ইউসুফ কামাল : টরেন্টো থেকে সারা রাত বাস চালিয়ে ড্রাইভার আমাদেরকে ওয়াশিংটন ডিসির গ্রেহাউন্ডের বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দিলো। যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা একটা রেন্ট কার এর কাছে দাঁড়াতেই ড্রাইভার গাড়ী থেকে নেমে এলো। আসার সময় টরেন্টোয় বাস থেকে নেমে পেয়েছিলাম ভারতীয় শিখ আর আমেরিকায় ফিরে এসে পেলাম পাকিস্তানী ড্রাইভার, চেহারা দেখে মধ্য বয়স্ক মনে হলো। স্প্রীংফিল্ডের কথা বলতে ড্রাইভার সম্মতি জানিয়ে গাড়ীর পিছনের ডালা খুলে লাগেজ তুলে নিলো। গাড়িতে উঠে বসে ইংরেজীতে জানতে চাইলো আমি কি কানাডা থেকে আসছি কি না? পেশাদার ড্রাইভার কাজের কথা ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কথা কখনোই বলে না, তবে কানাডা থেকে আসছি শুনেই বোধ হয় তার কানাডা প্রীতি আর চেপে রাখতে পারলো না। ওদেশের বেশ খোঁজখবর রাখে বুঝলাম, কথার ফাঁকে জানতে চাইলাম, সে ও দেশে গেছেন কিনা? ড্রাইভার হাসি দিয়ে বল্লো, গেছি দুই বার, ওখানে আমার খুব কাছের এক বন্ধু থাকে। ও দেশের সরকারী নিয়মনীতি সব সময় সাধারণ মানুষের পক্ষে, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষদের জন্য বয়স্ক ভাতা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই ভালো। সকাল বেলা ওয়াশিংটনে ঢোকার গাড়ীর সংখ্যা বেশি থাকে, বের হবার চাপ বেশ কম। তাই সহজেই টোল রাস্তা দিয়ে পার হয়ে নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই বাসায় পৌঁছে গেলাম। ট্যাক্সির ভাড়া বের করার আগেই ড্রাইভার গাড়ী থেকে লাগেজ নামিয়ে দিলো। লাগেজ হাতে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে যেয়ে ডান দিকে বারবারা’র বাসার দিকে নজর পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। দরজা বন্ধ, কানাডা যাওয়ার সময় তো দেখেছিলাম বারবারা’কে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালের যেতে। তারপর আর কোন খবরই তো পাইনি তা হলে কি এখনো হাসপাতালেই আছেন! একে তো বয়স্ক মানুষ তার উপর একা একা থাকেন, কেমন আছেন কে জানে? খবরটা জানতে মনে থেকে বেশ তাগিদ অনুভব করলাম, পরে ভাবলাম এত সকালে হয়তো ঘুম ভাংগেনি। আগে বাসায় যাই পরে না হয় খবর নেওয়া যাবে। সারা রাত বাস জার্নির জন্য আমি নিজেও ঘুমাতে পারিনি, সব জার্নিতেই আমার ঘুমের খুব সমস্যা হয়। অগত্যা আমার মেয়ের বাসার দিকে অগ্রসর হলাম। কলিং বেলের শব্দে মেয়ে এসে দরোজা খুলে দিয়ে হেসে বল্লো, তা হলে আমাদের কথা মনে ছিলো, আমরা তো মনে করেছি বন্ধুকে পেয়ে আমাদেরকে ভুলেই গেছো। লাগেজটা রুমে রেখে ঐ ভাবেই শুয়ে পড়লাম।

মেয়ে বুঝতে পেরে আর ডাকাডাকি করলো না বুঝলো অনিদ্রা আর ক্লান্তির জন্যই এই অবস্থা, একটা ঘুম দিলেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে। দুপুরের খাওয়ার সময় মেয়ে আমাকে ডেকে তুল্লো, গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসে জানতে পারলাম বারবারা’র অসুস্থতার সংবাদ। মেয়ে বল্লো, সেবার দুইদিন পরেই ফিরে এসেছিলেন কিন্তু বাসায় দুই দিন পর আবারও অসুস্থ হওয়ায় আবার তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিলো। শরীরের অবস্থা ভালো না ডাক্তাররা খুব একটা আশাবাদী না। এখনো হাসপাতালেই আছেন। শরীরের অবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে ডাক্তার তাকে সার্বক্ষণিক বিশ্রামে থাকতে বলেছে।

কুকুরটাকে এনিমেল শেল্টারে পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রথম বার হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে, তারপর থেকে বারবারা মন খারাপ করে সময় কাটাচ্ছেন। কুকুরটা সাথে থাকলে ওটাকে নিয়ে সময় কেটে যেতো একজন বন্ধুর মতো। ঘন ঘন হাসপাতালে যাওয়ার কারণে কুকুরের যত্ন ঠিক মতো নেওয়া হবে না সেটা বারবারা বুঝতে পেরেই মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুনে আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেলো, কিডনী ডায়ালাইসিস রোগীর সার্বক্ষণিক সেবা দরকার। সেদিক থেকে বারবারা’র জন্য বেশি সমস্যা হলো তাকে একা থাকতে হয়, জরুরি প্রয়োজনে এম্বুলেন্সের এর জন্য ফোন করার জন্যও তো একটা মানুষের দরকার!

বিকেলে কফি খেয়ে একটু হাঁটতে বেরোলাম, মূল উদ্দেশ্য ছিলো যদি বারবারা’র কোন খবর পাওয়া যায় অথবা দেখা হয়ে যায়। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর বাসার কাছে আসতেই একটা এ্যাম্বুলেন্স আমাকে পাশ কাটিয়ে বারবারা’র বাসার সামনে এসে থামলো। কাছে আসতেই দেখি বারবারাকে নার্সরা এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাসার দরজার সামনে নিয়ে গেলো। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেয়ে বারবারা’র পাশে দাঁড়ালাম। মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম এই কয়েক দিনের মধ্যে যেন অনেক খানি শুকিয়ে গেছেন। বৃদ্ধ এই মানুষটাকে দেখে আমার খুব মায়া লাগলো, মাথা ঘুরিয়ে পাশে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুকনো একটা হাসি দিলেন। খুব ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কবে ফিরেছেন কানাডা থেকে? বারবারা’র কথায় হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম উনার দিকে, ভাবলাম আমি কানাডা গেছি সেটা উনার এখনো মনে আছে- বল্লাম, আজই সকালে। এসেই আপনাকে খুঁজেছিলাম, পাইনি। বারবারা’র কথায় কিছুটা আবেগ তাড়িত হয়ে পড়লাম।

আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনলেন, মৃদু মাথা নাড়লেন বল্লেন, কাল সকালে আসবেন কথা বলবো। আজকে শরীরটা খুব দুর্বল কথা বলতে পারবো না, কিছু মনে করবেন না। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর ধীর পদক্ষেপে ছোট্ট ব্যাগ থেকে চাবি বের করে ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। নার্স হুইল চেয়ারটা নিয়ে ফিরে চলে গেলো। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, দেখলাম বারবারা ঘরে ঢুকে আলো জ্বালালেন। সম্ভবত: শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মেয়েকে খুলে বল্লাম আজকের সব কথা, শুনে মন খারাপ করে আমার দিকে চেয়ে থাকলো। বল্লো, ঘরের সাথে ঘর লাগানো তবু কেউ কারো খবর রাখে না। উনার সন্তানও এলো না মায়ের এই অবস্থাতে, এগুলো দেখেও কষ্ট লাগে। কিন্তু এমনই হচ্ছে এখন সর্বত্র, বৃদ্ধ হয়ে গেলেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ মনে করে তৃপ্তি পায়। একবারও ভাবে না পিতামাতা কত কষ্টই না করে এই সন্তানের জন্য। আমারও দেশে ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো। তিন মাসের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে, ফিরে যেতে হবে দেশে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেলসিটি, ভার্জিনিয়া