ফরিদ আহমেদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। প্রতিষ্ঠাকালে এর বেশিরভাগ শিক্ষকই ছিলেন হিন্দু। পূর্ববঙ্গ যদিও মুসলমান প্রধান ছিলো, এখানে শিক্ষক হবার মতো শিক্ষিত মুসলমান ছিলো না বললেই চলে। শুধু পূর্ববঙ্গ না, পুরো বাংলাতেই মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষায় হিন্দুদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলো। ফলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকদের সিংহভাগ এসেছিলো হিন্দুদের মধ্য থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো অবহেলিত পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে হিন্দু শিক্ষকরা একক আধিপত্য না খাটাতে পারে, সে কারণে একটা ব্যালান্স সিস্টেম চালু করা হয়েছিলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্য পরিচালনার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিলো এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের হাতে। এর সভ্য ছিলেন, ভাইস চ্যান্সেলর, কোষাধ্যক্ষ, ডিভিশনাল কমিশনার, তিনজন ডীন, তিনজন প্রভোস্ট এবং মনোনীত আরও আট বা দশজন সদস্য। ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার, ডীন, প্রভোস্ট এঁরা যে হিন্দু হবেন, সেটা বলাই বাহুল্য। আগেই বলেছি শিক্ষকদের একটা বড় অংশই ছিলেন হিন্দু। এঁদের কারণে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে হিন্দুরা সংখ্যায় বেশি চলে আসতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে হিন্দুদের এই সংখ্যাধিক্যকে নিউট্রালাইজ করা হতো অধিক সংখ্যক মুসলমান সভ্য মনোনয়ন করে। এঁরা শিক্ষক ছিলেন না। ঢাকার মুসলমান সমাজের অভিজাত অংশের সদস্য ছিলেন তাঁরা।

এই মুসলমান সভ্যরা প্রায়শই শিক্ষক নিয়োগে হস্তক্ষেপ করতেন। দেখা গেলো যে, একই পদে হয়তো একজন হিন্দু ছেলে আর একজন মুসলমান ছেলে আবেদন করেছে, হিন্দু ছেলেটার যোগ্যতা বেশি থাকার পরেও এঁরা মুসলমান ছেলেটাকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন। অনেক সময় তাঁরা সফলও হয়েছেন। এটা খুবই একটা অন্যায় কাজ। একজন ব্যক্তির ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে তাঁর যোগ্যতাকে যাচাই করাটা বৈষম্যমূলক আচরণ। এই ধরনের অন্যায় প্রচেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার জন্য, উৎকৃষ্টতার জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ, দেখা যাবে এভাবে ধীরে ধীরে অযোগ্যরা ছড়িয়ে পড়ছে নানা জায়গায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালেই ইতিহাস বিভাগে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন রমেশচন্দ্র মজুমদার। ইতিহাসবিদ হিসাবে তিনি বিখ্যাত। ১৯৩৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসাবে নিয়োগ পান। পাঁচ বছর তিনি এই গুরু দায়িত্বটা পালন করেছিলেন।

রমেশচন্দ্র মজুমদার শেষ জীবনে গিয়ে আত্মজীবনী লিখেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীর নাম জীবনের স্মৃতিদীপে। সেই আত্মজীবনীতে তিনি এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের মুসলমান সভ্যদের এই আচরণ নিয়ে লিখেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে এই বিষয়টা নিয়ে তিনি মুসলমান সভ্যদের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। তাঁর ভাষাতেই,
“এ বিষয়ে তাঁদের অনেকের সঙ্গে আমি আলোচনা করেছি। বলেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের উৎকর্ষ নির্ভর করে তার শিক্ষকমণ্ডলীর উপরে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানতঃ মুসলমান ছাত্রদের কল্যাণের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং যোগ্য শিক্ষক যদি নিযুক্ত না হয় তাহলে মুসলমান ছাত্রদের পক্ষেই তা পরিণামে অনিষ্ঠের কারণ হবে। এর উত্তরে তাঁরা যা বলতেন সেটিও খুবই বিচার বিবেচনা করে দেখার মতো। তাঁদের মতে প্রধান প্রধান অধ্যাপক (Professor, Reader) নিয়োগের বেলায় সা¤প্রদায়িক কোনো প্রশ্নই তোলা উচিত নয়। গুণানুসারে যাতে যোগ্যতম ব্যক্তিই নিযুক্ত হন তা তাঁরা সম্পূর্ণ অনুমোদন করেন। কিন্তু অন্যান্য শিক্ষক এবং কর্মচারীদের বেলায় কতকাংশে নিকৃষ্ট হলেও তাঁরা একমাত্র মুসলমানকেই নিযুক্ত করতে চান। তার কারণ এই যে, বাংলা দেশে, বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গে, মুসলমানদের অবনতির একটি প্রধান কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের অভাব। তাঁদের মধ্যে কিছু জমিদার আছেন; বাকি সবই কৃষক। হিন্দুদের মধ্যে যেমন শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার প্রভৃতি শ্রেণীর লোকেরাই সমাজের শীর্ষস্থানে রয়েছেন তাঁরাও তাই নিজেদের সমাজে করতে চান। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি করতে হলে শিক্ষক দিয়েই তা আরম্ভ করতে হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সব মুসলিম সভ্য কারা ছিলেন আমি জানি না। রমেশচন্দ্র মজুমদার এঁদের নাম উল্লেখ করেন নাই তাঁর বইতে। এই নাম না জানা মুসলমান সভ্যদের বুদ্ধিমত্তা এবং দূরদর্শিতা দারুণভাবে প্রশংসাযোগ্য। মুসলমান সমাজের মূল ত্রুটিটাকে তাঁরা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং সেটাকে সংশোধনের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। যদিও সেই সংশোধনের প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি ন্যায়সঙ্গত ছিলো না।

একটা সমাজকে আসলে এগিয়ে নিয়ে যায় মধ্যবিত্তরাই। উচ্চবিত্ত ভোগ বিলাসের বাইরে চিন্তা করতে পারে না, আর নিম্নবিত্ত পেটের তাড়নাতেই তার বেশিরভাগ সময় নষ্ট করে। ফলে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে এই দুই শ্রেণীর তেমন কোনো ভ‚মিকা থাকে না। বাংলার হিন্দু সমাজ যে মুসলমান সমাজের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গিয়েছিলো, সেটার মূল কারণই ছিলো হিন্দু সমাজের শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী। মধ্যবিত্ত শ্রেণী বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমাজকে নেতৃত্ব দেয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যেও সোচ্চার থাকে। যে কারণে নিম্নবিত্তের মানুষরাও এদের অনুসরণ করে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণী কী করতে পারে, সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছি আমরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণেই মূলত পূর্ববঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, স্বৈরাচার-বিরোধিতায় সোচ্চার থেকেছে, স্বাধীনতার অগ্নিশপথ নিয়েছে।

ষাটের দশকে আমাদের জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ বা ছয় শতাংশ ছিলো মধ্যবিত্ত। কিন্তু, এরাই পাকিস্তানি শাসকদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো।
আজকের আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণী নেই বলেই এমন এক বন্ধ্যাকাল যাচ্ছে!!, এই হতাশার কথা লিখতে পারলে খুব ভালো হতো। বাস্তবতা হচ্ছে, ষাটের দশকের সেই পাঁচ শতাংশ মধ্যবিত্ত এখন বেড়ে সংখ্যার হিসাবে তা দাঁড়িয়েছে তিরিশ শতাংশে। কিন্তু, এই বিশাল তিরিশ শতাংশ মধ্যবিত্ত এখন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়।

এরা আয়ের হিসাবেই শুধু মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাতে বিন্দুমাত্রও ভ‚মিকা নেই তাদের। এদের এক অংশ লড়াই করছে নিম্নবিত্তে যাতে অবনমন না হয়, সেটার জন্য। আর আরেক অংশ লড়াই করছে নিজেদের উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে নিয়ে যাবার জন্য। ভোগের স্বপ্ন তাদের চোখে। যে কারণে স্থিত মধ্যবিত্ত বলে কিছু নেই। আর এর অভাবেই আমাদের সমাজ এমন হালছাড়া নৌকোর মতো ছুটে চলেছে অশান্ত সাগরে।