ফরিদ আহমেদ : তিনি একজন সংগীত শিল্পী ছিলেন। তাঁর নিজের ভাষাতেই সংগীত ছিলো তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, ঈশ্বর ও প্রাণবায়ু। অথচ একটা সময়ে তিনি যে সংগীত শিল্পী হবেন, তাঁর কোনো চিহ্নই ছিলো না। ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে দুষ্টুমি করে বেড়াতেন, বক্সিং করতেন, কুস্তির আখড়াতে গিয়ে কুস্তি লড়তেন। সংগীতে তাঁর আগমন ঘটে মূলত কাকার কারণে। তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন বিখ্যাত গায়ক এবং সুরকার। তাঁর কাকারও আবার সংগীতে আগমন ঘটেছিলো এক দুর্ঘটনার কারণে।

কৃষ্ণচন্দ্র দে তেরো বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যান। অন্ধ এই বালককে ভবিষ্যতে যাতে অন্যের উপরে নির্ভর করে চলতে না হয়, সে কারণে তাঁর মা তাঁকে গান শেখানোর সিদ্ধান্ত নেন। অন্ধ হবার পরে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কিছু কিছু ইন্দ্রিয় সক্রিয় হয়ে উঠেছিলো। যে কোনো গান শুনলেই সেটা তিনি হুবহু তুলে ফেলতে পারতেন। ছেলের এই প্রতিভা দেখেই মা তাঁকে গান শেখানোর দিকে নিয়ে যান। কৃষ্ণচন্দ্র দে এভাবে গানের জগতে এসেছিলেন বলেই আমরা পেয়েছিলাম একজন মান্না দে-কে। নইলে সংগীতের ঐতিহ্য-বিহীন ওই পরিবার থেকে এমন বিশাল মাপের সংগীত শিল্পী বের হয়ে আসার কথা না।

তাঁর ছোট কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে বিখ্যাত গায়ক হবার পরেও নিজে যখন সংগীতের দিকে আসতে চেয়েছিলেন, সেই যাত্রাটা সহজ ছিলো না। মান্না দে-দের একান্নবর্তী পরিবার ছিলো। বাবা আর দুই কাকা ছিলেন পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য। ছোট কাকাই শুধু গান করতেন। সেটাও হতো না, যদি না তিনি খুব ছোট বেলায় অন্ধ হয়ে যেতেন। অন্য দুই ভাইয়ের মতো পড়াশোনা করে চাকরি-বাকরিই করা লাগতো তাঁর।

মান্না দে-র এই ছোট কাকাকে তাঁর বাবু কাকা বলে ডাকতেন। তাঁকে দেখেই মান্না দে-রও শখ হয়েছিলো গানের জগতে আসার। কিন্তু, এতে বাধ সাধেন তাঁর মেজ কাকা। মান্না দে-র বাবা বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও, তাদের পরিবার চলতো মেজো কাকার হুকুমে। তিনি মান্না দের অন্য দুই ভাইয়ের পেশা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। একজনকে পাঠিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে আর অন্য জনকে ইঞ্জিনিয়ারিং। মান্না দে-কে ওকালতি পড়িয়ে উকিল বানানোর শখ হয়েছিলো তাঁর। সেই শখ পূরণের হুকুম জারি করা হলো একদিন।

ওকালতি না পড়ে সঙ্গীত শিল্পী হতে চান, এটা বলার পরে তাঁর মেজোকাকা বলেছিলেন,
“না, না, তোমাকে আর ওই গায়ক টায়ক হতে হবে না। দেখছ না তোমার বাবুকাকাকে? এই কি একটা জীবন? রাতদিন শুধু গান আর গান। সারা রাত গান করে ভোরবেলা বাড়ি ফিরেই আবার চলে গেল শুটিংয়ে। বাড়ি ফিরে ভাত টাত খেতে খেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আবার খেয়েদেয়েই চলল ফাংশন করতে। তুমি কি ভাব, এটা একটা সুস্থ জীবন? সারাজীবনে, সারাদিনের কাজে একটু ডিসিপ্লিন নেইই। না না, এই রকম ইনডিসিপ্লিন্ড জীবন আমি আর কারও হতে দেব না। তা ছাড়া এত গান গেয়ে, ফাংশন করে তোমার বাবুকাকা কত টাকাই বা উপার্জন করতে পারছে? না, না, ও-সব তোমার হওয়া চলবে না। তুমি ওকালতি পড়বে, ব্যারিস্টার হবে, বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। ও-সব গান টান করার পাগলামি ছাড়ো।”

মান্না দে অবশ্য গান টান করার পাগলামি ছাড়েন নাই। এ ক্ষেত্রে তাঁর জন্য ঢাল হয়ে আসেন তাঁর বাবুকাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে। তিনি ভাইপোকে এই পাগলামি করার সুযোগ করে দেন। শুধু সুযোগ দিয়েই ক্ষান্ত হন না তিনি, নিজের সমস্ত প্রতিভা দিয়ে গড়ে তুলতে থাকেন তিনি। নিজের সহকারী হিসাবে কাজ করার সুযোগ করে দেন তিনি।

১৯৪২ সালে কৃষ্ণচন্দ্র দে সংগীত পরিচালক হিসাবে কাজ করার জন্য মুম্বাইতে চলে যান। তিনি সাথে করে নিয়ে যান মান্না দে-কে। সেখানে মান্না দে তাঁর সহকারী হিসাবে সংগীত পরিচালনাতে যুক্ত ছিলেন। গায়ক হিসাবে সেভাবে কেউ তাঁকে চিনতো না। একটা দুইটা গান করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তিনি গায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে থাকেন। শুরুর দিকে অবশ্য কেউ-ই তাঁকে মান্না দে হিসাবে চিনতো না। তাঁর ভাল নাম ছিলো প্রবোধচন্দ্র দে। ওই নামেই তিনি সংগীত পরিচালনা করতেন, গায়ক হিসাবে সেটাই যেতো।

তাঁর ডাক নাম ছিলো মানা। সেটাই অবাঙালি উচ্চারণে হয়ে উঠেছিলো মান্না। তিনি তাঁর জীবনী ‘জীবনের জলসাঘর’ এ লিখেছেন, “আমার মায়ের আদরের ডাকনাম মানা, তখনও অবধি শুধু আমার পরিচিত কিছু মানুষের ডাকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তমান্না ছবি করার পর থেকে অবাঙালি উচ্চারণে মানা আস্তে আস্তে মান-না এবং তারও পরে মান্নাতে এসে দাঁড়িয়েছে।”

তিনি নিজেও তাঁর প্রবোধচন্দ্র নামটাকে পছন্দ করতেন না। ফলে, তাঁর নাম যখন মানা থেকে মান্নাতে পরিণত হয়, সেটাকেই তিনি এক সময়ে নিজের নাম হিসাবে গ্রহণ করে নেন। গায়ক প্রবোধচন্দ্রের পরিবর্তে আমরা পেয়ে যাই গায়ক মান্না দে-কে।

‘জীবনের জলসাঘর’ তাঁর আত্মজীবনী হলেও এর আসল লেখক কিন্তু তিনি নন। বইটা অনুলিখন করেছেন গৌতম রায়। মান্না দে-র জীবনী লেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছেন। সেই আলাপ রেকর্ড করেছেন। পরে সেগুলোর ভিত্তিতে অনুলিখন করেছেন। সেই অনুলিখন মান্না দে-র সম্মতিক্রমেই তাঁর জীবনী হিসাবে বের হয়েছে।

এই বইটাতে একজন সংগীত শিল্পী হিসাবে মান্না দে-কে পরিপূর্ণভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। মুম্বাই এবং ব্যাঙ্গালোরে সারাজীবন থাকার পরেও বাংলা গানের প্রতি তাঁর ছিলো অসীম টান। সেই টানেই বাংলা গান করেছেন তিনি। দূর দেশে থেকে বাংলাতে নিজের অবস্থান তৈরি করা সহজ কাজ ছিলো না। এর জন্য প্রচুর পরিমাণে আত্মত্যাগ, সাধনা আর ভালবাসা লাগে। তিনি এর সবগুলোই নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। যে কারণে তাঁর কণ্ঠের অসংখ্য বাংলা গান আমরা পেয়েছি। বাংলা গানের প্রতি তিনি ভালবাসা না দেখালেও কারো কিছু করার ছিলো না। কারণ, তিনি মুম্বাইতে যখন গিয়েছিলেন, সেটা হিন্দি ফিল্মের জগতে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যই। সেই কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন। কিন্তু, সেই সফলতার পরেও বাংলা গানকে ভোলেননি তিনি। এই জগতটাকে তিনি রাঙিয়ে দিয়েছেন তাঁর দরদভরা সুর এবং যাদুকরী কণ্ঠে দিয়ে।

বইটাতে গানের জগতে তাঁর প্রতিষ্ঠার প্রতিটা ধাপ বর্ণনা করা আছে। আমি হিন্দি গানের ভক্ত না বলে হিন্দি গানের অংশে সে রকম আগ্রহ পাই নাই। কিছুটা ম্যাড়মেড়ে লেগেছে আমার কাছে অজানা এবং অচেনা এক জগত বলে। কিন্তু, বাংলা অংশে গিয়ে সেই ম্যাড়মেড়ে ভাব কেটে গিয়েছে। তাঁর জনপ্রিয় সব বাংলা গানের পিছনের গল্পগুলো আমাকে নিয়ে গিয়েছে ভিন্ন এক জগতে। এইসব গান আগে শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। এখন তাঁর জীবনী পড়তে গিয়ে সেই সব গানের অনেকগুলোরই জন্ম ইতিহাসও জানা হয়ে গিয়েছে। তাঁর জীবনীর চেয়ে এই অংশটাই আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে।