ইউসুফ কামাল : উর্মিলার সাথে কথা শেষ করে ওর বাসা থেকে বের হয়ে গাড়ীতে উঠে ভাবলাম, কোথায় যাবো?

মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম উর্মিলা বিদায় জানিয়ে এখনো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ী ষ্টার্ট দিয়ে ওর বাসা থেকে বেরিয়ে রেইনট্রি ফরেস্ট রোড এর মাথায় এসে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম, চিন্তা করলাম বাসায় ফিরে যাওয়ার আগে অন্য কোথাও ঘুরে যাওয়া যায় কিনা? মনে পড়লো বাসার গ্রোসারীর দরকার, দরকারী কিছু জিনিষ কিনতে হবে সেই সাথে কিছুটা সময়ও কাটানো যাবে। মনটা একটু শান্ত করা দরকার, মনে হলো মাথাটা ঠিক মতো কাজ করছে না। উর্মিলার কিছু কথায় বেশ বিচলিত বোধ করছিলাম। ওর কথার কি উত্তর দেব, অবশ্য সে কোন রকম উত্তরও আমার কাছে চায়নি। আর এ সবের উত্তরও আমার জানা নেই। সমস্যাটা আমার কাছে জটিল বলেই মনে হয়েছে, যে কারণে ওর অনেক কথারই জবাব দিতে পারিনি। তা ছাড়া ও তো কোন প্রশ্নও করেনি শুধুই নিজের বর্তমান অবস্থানটা জানিয়েছে, সমাধানের বিষয়েও আলাপের মধ্যে আনেনি।

মনে হয়েছে আমাকে ওর কাছের লোক মনে করে কষ্টের কথাটা বলেই হয়তো মনটাকে হাল্কা করতে চেষ্টা করেছে। কষ্টের কথা আপন মানুষের কাছে বল্লে মন হাল্কা হয় হয়তো তাই আমাকে ডেকে এনে মনের কথা বলতে চেয়েছে। সেদিন দর্শনার উদ্দেশ্যে কুষ্টিয়া ষ্টেশন থেকে যশোরগামী ট্রেনে দেশ ছেড়েছিলাম, ট্রেনের যাত্রীর বেশীর ভাগই ভারত অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছে। প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে উর্মিলা ওর বাবা মা-কে হারিয়ে ফেলেছিলো। কান্নারত অবস্থায় উর্মিলাকে ঐ অবস্থায় দেখে ওর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে ওর বাবা-মাকে খুঁজে তাদের হাতে বুঝিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়েছিলাম। উর্মিলারা যাচ্ছে নিজেদের নিরাপত্তার কারণে আর আমরা দেশ মাতৃকার নিরাপত্তার উদ্দেশ্য নিয়ে। লাখ লাখ মানুষ তখন দেশ ছেড়ে ভারত চলে যাচ্ছে। আমার সাথে দুই বন্ধুও ভারত যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই বাড়ী থেকে বেড়িয়েছিলাম তবে।

ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া বাবা মা’কে খুঁজে দেওয়ার জন্য ওর মধ্যে প্রচন্ড একটা কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করছিলো, যেটা ওর চোখে মুখে ফুটে উঠেছিলো। চোখের ভাষা দিয়েই ওর মনের সমস্ত কথা তখন আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো, যা তখন বুঝতে আমার মোটেও বেগ পেতে হয়নি। দর্শনা নেমে পায়ে হেঁটে ভারতের সীমান্তবর্তী রেলওয়ে ষ্টেশন গেদে’র দিকে রওনা হয়েছিলাম দুই বন্ধুর সাথে। সামান্য দূর তাই সবাই পরিতাক্ত রেললাইন এর রাস্তা ধরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে পায়ে হেঁটে ছুটে চলেছে।

আগে এ পথে রেল চলাচল ছিলো, সম্ভবত ‘৬৫ এর পরে বাংলাদেশের সাথে রেল যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় রেলওয়ে লাইন তুলে ফেলা হয়েছিলো। দীর্ঘ লাইন দিয়ে সারি সারি মানুষের সাথে আমরা তিন বন্ধু এক নব জীবনের ব্রত নিয়ে হেঁটে ‘গেদে’ ষ্টেশনে যেয়ে পৌঁছলাম। গেদে ভারত সীমান্তবর্তী ছোট খাটো একটা রেলওয়ে ষ্টেশন, বাংলাদেশীদের ভীড়ে তখন ঠাসা। দেশ ত্যাগী মানুষের ভীড়ে হাঁটা চলাই দায়। একই ভাবে উর্মিলা ওর বাবা মা’র সাথেই হেঁটে ভারতের গেদে ষ্টেশনে যেয়ে পৌঁছালো। মাঝে মাঝে তাকিয়ে খুঁজতেও দেখলাম আমরা কাছাকাছি আছি কিনা? অপরিচিত স্থানে নিজের নিরাপত্তার জন্য মানুষ নিজস্ব মানুষকে যেমনি করে খুঁজে ফেরে, উর্মিলাও হয়তো তেমনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলো। আমাদেরকে দেখতে পেয়ে সন্তুষ্টির ছাপ ওর চোখে মুখে ফুটে ওঠে, সেটাও আমার চোখ এড়াতে পারেনি। সব সময় কাছাকাছিই থাকতাম, বলা তো যায় না হঠাৎ করে কোন ঝামেলাও হতে পারে। শুনেছিলাম কোন কোন এলাকার গ্রামবাসী সংঘবদ্ধভাবে ভারতগামী অনেক পরিবারের সব কিছু কেড়ে নিয়ে অসহায় মানুষগুলোকে নিঃস্ব সর্বশান্ত করে দিচ্ছে।

সেটাই উর্মিলার সাথে আমার শেষ দেখা-পরবর্তিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কুষ্টিয়া মোহিনী মিল এলাকায় তন্ন করে খুঁজেও ওদেরকে আর পাইনি। যুদ্ধের পর অনেক পরিবারের মতো উর্মিলার পরিবারও আর ফিরে আসেনি মাতৃভ‚মিতে, রেখে গেছে পৈত্রিক সম্পত্তি, ভিটাবাড়ীসহ আরো নানা রকম মূল্যবান দ্রব্যাদি। আসলে মানুষের জীবনটাই সব, জীবনের মূল্যের কাছে ঘর বাড়ী সহায় সম্পত্তি সব কিছুই গৌণ। বেঁচে থাকার জন্যই এ গুলোর প্রয়োজন, জীবনের বিনিময়ে অবশ্যই নয়। জীবনটাই আসল। বেঁচে থাকলে দেখা হবে-বলে বিদায় নিয়ে আমরা ধরেছিলাম ভিন্ন পথ আর উর্মিলা ওর বাবা মা’র সাথে চলে গেল ভিন্ন পথে, ওর মামা’র বাড়ী নৈহাটির উদ্দ্যেশ্যে। আপাতত: ওখানেই ওদের নিরাপদ আশ্রয়। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে মনের মধ্যে নতুন একটা শূন্যতা বোধ যেন কাজ করলো। মুখের ভাষা যেখানে স্তদ্ধ চোখের ভাষাই যেন সেখানে স্থান করে নেয়-উর্মিলার চাহনিতেই সেদিন সেই ভাষারই প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম।

আর তারপরের ঘটনা –
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশ মাতৃকার মুক্তির অংগীকারে ঝাঁপিয়ে পড়া হাজারো মানুষের সাথে একাত্ম ঘোষণা করে হাত মেলালাম ‘হয় মৃত্যু না হয় বিজয়ের মালা’র স্বপ্নে।
আমার সাথী বন্ধুর বড় ভাই তখন প্রবাসী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা, উনারই নির্দেশ মতো দেরাদুনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম তিন দিনের মাথায়। বাম দিকে ঘুরে ওয়ালমার্টের গ্রোসারি শপে যাওয়াটাই মনস্থির করলাম। পর পর কয়েকদিন হাসপাতালে রেডিয়েশন এর জন্য ব্যাস্ত থাকার কারণে বাজার সংক্রান্ত বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারিনি। চাল, রোটেলা ব্রান্ড এর তিন প্যাকেট রুটি, দুই কেস ডিম পাউরুটি চীজ পাঁচ লিটার সানফ্লাওয়ার ভেজিটেবল ওয়েল হ্যান্ড ট্রলি তে তুলে নিয়ে পুরো ষ্টোরটা অকারণে একবার ঘুরলাম। আসলে কেন যে ঘুরলাম নিজেও জানি না, হয়তো কি করবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। ও খান থেকে বের হতেই দেখি সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই, এতক্ষণ সময়ের কথা মনে হয়নি। ঘড়ি উল্টিয়ে দেখলাম ঘড়ির কাটা আট’টা পেরিয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই।

গ্রোসারি ভর্তি হ্যান্ড ট্রলিটা গাড়ির কাছে নিয়ে গাড়ীর ব্যাক ডালায় সব কিছু তুলে ট্রলিটা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসতে আসতে মনে পড়লো উর্মিলার কথা, প্রায় দশ বছর সংসার করার আগে টানা দুই বছর ধরে ওরা প্রেম করেছে। এতটা সুদীর্ঘ সময়ের একটা সম্পর্ক এমনি করে ভেংগে যাবে? কেন এমন হলো? কোন অন্তর্নিহিত কারণ আছে কি? বুঝতে পারলাম না। উর্মিলা হাসপাতালে ভালো বেতনের চাকরী করে, সংসারে অস্বচ্ছলতার কোন কারণ থাকার কথা নয়। ওর একার আয়েই তো ভালো মতো সংসার চলার কথা, তাহলে ওদের ভিতরে সম্পর্কের ফাটলটা কেন ধরলো? কি কারণে সন্তান সন্ততিসহ স্ত্রী-কে অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে অনিমেষ চলে গিয়েছে নিউইয়র্ক তা বুঝতে পারিনি। কোন অন্ধ মোহের টানে দূরে সরে গেছে নিজের ঔরসজাত সন্তান সন্ততি আর ভালোবেসে বিয়ে করা স্ত্রীকে দূরে ঠেলে দিয়ে। আমি উপযাচক হয়ে বিষয়টা জানতেও চাইনি, না জানি ও কি মনে করে? ও যখন নিজের থেকেই সব কিছু বলছে তাই প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করলাম। ওর কথার মধ্যে মনে হলো না ওদের মধ্যে পুরো পুরি ডিভোর্সও হয়েছে।

আমেরিকায় বৈবাহিক পরবর্তি জটিলতার অনেক রকম শাস্তির বিধান আছে যা মানা খুবই কষ্টকর। আর উর্মিলা নিজে সেই আইনের শরণাপন্ন হয়েছে কিনা সেটাও ওঁকে জিজ্ঞাস করা হয়নি। সম্ভবত সে ঐ পথে হাঁটেনি, আর তেমন কিছু হলে তো সে অবশ্যই আমাকে বলতো।
হয়তো অভিমান করেই সে আর অবিনাশের সাথে যোগাযোগ করেনি, ভেবেছে তার নিজের জন্য না হোক সন্তানদের জন্য ও কি কোন রকম মায়া নেই তার? এদের জন্মদাতা তো সেই, কোন রকম কর্তব্যের কথা কি অবিনাশের কখনোই মনে হয় না? প্রথম দিকে ভাবতো সহসাই ফিরে আসবে কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে তার ধৈর্য্যের বাধ যেন ভেংগে যাচ্ছে।

দেরাদুন ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরে অনুভব করেছিলাম আগের থেকে অনেক বেশী দায়িত্ব বোধ যেন কাঁধে সওয়ার হয়েছে, মানুষের উষ্ণ অভ্যর্থনা আর ভালোবাসা নিয়ে স্থানীয় ভাবে দেশের মংগলের জন্য যতটুকু সম্ভব ভালো কিছু করতে চেষ্টা করেছি। দেশ মাতৃকার সেবা করতে যেয়ে মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধের নমুনা আমাকে নতুন করে দেশকে ভালো বাসতে শিখিয়েছে। গরীব মানুষেরা পর্যন্ত নিজেদের খাবার আমাদের পাতে তুলে দিয়েছে, সব কিছুর মধ্যে ছিলো তাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা। দেশ স্বাধীন হলো আবার ফিরে গেলাম শিক্ষার জগতে, উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সদ্য স্বাধীন দেশে চারিদিকে অস্ত্রের ঝনঝনানি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আঞ্চলিকতার প্রভাব বিস্তারে মারামারি আর আক্রমণ প্রতি আক্রমণ দেখে রাজনীতির প্রতি মাঝে মাঝে ঘৃণাবোধের সৃষ্টি হতো।

বড় বড় নেতাদের নিজস্ব দ্বন্দের কারণে অনেক স্থানে চলছিলো ভয়াবহ ধরনের অস্ত্রের ব্যাবহার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রাশ ফায়ারে প্রাণ দিতে হলো তরতাজা কতগুলো প্রাণকে। উপরন্ত নানা রকমের রাজনৈতিক হানাহানি, সামান্য কয়েক দিনেই মানুষ যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। কেউ কিছু বলতেও পারছে না আবার কিছু করতেও পারছে না, এমনি এক শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশে কাটাতে হয়েছে সুদীর্ঘ চারটি বছর। দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার পর জাতি যুদ্ধ করে জাতিকে মুক্ত করার পরও কেন এমন নৈরাজ্য আর অশান্তি!! (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ ভার্জিনিয়া, ইউএসএ