ফরিদ আহমেদ : পঙ্কজ কুমার মল্লিক তখন সবে কলেজ পড়ুয়া এক ছাত্র। সালটা ১৯২২। রবীন্দ্রনাথের গানের বিষয়ে গভীর আগ্রহ শুরু হয় তাঁর মনে। আগ্রহের বিষয়টা খানিক আশ্চর্যজনকই বলা চলে। কারণে, সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের গান খুব একটা জনপ্রিয় ছিলো না। এখনকার মতো রবীন্দ্র ভক্ত গদগদ পরিবেশ তখনও তৈরি হয়নি। রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা চলতো খুব সীমিত একটা পরিসরের মধ্যে। পঙ্কজ মল্লিকের ভাষাতেই ‘বিপুল জনসমাজে তাঁর গান ক’জন গাইতো তখন? যদিও বা কেউ গাইতেন, তাও বিচ্ছিন্নভাবে, দুটি-একটি গানের পুঁজি নিয়ে, মেয়েলি ছাঁদে, মেয়েলি গলায়, ঘরে বসে পরিচিত মেয়েদের আসরে। আর বাছা বাছা কিছু গান গাওয়া হতো ব্রাহ্ম সমাজে, সাধারণ বাঙালীকে তা স্পর্শ করতো না।’

এমন একটা সীমিত পরিসরে চর্চা হওয়ার পরেও, রবীন্দ্র সংগীত শেখার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তখন অবশ্য রবীন্দ্র সংগীতও বলা হতো না। বলা হতো রবিবাবুর গান। তিনি শুনেছিলেন রবিবাবুর গান নাকি ভাবে, ভাষায় এবং সুরে অতি সুন্দর। ফলে, এই গান শেখার জন্য তিনি উৎসুক হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি’ এই গানের একটা লাইন আছে। সেটা হচ্ছে ‘না চিনিতেই ভালো বেসেছি।’ পঙ্কজ কুমার মল্লিকের অবস্থাও হলো তাই। রবীন্দ্র সংগীতের রস আস্বাদন করার আগেই তিনি এর প্রেমে পড়ে গেলেন। তাঁর মনে বিশ্বাস জন্মে গেলো যে, রবীন্দ্রনাথের গানেই তাঁর ইহজনমের মুক্তি রয়েছে, এই গানই তাঁর জীবনের তীর্থ-যাত্রার প্রধান সম্বল। ফলে, তাঁর মনের মধ্যে তীব্র বাসনা তৈরি হলো রবীন্দ্রনাথের গান শেখার জন্য। ‘না চিনিতেই ভালো বেসেছি’-র, এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হয় না।

পঙ্কজ মল্লিকের মনে বাসনা তৈরি হলেও, রবিবাবুর গান শেখার সুযোগ তাঁর ছিলো না। তিনি দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতেন। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নিধুবাবুর টপ্পা খুব ভালো জানতেন। এর সাথে কীর্তন, শ্যামাসংগীত, রামপ্রসাদীতেও তাঁর দক্ষতা ছিলো। দক্ষতা ছিলো উচ্চাঙ্গ সংগীতেও। কিন্তু, রবিবাবুর গান তিনি জানতেন না। ফলে, ছাত্রের এতো আগ্রহ এবং বাসনা থাকার পরেও তিনি তাঁকে সেটা শেখাতে পারেন নাই।
রবিবাবুর গান না শিখতে পারলেও, সেই গানের প্রতি পঙ্কজ কুমার মল্লিকের প্রেম সামান্যতমও কমেনি। বরং বেড়েই চলেছেন একদিন দুপুরবেলা তিনি গান শিখতে গিয়েছেন দুর্গাদাসবাবুর বাড়িতে। গিয়ে দেখেন তিনি বাড়িতে নেই। তক্তপোষে বসে অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ করেই তাঁর চোখ যায় একটা বইয়ের দিকে। বইটার নাম ‘চয়নিকা’। কবির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটা হাতে পেয়ে যেনো স্বর্গ হাতে পেলেন তিনি। বইটা খুলতেই ‘চির আমি’ নামের একটা গীতি কবিতার দিকে নজর গেলো তাঁর। এর প্রথম লাইন হচ্ছে, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’। কবিতাটা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। নিজের অজান্তেই এটাতে সুর বসাতে থাকলেন তিনি। সুর বসানো আর গান গাওয়ার সুবিধার জন্য পাশের গণেশ পার্কে চলে গেলেন তিনি। সেখানে বসেই কবিতাটাতে সুর দেওয়া সমাপ্ত করলেন তিনি। সুর দেওয়া শেষ হতেই ছুটে গেলেন আনন্দ পরিষদের দিকে। এটা একটা সৌখিন নাট্যশালা। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পাশেই এদের অফিস। এর কর্মকর্তা ছিলেন ল²ীনারায়ণ মিত্র। সেখানে গিয়ে ভাগ্যক্রমে রুমও খোলা পেয়ে পেলেন তিনি। কোণের দিকে রাখা অর্গানের সামনে বসে, সেটা বাজিয়ে সদ্য সুর দেওয়া গানটা গাওয়া শুরু করলেন তিনি।

এর পরে কী ঘটলো সেটা তাঁর লেখা আত্মজীবনী ‘আমার যুগ আমার গান’ থেকে তুলে দিচ্ছি আমি।
“এমন সময় কে যেন পিছন থেকে বলে উঠলো – উঁহু, উঁহু, একটু যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।
চমকে উঠে ফিরে দেখলাম আমাদের ল²ীদা – ল²ীনারায়ণ মিত্র। গান থামিয়ে বললামÑ কী বলছেন ল²ীদা, আপনার কথার মানে আমি বুঝতে পারছি না। এটা তো রবি ঠাকুরের কবিতা, আজই আমি নিজে নিজে সুর লাগিয়েছি।
– সে কী, এটা তো রবিবাবুর একটা গান, ওঁর নিজেরই সুর দেওয়া আছে। আরে, তুমি তো তাই গাইছ, মাঝে মাঝে সামান্য তফাৎ হচ্ছে।
কী বলব, সেই মুহূর্তে আমার সমস্ত চৈতন্য প্রথমে বিস্ময়ে ও পরক্ষণেই এক অপার্থিব পুলকে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমি যে ঠিক কী বলেছিলাম এরপর, তা আজ আর মনে নেই। হয়তো বলে উঠেছিলাম- বিশ্বাস করুন ল²ীদা, গানটা শোনা দূরের কথা, কবিতাটির বাণীই এই প্রথম আমার চোখে পড়লো। বিশ্বাস করুন, এটা আমার নিজের সুর, এই মাত্র নিজে নিজে লাগিয়েছি।”

ল²ীনারায়ণ মিত্র এই আশ্চর্যজনক ঘটনাকে বিশ্বাস করেছিলেন কিনা, সেটা আমরা জানি না। বিশ্বাস করাটা একটু কঠিনই। গানের সুর করার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ জানাটা নিশ্চিতভাবেই প্রয়োজন। সংগীতের ব্যাকরণ মেনেই গানে সুর বসানো হয়। কিন্তু, মনে রাখা দরকার, এটা একটা সৃষ্টিশীল কাজ, অংকের কোনো নিয়ম না। দু’জন মানুষের সৃষ্ট সুর এক হতে গেলে অলৌকিক ঘটনা ঘটা লাগে।
এর একটা উদাহরণ আমাদের পরিচিত একটা গান দিয়েই দিতে পারি। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, আমাদের প্রভাত ফেরির এই গানটার প্রথম সুর করেছিলেন আব্দুল লতিফ। পরে এটাতে সুর দেন আলতাফ মাহমুদ। এখন আমরা এই গানটাকে আলতাফ মাহমুদের দেওয়া সুরেই গাই। আব্দুল লতিফের দেওয়া সুরটা হারিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অন্তরালে। যাঁরা এই গানের দু’টো সুরই শুনেছেন, তাঁরা জানেন, আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিলো সেখানে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ এই গানের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এবং পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুর হুবহু এক হলো কী করে? এর একটা উত্তর আগেই দিয়েছি আমি। অলৌকিক কারণে এক হতে পারে। বাস্তব কারণ বলতে গেলে দু’টো অনুমান আমার মাথায় আসছে। একঃ পঙ্কজ কুমার মল্লিক এই গানের সুরের বিষয়ে সত্য ভাষণ দেননি। বানিয়ে বানিয়ে লিখেছেন তিনি এই গল্প। দুইঃ তিনি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সুরটা আগে কোথাও শুনেছেন। শোনার পরে ভুলে গিয়েছিলেন হয়তো। যে কারণে সুর দেবার সময় নিজের অজান্তেই রবীন্দ্রনাথের সুর এসে গিয়েছে তাঁর মনে। তিনি ভেবেছেন নিজে সুর দিচ্ছেন, কিন্তু আসলে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সুরকেই তিনি বসাচ্ছিলেন ওই গানের উপরে।
‘চির আমি’ গীতিকবিতার সুরের ক্ষেত্রে যেটাই ঘটুক না কেনো, এর পরে রবীন্দ্রনাথের আরেকটা কবিতাতে সুর দিয়ে ফেললেন তিনি। এই কবিতাটার শিরোনাম ‘শেষ খেয়া’। খেয়া কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কবিতা এটা। এর প্রথম লাইন হচ্ছে, ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়া’।

এটাতে সুর দিয়ে নানা জায়গায় গেয়ে বেড়াতে শুরু করলেন তিনি। প্রশংসাও পেলেন প্রচুর পরিমাণে। এর পরেই শুরু হলো বিপত্তি।

রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তাঁদের কানে গিয়েছিলো যে পঙ্কজ কুমার মল্লিক রবীন্দ্রনাথের কবিতাতে নিজে সুর দিয়ে গেয়ে বেড়াচ্ছেন। পঙ্কজ মল্লিক এলে, এই গানের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলো তাঁকে।। তিনি মিথ্যা কথা বলে দ্বিধায় ফেলে দিলেন রথীন্দ্রনাথকে। বললেন যে এটা রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া সুর, স্বরলিপিও আছে এই গানের। সেই স্বরলিপি দেখেই গানটা শিখেছেন তিনি। কোন বইতে আছে জিজ্ঞেস করায় বইয়ের নামও বলে দিলেন তিনি। রথীন্দ্রনাথ সেই বই দেখতে চাইলে সেটা একটা বন্ধু নিয়েছে বলে মিথ্যা অজুহাত দিলেন তিনি। এটা করে সেখান থেকে পার পেয়ে ফিরে এলেন তিনি।
এই মিথ্যাতে অবশ্য রেহাই মেলেনি। এক মাস পরে আবার চিঠি পেলেন তিনি। এবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখা করতে বলেছেন। তিনি দেখা করতে গেলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ওই গানটা গাইতে বললেন। ঘর্মাক্ত কলেবরে ভয়ে ভয়ে তিনি গান ধরলেন। কবি চোখ বুজে গান শুনছেন। গান শেষ হতেই, গান কেমন হলো, সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস তাঁর হলো না। পাশের দরজা দিয়ে পলায়ন করলেন তিনি।

পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুর দেওয়া এই গান রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করেছিলেন কিনা, সেটার জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিলো প্রায় পনেরো বছর। প্রমথেশ বড়ুয়া ‘মুক্তি’ নামের একটা চলচ্চিত্র করেছিলেন। এটা মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৩৭ সালে। এই ছবিতে সুরকার এবং গায়ক হিসাবে কাজ করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। তিনি ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ এই গানটাকে এই ছবিতে ব্যবহার করেন। তবে, তার আগে রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে আসেন তিনি।

এই গানটা এখনো রবীন্দ্র সংগীত হিসাবেই পরিচিত। যদিও অনেক লোকই জানে না যে এর সুর আসলে রবীন্দ্রনাথ দেননি, দিয়েছেন পঙ্কজ মল্লিক। গানটাকে অবশ্য বেশি জনপ্রিয় করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ‘অনিন্দিতা নামের একটা ছবি পরিচালনা করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেই ছবিতে তিনি এই গানটা ব্যবহার করেছিলেন। গেয়েছিলেন নিজেই। তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘আনন্দধারা’-তে লিখেছেন,
“এ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটা দিয়েছিলাম। গেয়েছিলাম আমি নিজে। রবীন্দ্রনাথের গান হলেও সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজদা। উনি এক কথায় অনুমতি দিয়েছিলেন।

পঙ্কজদা ভাগ্যবান লোক। ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানের সুর করে রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন পঙ্কজদা। রবীন্দ্রনাথের খুব ভালো লেগেছিলো সুরটা। তাই ওঁর অনুমোদন অনায়াসেই পেয়েছিলেন পঙ্কজদা। সুখ্যাতিও পেয়েছিলেন। সত্যিকথা বলতে কী, রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার শুরু হয়েছিল পঙ্কজদার মাধ্যমেই। উনিই প্রথম সাধারণ শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান পৌঁছে দেন রেকর্ড, ফাংশানের মাধ্যমে। আর, তারপরই রবীন্দ্রসংগীত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।’

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে এই গান নিয়ে কতোখানি নাটক হয়েছিলো, সেটা তিনি জানতেন না। পঙ্কজ মল্লিকের সুর অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের ভালো লেগেছিলো, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নইলে, তাঁর মতো খুঁতখুঁতে লোক এর অনুমোদন দিতেন না।