ইউসুফ কামাল : পরিবর্তিত আবহাওয়ার কারণে প্রথম বার আমেরিকায় আসার পর সকালে হাঁটাহাঁটি করতে বেশ ভয় পাচ্ছিলাম, তাই দু’তিন দিন পর হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রসংগ হলো অসহনীয় শীতে নিজেকে প্রথমে সহনীয় করে তোলা। দুই দিন দুপুরের দিকে মেয়ে আমাকে নিয়ে শপিং এ বেরিয়েছিলো। ‘কোলস্’ থেকে শীতের সোয়েটার, জ্যাকেট, পরে পাশের আউট লেটে ‘নাইক’ এর শো রুম থেকে একটা কেডস্ কিনলাম। সেই সাথে ‘রেডস্কিনের’ উলের টুপি আর চামড়ার একটা গ্লোভস্ কিনে নিজে শীত কে প্রতিহত করার পুরো পুরি ব্যবস্থা সেরে ফেল্লাম। এ দেশে যেমন শীতের প্রকোপ আছে তেমনি সেটা প্রতিহত করার সব রকম সরঞ্জামাদিও এখানে হাতের নাগালের মধ্যেই পাওয়া যায়। এ দেশে মোটামুটি মাসিক আয়ের নিশ্চিত একটা ব্যবস্থা থাকলে ব্যাংকের একটা ক্রেডিট কার্ড আর আয় বুঝে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ব্যংকে জমা দিয়ে মাসিক কিস্তিতে বাড়ীর মালিক হওয়া যায়।

আর এটা হলেই মানুষ যন্ত্রের মতো ছয়টা চারটে অফিস করতে থাকে আর লিজে নেওয়া গাড়ীর টাকা আর বাড়ীর মর্টগেজের টাকা পরিশোধ করতে থাকে। সুবিধার মধ্যে এখানে মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে উন্নত পরিবেশে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার সাথে সাথে সন্তান সন্তানাদির লেখাপড়া শেষ করে আমেরিকার নাগরিক হয়ে গড়ে ওঠতে পারে। মূল আমেরিকানদের তাদের জন্মগত সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা জনিত সুবিধার কারণে নিম্ন শ্রেণীর কাজ করতে হয় না। আর সেই ধরনের কাজ করার মতো মানুষ এশিয়া, আফ্রিকা, মেক্সিকো, পেরু, এল সালভাদোরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসে ভীড় জমায়। সেই কারনেই ডাইভারসিফিকেশন ভিসা (ডিভি ভিসা) দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এরা মানুষ নিয়ে আসে। নিজের স্বার্থের কারণেই মানুষ নিজ দেশ থেকে পরবাসী হয়ে এ দেশের অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতে সহায়তাই করে।

সেদিন মেয়ের সাথে শপিং করে বাসায় ঢোকার সময় প্রতিবেশী বারবারা’র সাথে মুখামুখি দেখা হয়ে গেলো, সে গাড়ী থেকে নেমে বাসায় ঢুকছে আমাদেরকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। একটু ক্লান্ত মনে হলো, এগিয়ে যেয়ে আমার মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, হাসপাতাল থেকে ফিরলে নাকি? বারবারা হাল্কা হাসি দিয়ে বল্লো, কি আর করি বলো বেঁচে থাকতে হলে তো ডায়ালাইসিস করতেই হবে। যে কটা দিন বাঁচবো এ ভাবেই চালিয়ে যেতে হবে। হাসিটা প্রথম দিনের চেয়ে অনেক খানি ¤øান মনে হলো। আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েকে বল্লো, বাবার সাথে ঘোরাঘুরি করছো? মেয়ে বল্লো, এই কাছাকাছি দিয়ে, দূরে এখনো যাইনি তবে যাবো। বাবা কিছু দিন থাকবেন তো, সময় করে যাবো ক্ষন। আমাকে বল্লো, কেমন লাগছে এই দেশ। বল্লাম, যত ভালো লাগবে মনে করেছিলাম তত ভালো না। সবাই শুধু দৌড়া দৌড়াতেই ব্যাস্ত। এত ব্যস্ত মানুষ, আমি তো আগে চিন্তাই করতে পারি নাই এ দেশে মানুষ এত পরিশ্রম করে? বারবারা হেসে আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বল্লো, বিকেলে তোমরা এসো, এক সাথে কফি খাওয়া যাবে আর গল্প করা যাবে। বারবারা’র স্বামী জোসেফ আমেরিকার সেনা বাহিনীতে চাকরী করতেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষের দিকে সম্ভবত ‘৭০ সালের দিকে সেনা বাহিনীর হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ মতো সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিতে জোসেফকে কম্বোডিয়ায় পাঠানো হয়। দীর্ঘ ৩ বৎসরের মতো ভিয়েতনামের বিভিন্ন এলাকায় সে দেশের হয়ে যুদ্ধ করে। ‘৭৩ এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জোসেফ পংগু অবস্থায় দেশে ফিরে আসে। য্দ্ধুরত অবস্থায় শত্রæপক্ষের পাতা মাইনে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পা হারান বারবারার স্বামী। দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ হলেও চিরতরে পংগু হয়ে যায় সে। অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকলো না। স্বাধীনচেতা এই মানুষটা নিজের এই পংগুত্বময় জীবনের বোঝাকে পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকাটাকে মেনে নিতে পারছিলো না, বছর দু’য়েক নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে হেরে গেলেন। নিজের রিভলভার দিয়ে আত্মহত্যা করে বারবারা’কে সে ভারমুক্ত করে গেলো।

সেনাবাহিনী থেকে পাওয়া মোটা অংকের টাকা বারবারা’র আর তেমন কোন কাজেই লাগলো না। আর বড় বাড়ী রক্ষণাবেক্ষন করাটা একা বারবারা’র জন্য কষ্টকর হয়ে যাওয়ায় সেটা বিক্রী করে দিয়ে এই ছোট্ট টাউন হাউস কিনে বসবাস করছে। সুবিধা হলো এটার রক্ষণাবেক্ষন খরচ নাই বল্লেই চলে, তার একার পক্ষে এটাই যথেষ্ট। শক্ত মনের মানুষ বারবারা সমস্ত প্রতিকুল অবস্থায় অবিচল থেকে অসুস্থ শরীর নিয়ে একাই জীবন যুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে। জিজ্ঞেস করলাম, একাই থাকো এখানে? হাত দিয়ে কুকুরের দিকে ইংগিত করে হেসে বল্লো, একা কেন জিমি আছে তো! আত্মপ্রত্যয়ের ভংগীতে কথাগুলো বলে গেলো বারবারা। সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস করা, এক দিন গ্রোসারী ষ্টোরে যাই আর সান ডে গীর্জায় যাই। দু’সপ্তাহ পর পর লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়ি, সময় কেটে যায়। ছোট্ট তিন বেডরুমের বাসা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছ বারবারা। সেনা বাহিনীর কিছু সার্টিফিকেট, কিছু খেলাধুলার মেডেল দিয়ে ঘর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সবই জোসেফের চাকরী জীবনের স্মৃতি। কথার মধ্যে এক ফাঁকে জানতে চাইলাম, তোমার ছেলে যেন কোথায় থাকে? এখানে আসে না? বারবারা বল্লো, ও তো নিউজার্সীতে এক আইটি ফার্মে কাজ করে। বছরে এক বার পরিবারসহ এখানে বেড়াতে আসে, অবশ্য এই বার আসতে পারে নাই। সপ্তাহে সপ্তাহে আমার খবর নেয়।

আমার শরীর তো ভালো না, আমি যেতে পারি না। (চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেলসিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ