মতে, লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে প্লাংকটন ও প্লান্ট বা গাছপালা থেকে বৈশ্বিক পরিবর্তন বা ভ‚তাত্তি¡ক প্রক্রিয়ার ফলে ভ‚গর্ভে জীবাষ্ম জ্বালানী বা ফসিল ফুয়েল সৃষ্টি হয়। আমাদের সতর্ক হতে হবে যেন, আমরা বিশেষ করে সেই জীবাষ্ম জ্বালানী যথেচ্ছ ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তনের মাধ্যমে কোন দুঃখ-দুর্দশা ডেকে না আনি। ছবি সমূহ সংগৃহীত। সবার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। সবাই সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন। ধন্যবাদ।

* ইনস্টিটিউশন অব ইজ্ঞিনিয়ার্স, ঢাকা, বাংলাদেশের সদস্য, এডভ্যান্সড এনভাইরনমেন্টাল টেকনোলোজীতে স্নাতক (অন্টারিও), লেখক ও সমাজ হিতৈষী কর্মী।