ইউসুফ কামাল : বিদেশে স্থায়ী হতে, নিজের জীবনকে প্রস্ফুটিত করতে মানুষ যে কত হরেক রকম পথ বেছে নেয় সেটা হিউষ্টনের সুমনের সাথে পরিচয়ের হবার পর আমি কিছুটা বুঝলাম। ওর মতো আরো হাজারো সুমনের জীবনের কাহিনী মোটামুটি একই ছকে গাঁথা। কিন্তু বিক্রমপুরের ছেলে সুমনের বেলায় বিষয়টা ভিন্নতর হয়ে গেলো যা হবার কথা ছিলো না। সুমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আমেরিকার উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছিল বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে। স্বপ্নের দেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, ভালোভাবে বেঁচে থাকতে। প্রায় ত্রিশ বছর আগে ট্যুরিষ্ট ভিসা নিয়ে এ দেশে ঢুকে কিছুদিন পর বুঝলো অবৈধভাবে এ দেশে বেঁচে থাকা যাবে না, স্থায়ী হওয়া তো যাবেই না। হয় দেশে ফিরে যেতে হবে না হয় বিকল্প পথ বেছে নিতে হবে। এ দেশে নিজের নাগরিকত্বের অংশীদার করে, জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম না। খুলে বলতে গেলে – এ দেশীয় কোনো নাগরিককের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে (কোর্টের মাধ্যমে) খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে নাগরিকত্ব লাভ করা যায়। এটা সহজ পথ তবে সুমনের জন্য সুবিধামতো পাত্রী পাওয়া যাচ্ছিলো না।

সুমন বুঝে ফেল্লো, ভালো ও স্থায়ী কিছু না করতে পারলে এদেশে কোনো ভালো পাত্রী পাওয়া সম্ভব নয়। সে এখন নিজেই নিজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাই যা করার নিজেকেই করতে হবে। নিজের দেশের কোন বাঙালি পাত্রী পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে সে দেশে ফেরার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেল্লো। অবৈধভাবে বাস করে এখানে কোন কাজ পাওয়া যেমন সহজ নয় তবে কোথাও কোন কাজ পেলেও তার জন্য পারিশ্রমিকও অনেক কম। এ দেশে সবাই কাজ করে খায়, অবৈধ অধিবাসীদের বেতন কম এ জন্য কোন উচ্চবাচ্য করে লাভ হয় না তাতে বরং কাজ খোয়ানোর সম্ভাবনাই বেশি থাকে। আগে থেকেই শুনে আসছিলো বড় সংখ্যার একটা অর্থের বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক বিয়ের কথা। অল্প বেতনে নিউইয়র্কের ‘সেভেন ইলেভেন’ এ কাজ করার সময় ব্রাজিলিয়ান বংশদ্ভুত মার্থার সন্ধান পায় সুমন তারই এক সহকর্মির মাধ্যমে। মার্থা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সুমনকে সাময়িক বিয়ে করতে রাজী হয়। এমনি হাজারো মার্থা এদেশে আছে যারা শুধু কাগজে কলমে স্ত্রী সাজে অর্থের বিনিময়ে। অন্য কোনো উপায় না দেখে সুমন তার সঞ্চয়ের অর্থ ছাড়াও ধার দেনা করে টাকার ব্যাবস্থা করে। সমুদয় অর্থ দিয়ে কোর্টের মাধ্যমে মার্থাকে বিয়ে করে। বিয়ে শুধু কাগজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, আর বিয়ের কাগজের মাধ্যমেই সে কয়েক মাস পর এ দেশের বৈধ নাগরিকত্ব লাভ করে। মার্থার সাথে সামনাসামনি দেখা হয়েছিলো মাত্র দু’দিন তাও নোটারী পাবলিকের অফিসে। দেখতে শুনতে ভালোই লেগেছিলো মার্থাকে সুমনের। নাগরিকত্ব পাওয়ার পর চুক্তি অনুযায়ী, উভয়ের সুবিধা মতো সময়ে দু’জনের ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়। উদার গণতান্তিক দেশ আমেরিকা, কেউ কারো ব্যাক্তিগত বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করে না। কে কাকে বিয়ে করবে অথবা কে কাকে ডিভোর্স দেবে এটা নিতান্তই যার যার ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। নাগরিকত্বের কাগজ পাওয়ার পর সুমনের মনে হয়েছিলো সে যেনো আকাশের তারা হাতে পেয়েছে। নতুন উদ্যমে চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে শুরু করে দেয়।

মাস খানেকের মধ্যে ‘ব্যাংক অব আমেরিকায়’ ইন্টারভিউ দিয়ে চাকুরী পেয়ে যায়। তারপর থেকে সুমনকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, বাড়ি গাড়ি সব কিছুই এখন তার হাতের মুঠোয়। মনে মনে সুমন মার্থার উপর অনেকখানি কৃতজ্ঞ, এটা সে অকপটে স্বীকারও করে। হাসতে হাসতে একদিন সুমনকে জিজ্ঞাস করেছিলাম, মার্থার সাথে আর পরে দেখা হয়নি তোমার? হেসে সুমন বল্লো, দেখা হবে না কেন? নিউইয়র্ক গেলে দেখা হয়। ও তো এখন আমার একজন ভালো বন্ধু। টেলিফোনে কথা তো মাঝে মাঝেই হয়।

নাগরিকত্বের কাগজ হাতে পাবার পর আমি নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে এসেছিলাম টেক্সাসের হিউষ্টনে। আর মার্থা ওখানেই রয়ে গেছে। চাকুরী করে ‘নোভা’-তে। আমার চুক্তির বরখেলাপও করেনি, যেমন কথা হয়েছিলো তার থেকে এক চুলও সরেনি। সময় মতো মার্থাই ফোন করে সুমনকে মনে করিয়ে দিয়েছিলো ডিভোর্সের কথা। সুমন বল্লো, মাঝে মাঝে ফোনে কথাবার্তা হয়, আমার কুশলাদি জানতে চায়। এত বড় একটা ঘটনা আমাদের মধ্যে ঘটে গেছে ওর সহজ ব্যবহারে সেটা কখনই মনে হয়নি। খুব ভালো একজন বন্ধুর মতো ও আমার কাছে সহজ হয়ে গেছে। আচমকা একদিন বলে বসলো, বিয়ের সময় ও যে টাকাটা নিয়েছিলো সেটা এখন আমাকে ধীরে ধীরে ফেরত দিতে চায়। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সুমনকে বল্লাম, এ তো দেখি সিনেমার গল্পকেও হার মানায়, বলো কি! সুমন বল্লো, হ্যাঁ আসলেই মার্থার মন মানসিকতা খুবই ভালো। অবাক হয়ে বলেছিলাম, টাকা ফেরত দেবে কেন? ওটা তো তোমার টাকা। আর আমিই বা সেই টাকা ফেরত নেব কেনো। মার্থা বলেছিলো আমি একা মানুষ আমার এত টাকার দরকার কি? যখন নিয়েছিলাম সে সময় টাকার খুব প্রয়োজন ছিলো। তবে সেটা আমার নিজের জন্য নয়, অন্য কারো জন্য। কিন্তু তোমার সাথে কথা বলে বুঝেছিলাম, তুমি ভীষণ একটা বিপদে পড়েছো। আর আমি কিনা তোমার সেই বিপদের উপর ফায়দা লুটে নেওয়ার অপচেষ্টা করছি? এখন আমি যে চাকুরী করি তা দিয়ে আমার বেশ ভালো মতো চলে যায়। কিছু কিছু সঞ্চয়ও করতে পারছি। তোমাকে সাহায্য করতে পেরেছি এতে আমি অনেক খুশী, এখন আমাকে তুমি ভার মুক্ত করো। ইদানীং আমার মনে হয় টাকাটা নিয়ে আমি ভ‚ল করেছিলাম, একটা অপরাধ বোধ আমাকে সার্বক্ষণিকভাবে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

আমি সুমনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। ওর কথা শেষে বল্লাম, তাহলে মার্থা টাকার বিনিময়ে বিয়েতে রাজী হয়েছিলো কেন? বল্লাম, মার্থা কি তবে বিয়ে করে সংসারী হয়নি? তুমি যে বল্লে তোমার সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়, এ বিষয়ে কি কথা হয়নি? ও বলেছিলো, টাকাটা মার্থা ওর বিশ্বস্ত বিশেষ এক বন্ধুকে দিয়েছিলো ব্যবসা করার জন্য। কথা ছিলো ব্যবসা শুরু করেই ওরা বিয়ে করে ফেলবে। কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম তাহলে কি মার্থার বিয়ে হয়নি? সুমন ঘাড় নাড়লো তাতে বোঝা গেলো, বিয়েটা হয়নি। সুমন জানালো টাকাটা হাতে পেয়ে ওর সেই বিশেষ বন্ধু উধাও হয়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও মার্থা ওর সেই বিশেষ বন্ধুর আর কোন সন্ধান পায়নি। অতিরিক্ত বিশ্বাস করাই যে চরম ভ‚ল হয়েছে সেটা মার্থা মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছে। মার্থা শুধু বলেছিলো টাকার কাছে প্রেম-ভালোবাসার কি কোনোই মূল্য নাই? কত স্বপ্ন দেখেছিলাম দু’জনে, সামান্য টাকাটাই সব কিছু হলো। এখন মনে হয় যা হবার ভালোই হয়েছে। অত লোভী মানুষ আমার জীবন থেকে সরে গেছে আমি বেঁচে গেছি। পাহাড়সহ দুঃখ আর অবিশ্বাস মাথায় নিয়ে মার্থা ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার নতুন করে কাজে মন দিয়েছিলো। আলাপ চারিতায় বুঝেছিলাম সুমন এখনও সপ্তহান্তে এক/দুই বার মার্থার সাথে টেলিফোনে কথা বলে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, রাজবাড়ী, বাংলাদেশ