ভজন সরকার : প্রকৃতিকে ঈশ্বরজ্ঞানে দেখার প্রয়াস- এ ধারনাটি রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন বোধহয় প্রাচীন ভারতীয় দর্শন থেকে। ভারতীয় দর্শন থেকে রবীন্দ্রনাথ এটিও নিয়েছিলেন যে, সব দানেরই কিছু প্রতিদান দিতে হয়। তাই তো প্রকৃতির প্রতিও মানুষের কিছু কর্তব্য ও দায়িত্ব থাকে। একজন সংগীত রচয়িতা হিসেবে তাই রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির উদ্দেশ্যে প্রতিদান গানের মাধ্যমেই হবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
যখন রবীন্দ্রনাথ বলেন, “আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে”, তখন রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি- নৈবেদ্য যে গানের মাধ্যমে সেটি বোঝা যায়।

গীতবিতানের প্রকৃতি পর্যায়ের বসন্ত ঋতুর এ গানটির ক’টি গান পরেই আরেকটি গান আছে,
“বাকি আমি রাখব না কিছুই,
তোমার চলার পথে পথে ছেয়ে দেব ভুঁই”।
এ গানটির সঞ্চারী ও আভোগে রবীন্দ্রনাথ এ কথাটি আরও স্পষ্ট করেছেন,
“দখিন-সাগর পার হয়ে যে এলে পথিক তুমি
আমার সকল দেব অতিথিরে আমি বনভ‚মি।
আমার কুলায়-ভরা রয়েছে গান সব তোমারে করেছি দান
দেবার কাঙাল করে আমায় চরণ যখন ছুঁই”।

রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-আচরণ অনুসরণকে “অনন্তকাল বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের সংগে শিশুর মতো আচরণ করা” হিসেবেই মনে করেছেন।
এ কথাটি সংগীতের ক্ষেত্রেও খুব প্রযোজ্য ব’লেই মনে হয়। তাই তো গানের কথায় অব্যক্ত বাণীর অনুরণন যেমন থাকতে হয়, তেমনি থাকতে হয় বিমূর্ত ভাবনার প্রচ্ছন্নতাও। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ গানেই তেমনটি আছে। আর সে জন্যেই একই গান জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এসে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নিয়ে ব্যক্তি মানুষকে নাড়িয়ে দেয়।
যে গানটি প্রথম যৌবনে প্রেমের পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল, হয়ত মধ্য বয়সে কিংবা জীবন সায়াহ্নে এসে সেই গানটিই অন্য ভাব ও ভাবনায় মনকে উদ্বেলিত করে। এই যে “আকুলতার বিচিত্রতা’ সেটিই বোধ হয় গানের, বিশেষকরে রবীন্দ্রনাথের গানের “প্রাণের ভোমরা”।

আবার দেখা যায়, একই শিল্পীর কন্ঠে একই গান সময় ও মানসিক অবস্থার হেরফেরে সম্পূর্ণ বিপরীত দ্যোতনায় ধরা দিচ্ছে। সমস্ত মহৎ সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যই মনে হয় এটা। আর রবীন্দ্রনাথের গান যে তাঁর মহৎ সৃষ্টি সম্ভারের মধ্যে মহত্তম সেটি নতুন করে বলার অবকাশ আছে কি?
একটি গানের কথাই বলি, যে গানটি বছরের পর বছর শুনছি,
“সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা
অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশহারা”।

শ্রাবণের এক রাতে চারিদিক অন্ধকার করে নামা বৃষ্টির ধারাপাতে বিরহী মনের আকুলতা হিসেবেই মনে হয়েছে এ গানটিকে। গানটিকে রবীন্দ্রনাথ গীতবিতানে বর্ষা প্রকৃতির গান হিসেবে স্থান দিয়েছেন যথার্থভাবেই।
অথচ দিন যতো বাড়ছে, গানটির অর্থও বদলে যাচ্ছে। বিশেষকরে গানটির রচনাকাল জানার পরে কেনো জানি মনে হয়েছে , এ গানটি শুধুই কি শ্রাবণধারার সাথে একাকী মনের সংযুক্তি? মৃত্যুর মাত্র বছর দুই আগে ৭৮ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন গানটি। জীবন দীর্ঘ হলেও এ সময়ের অনেক রচনায় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু চিন্তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এই গানের কোথাও কি সে মৃত্যুভাবনা একবারও আভাস পায়নি?

সঞ্চারীতে যখন রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
“অশত্থপল্লবে বৃষ্টি ঝরিয়া মর্মরশব্দে
নিশীথের অনিদ্রা দেয় যে ভরিয়া।”
বেশ অনেকবার “নিশীথের অনিদ্রা” শব্দ দু’টো পড়ার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি এর নিগূঢ? অর্থ-ব্যবচ্ছেদেরও। জীবন সায়াহ্নের এক ঝুবুথুবু প্রতিচ্ছবি মাঝে মাঝে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আভোগে এসে সেই ছবিটি যেন স্পষ্ট থেকে ষ্পষ্টতর হয়েছে এভাবে,
“মায়ালোক হতে ছায়াতরণী
ভাসায় স্বপ্নপারাবারে
নাহি তার কিনারা”।

জানি না, এটাই মৃত্যুর বর্ণনা কিনা? তবে চিরদিনের জন্যে চলে যাওয়া তো কিনারাহীন স্বপ্নপারাবারে চিরদিনের জন্য ভেসে যাওয়াই, নয় কি?
অথচ এমন করে গানটির ভাব ও ভাবনার ব্যবচ্ছেদ আগে কোনোদিন করার চিন্তাই করিনি।

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা।)