ইউসুফ কামাল : মাথার মধ্যে দেশে ফিরে যাওয়ার চিন্তা নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। হ্যান্ড লাগেজের মধ্যে পাসপোর্টের মধ্যে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের এর রিটার্ন টিকেটের সাথে জরুরি কাগজপত্র ছিলো। টিকেট বের করে দেখলাম আর পাঁচ দিন পর ফিরে যেতে হবে, তার মানে হাতে আর পাঁচ দিন সময় আছে। এর মধ্যেই সমস্ত কিছু গোছগাছ করে ফেলতে হবে। মেয়েকে বল্লাম সকালে বারবারা’র সাথে দেখা করার কথা, দেখা করে আসি। বাসা থেকে বের হয়ে বারবারা’র বাসার দিকে চোখ পড়তেই দেখি উনি বারান্দার চেয়ারে বসে আছেন। শূন্য দৃষ্টি দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছেন, ধীরে ধীরে পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম তবুও খেয়াল করতে পারলেন না।

মনে হলো কোন বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তায় ব্যাস্ত, একবার ভাবলাম ফিরে যাই পরে আসবো। ঘুরে দাঁড়াতেই বোধ হয় নজর পড়লো আমার উপর বল্লেন, চলে যাচ্ছেন কেন। আসুন আমি আপনাকে খেয়ালই করিনি সেজন্য দু:খিত। একা মানুষ কত রাজ্যের চিন্তা যে আমাকে করতে হয় সেটা আপনি বুঝবেন না। বসতে বলে জানতে চাইলেন, নাস্তা করছেন? আমি কিন্তু এখনো নাস্তা করিনি। চলুন ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করি আর কথা বলি। ঘরে ঢুকেই ডান দিকে কিচেন লাগোয়া সুন্দর একটা ডাইনিং টেবিল। একজন রুচিবান মানুষের ছোঁয়া রুমের চার পাশে তাকালেই বোঝা যায়।

সুন্দর করে সাজানো গেছানো ঘর। বারবারা আমাকে বসতে বলে টোস্টারে দুই পিচ পাউরুটি ঢুকিয়ে দিলেন। অভ্যস্ত হাতে কফি বানাতে বানাতে বল্লেন, কফিতে চিনি বেশি না কম? আমি বল্লাম, আধা চামচ হলেই চলবে। তাকিয়ে দেখছিলাম বারবারা নাইফ দিয়ে বাটার লাগিয়ে এক পিচ পাউরুটি আমার সামনে দিয়ে বল্লেন, শুরু করুন কফি দিচ্ছি। বলেই নিজের জন্য আর এক পিচ পাউরুটিতে বাটার লাগাতে শুরু করলেন। দুইটা মগে কফি রেডী করে টেবিলে সামনা সামনি এসে বসলেন।

বারবারা’র বয়স হলেও একা থাকতে থাকতে এই জীবনেই পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ছক বাঁধা জীবনটাকেই যেন মানিয়ে নিয়েছেন। কফিতে চুমুক দিয়ে বল্লেন, কানাডা কেমন লাগলো? ও খানে আপনার কে আছে? বল্লাম, ওখানে আমার খুব কাছের এক বন্ধু থাকে। ভাবলাম, এত কাছেই যখন চলে এসেছি যাই একবার দেখা করে আসি। সেই কবে দেখা হয়েছে আবার কবেই বা দেখা হবে, তার ঠিক নাই। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনলেন, কোন উত্তর না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। ধীরে ধীরে বল্লেন, কাছের মানুষগুলো এক সময় অনেক দূরের মানুষ হয়ে যায়, তখন শত ইচ্ছা করলেও আর দেখার উপায় থাকে না। ভালো করেছেন দেখা করে এসে। সবাই ইচ্ছা থাকলেও পারে না।

যতক্ষণ সময় আছে সুযোগ আছে পাশাপাশি হাঁটার, কথা বলার এই সুবিধাগুলো কাজে লাগানো উচিত। হারিয়ে যাবার আগে মনপ্রাণ দিয়ে আপনজনকে যতক্ষণ কাছাকাছি রাখা ধরে রাখা যায় ততটাই মঙ্গল। বিশেষ করে নিজের রক্তের সম্পর্কিত মানুষদেরকে যতক্ষণ পারবেন নজরের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করবেন। ইদানীং আমার নিজের আপন মানুষগুলোকে দেখতে ইচ্ছে করে, বাবা মা তো অনেক দিন আগেই চলে গেছেন কিন্তু মনে মনে ভাবি আহা একবার যদি দেখতে পেতাম। কথা বলতে যেয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন, পুরনো কথা বলে মনে হলো ঐ দিনগুলোতে হারিয়ে গেলেন। আমার তো অনেকগুলো ভাই-বোন ছিলো যে কারণে বাবা আমাকে ঠিক মতো লেখাপড়া করাতে পারেন নাই, অগত্যা চাকুরী নিয়ে বিয়ে করে সংসারী হয়ে গিয়েছিলাম। ভাই-বোন কে কোথায় আছে সে খবরও ঠিক জানতাম না। এখন ওদেরকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, আমরা নয় ভাইবোনের কে কোথায় থাকে এদের খবরাখবরও তো রাখা হয়নি, এখন জীবনের শেষ সময় এসে ওদের কথা খুব মনে পড়ছে।

পিঠে পিঠি ভাই-বোনদের মধ্যে খুব মিল হয় আবার ছোট ছোট ব্যাক্তি স্বার্থ নিয়ে ঝগড়াঝাটিও হয়, সব মিলিয়ে তখন সময়গুলো একটা অম্লধুর সম্পর্কে কেটে যেতো। আমার পরের বোন সোফিয়ার কথা বেশি মনে পড়ে। ওর জন্মের সময় আমার মা মারা যান, আমার বয়স তখন বড়ো জোড় পাঁচ বছর। বাবা আবার বিয়ে করেন। আমরা বেশি ছোট ছিলাম বিধায় বাবা আমাদের দু’বোনকে চার বছরের জন্যে নানীর কাছে রেখে এসেছিলেন। মায়ের কথা মনে পড়লে কষ্টে দু’জন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্দতাম, ছোট বোনটা কিছু না বুঝেও আমার কান্না দেখে সেও কান্না শুরু করে দিতো। সেই বোনটার সাথেও দেখা হয় না অনেক দিন।

বারবারা’র কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হলো এ তো ওর একার কথা না, প্রায় সবার জীবনেরই কথা। এ যেন পড়ন্ত জীবনের অখন্ড অবসরে নিজেকে নিয়ে ডুবে থাকার শক্তি। আমার দেশে ফিরে যাবার কথা বল্লাম বারবারা’কে। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই দেশে যাবো, পরের বার এসে যেন তোমাকে আরো সুস্থ দেখতে পাই। দেশে যাওয়ার কথায় যেন একটু স্থবির হয়ে তাকালো আমার দিকে বল্লো, আপনি তো ভাগ্যবান মানুষ নিজের মাতৃভ‚মিতে যেতে পারছেন। আমি আর কোথায় যাবো! কিন্তু আমার তো আর যাওয়ার কোন জায়গা নেই। এখানেই রবার্ট ঘুমিয়ে আছে, ওঁকে এখানে রেখে আমি কোথায়ই বা আর যাবো। আমারতো যাবার কোন জায়গা নেই।

আমি তাকিয়ে রইলাম বারবারা’র দিকে, ওর চোখ ছলছল করছে। শক্ত মানুষটার চোখে পানি, ওর সব দুঃখ যেন ওর চোখে যেয়ে ভর করেছে।

রবার্টের নি:স্বার্থ ভালোবাসার যথাযোগ্য প্রতিদান দেওয়ার মানুষ মনে হয় একমাত্র বারবারাই। ভালোবাসার সেতুবন্ধনে ওরা যে কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারে নাই, সেটা মনে হয় বারবারা’র চোখের জল আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম মেয়ের বাসায়। এক দিন পর বারবারা ডায়ালাইসিস করার সময় নতুন করে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে ডাক্তাররা তাকে বাসায় ফিরতে নিষেধ করেছেন। বিমানবন্দর আসার সময় আমার সাথে আর দেখা হলো না, মনটা বেশ খারাপ হলো। শক্ত মানুষটার সেই অশ্রু সিক্ত মুখের কথা আমি যাত্রা পথের মধ্যে কোনমতেই ভুলতে পারলাম না।

ওয়াশিংটন ডালাস এয়ারপোর্ট থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে চড়ে আমেরিকা থেকে দেশের পথে রওনা দিলাম। লন্ডনে বিরতি দিয়ে পরদিন ঢাকা বিমানবন্দরে নামলাম। তিন মাস দেখতে দেখতে কোথায় দিয়ে যে চলে গেছে সেটা দেশে এসে বুঝতে পারলাম। পরের দিন দেশে পৌঁছানোর সংবাদ জানালাম মেয়েকে। ভালোমতো পৌঁছেছি, দেশের সবাই ভালো আছে।

মেয়ের পরের কথা শুনে আমি আর কোন কথা বলতে পারলাম না। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। একাকীত্বের যন্ত্রণাই কি বারবারা’র চলে যাওয়ার কারণ? হাসপাতালে থাকার তিন দিনের মাথায় বারবারা নিরবেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। শত চেষ্টা করেও ডাক্তাররা বাঁচাতে পারে নাই। বারবারা’র শেষ কথাটা মনে পড়লো, আপনি তো ভাগ্যবান মানুষ নিজের মাতৃভ‚মিতে যেতে পারছেন। আমি আর কোথায় যাবো? (চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেল সিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ