স্বপন কুমার সিকদার : শ্রাবণ মানেই বৃষ্টি। বৃষ্টি আনে গান ও সুর।। টরন্টোতে বৃষ্টিপাত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। মোটামুটিভাবে জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগষ্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত টরন্টোতে বাংলাদেশের শ্রাবণ মাস। টরন্টোতে জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী, মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই, আগষ্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে মোটামুটিভাবে গড়ে প্রায় যথাক্রমে ২.০২ ইঞ্চি, ১.৯ ইঞ্চি, ২.৪ ইঞ্চি, ২.৫ ইঞ্চি, ২.৬ ইঞ্চি, ২.৭ ইঞ্চি, ২.৭ ইঞ্চি, ৩.১ ইঞ্চি, ৩.০ ইঞ্চি, ২.৪ ইঞ্চি, ২.৮ ইঞ্চি ও ২.৯ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়।

অবশ্য, বাংলাদেশে যখন শ্রাবণ মাস, টরন্টোতে তখন Summer (২১-শে জুন থেকে ২১-শে সেপ্টেম্বর)। টরন্টোতে উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা ও কম বৃষ্টিপাতের কারণে বৃষ্টি হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ীঘরের আঙিনা বা রাস্তাঘাটের প্রায় পানি সাব-সারফেস ওয়াটার ড্রেইনেজ সিষ্টেমে ঢুকে যায়। বৃষ্টির গান মনে প্রেমের আবেগ মিশায়।

মন বৃষ্টিধারায়, পাগল হাওয়ায় এলোমেলো হলেও, আমাদের মনকে ভরিয়ে দেয় কাণায় কাণায়। অঝোর ধারার বৃষ্টির মাঝে আমরা প্রিয়তম/প্রিয়তমাকে খুঁজি। হারিয়ে যেতে মন চায়। শ্রাবণ/বৃষ্টি নিয়ে রচিত হয়েছে অজস্র গান। বৃষ্টির গান কখনো বিষাদ মগ্ন, আবার কখনো আনন্দ মুখর। বৃষ্টি/শ্রাবণ নিয়ে গীতিকারের জনপ্রিয় গানের কথাগুলি আমাদের মনের কথা। পৃথিবীর সকল দেশের বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষের মনকে এই গানগুলি চিরদিন বিশেষ করে বৃষ্টি/শ্রাবণের দিনে আন্দোলিত করবে নিঃসন্দেহে। বিখ্যাত গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার উনার গানে বর্ষার দিনগুলিতে প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে আমাদের মন কত উদগ্রীব হয় তার একটি সুন্দর রুপ তুলে ধরেছেন। যেমন –
“এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাব, কবে পাব, ওগো তোমার নিমন্ত্রণ
শুধু ঝরে ঝর ঝর, আজ বারি সারাদিন
আজ যেন মেঘে মেঘে, হল মন যে উদাসীন
আজ আমি ক্ষণে ক্ষণে, কী যে ভাবি আনমনে
তুমি আসবে, ওগো হাসবে, কবে হবে সে মিলন”।

প্রখ্যাত গীতিকার পুলক ব্যানার্জী শ্রাবণের দিনে প্রিয়জনের উপস্থিতির মধুর স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন – “আকাশ মেঘে ঢাকা, শাওন ধারা ঝরে, যেদিন পাশে ছিলে, সেদিন মনে পড়ে…
সেদিনও এইখানে, সজলও ছিলো হাওয়া, কেয়ার বনে তারও, ছিলো যে আশা যাওয়া।
যুথির সুরভিতে, আঙ্গিনা ছিলো ভরে… এখনো সেই স্মৃতি, বুকেতে বয়ে চলি”।

বিশিষ্ট গীতিকার মুকুল দত্তের গানে দেখি বরষার/শ্রাবণের দিনে প্রিয়তমাকে পাশে পেতে আবেগে ভরা প্রেম নিবেদন –
“আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন, ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে, তোমাকে আমার মনে পড়েছে।
আলোর তরীটি বেয়ে দিন চলে যায়, আধারের মন জ্বলে তারায় তারায়।
আমার এ মন কেন শুধু আকুলায়, বরষন যেন কোথা হয়েছে।
দিও না কখনও কিছু দিও না আমায়, সবকিছু পাওয়া হবে পেলে গো তোমায়।

চোখের জলেতে বেয়ে সুখ এলো তাই, আজ মন মোহনাতে মিশেছে”।
প্রসিদ্ধ গীতিকার রকেট মন্ডল মেঘলা দিনে ভালোবাসার মানুষটির আবেশে মন রাঙাতে চান, কাছে রাখতে চান এই বলে –
“আকাশ এতো মেঘলা, যেও নাকো একলা, এখনি নামবে অন্ধকার
ঝড়ের জল-তরঙ্গে, নাচবে নটি রঙ্গে, ভয় আছে পথ হারাবার
গল্প করার এইতো দিন, মেঘ কালো হোক মন রঙিন
সময় দিয়ে হৃদয়টাকে, বাঁধবো নাকো আর”।


জীবনের কবি, প্রাণের কবি জীবনানন্দ দাশের বর্ষা/শ্রাবণের কবিতা/গানে আমরা পাই প্রাণের ছোঁয়া-প্রীতি, অনুরাগ ভরা জীবনের পরশ। যেমন – “এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে, ধুয়েছে আমার দেহ-বুলায়ে দিয়েছে চুল-চোখের উপরে। তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, আবেগের ভরে”।

শ্রাবণের ঝরঝর নির্ঝরণী আমাদের মনকে একসাথে আনন্দ- বেদনা ও বিরহকাতরতায় ভরে তোলে। রিমঝিম ধারায় আমাদের মন হারাতে চায়। চন্ডীদাস তার প্রেম-বিরহ কাতরতার কথা প্রকাশ করেন উনার কবিতায় এমনিভাবে – “এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা/ কেমনে আইল বাটে, আঙিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে/ দেখিয়া পরাণ ফাটে”।
মধুসুদন দত্ত ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার রুপকল্প কল্পনায় বলেন – “গভীর গর্জন করে সদা জলধর/ উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর”।

কবি হাসান হাফিজ তার ‘বর্ষাভেজা পদাবলী’-তে বর্ষাকে আনন্দ-বেদনা উভয়রুপেই কল্পনা করেছেন। তিনি শ্রাবণকে দেখেছেন গভীর দৃষ্টিতে। যেমন – “শ্রাবণে বিরহ শুধু নয়, আগুনও রয়েছে, সেই তাপে শুদ্ধ হবে অসবর্ণ মিল পিপাসা”।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বাংলায় নন, ইংরেজীতেও আবেগময়ী গান/ কবিতা রচনা করেছেন শ্রাবণ-বৃষ্টি নিয়ে। কবি সাহিত্যিকগন দেশ-কালের যে উর্ধে তিনি তারই স্বাক্ষর রেখেছেন। উনার রচিত ‘New Rain’ গান/কবিতার অংশ বিশেষ –
“Rain-clouds wet my eyes with their blue collyrium, collyrium
I spread out my joy on the shaded woodland grass,
My soul and Kadamba-trees blossom together,
O coolly rain-clouds wet my eyes with their blue collyrium
….. ….. ……..
It dances today, my heart, like a peacock it dances, it dances.
The woods vibrate with cicadas,
Rain soaks leaves,
The river roars nearer and nearer the village,
O wildly it dances today, my heart, like a peacock it dances”.

বাঙলা ভাষা-ভাষীর কাছে শ্রাবণ/বৃষ্টি যেভাবে আনন্দ, প্রেম, ভালোবাসা ও বিরহের বার্তা নিয়ে আসে তেমনিভাবে ইংরেজী ভাষাভাষীর কাছেও শ্রাবণ/বৃষ্টি একই বার্তা নিয়ে হাজির হয়। ইংরেজী ভাষাভাষী প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকগণের কবিতার অংশ বিশেষ –

“How beautiful is the rain! After the dust and heat,
In the broad and fiery street,
In the narrow lane,
How beautiful is the rain!
How it clatters along the roofs,
Like the tramp of hoofs’– Henry Wadsworth
ÒRaining raining,
All night long:
Sometimes loud, sometimes soft
Just like a song’. – Amelia Joshepine
‘Here comes the rain again,
Falling on my head like a memory
Falling on my head like a new emotion,
I want to walk in the open wind
I want to talk like lovers do,
Want to dive into your ocean?’ – Eurythmics

বৃষ্টির দিনে প্রিয়জনকে পেতে মন চায়। মেঘ ছুঁয়ে যায় আমাদের হৃদয়। কখনো মেঘের সাথে আসে বৃষ্টির ঝর্ণা – কখনো টিপ টিপ, কখনো প্রবল ধারায়। টরন্টোতে শ্রাবণ বা বৃষ্টির কল্যাণী রুপটাই বেশি। বৃষ্টি কেবলমাত্র জলের ফোটা নয়। ইহা হলো আকাশের পৃথিবীর জন্য যেন মমতা – ভালোবাসা। আমাদের সবার জীবন ভালোবাসায় পূর্ণ হউক।

আমরা যেন ভালোবাসার বৃষ্টিতে অন্যকেও সিক্ত করি। এই ভালোবাসা মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখা তথা মানবতা বোধে আমাদের আরও উজ্জীবিত করুক, উদ্বুদ্ধ করুক। বাংলাদেশের শ্রাবণ মাস সময়ে টরন্টোতে বৃষ্টিপাতের সময় তোলা ছবি সন্মানিত পাঠকবৃন্দের উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে উপস্থাপন করা হলো। সবাই ভাল ও নিরাপদ থাকুন। ধন্যবাদ

প্রকৌশলী, ‘ইনস্টিউশন অব ইজ্ঞিনিয়ার্স, বাংলাদেশ’-এর সদস্য, কোয়ালিটি এসুরেন্স এন্ড ম্যানেজমেন্টে অনার্সসহ স্নাতক (অন্টারিও) ও সমাজ হৈতষী কর্মী।