ইউসুফ কামাল : অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে তবু রিয়াকে কেন যেন ভুলতে পারেনি অভি, সময়ের হিসেব করতে গেলে কবে দেশ স্বাধীন হয়েছে সেটা হিসেব করতে হয়। কত বছর হবে সেটা? খুব সহজ একটা হিসেব। স্বাধীনতার বয়স হিসেব করলেই সময়ের দূরত্বটা খুব সহজভাবে হিসাব করা যায়। বিশেষ কিছু ঘটনার সময় মনে করতে বেশি চিন্তার প্রয়োজন হয় না, সহজেই মনে পড়ে যায় যদি এমনই বিশেষ কোন দিন বা সময় জড়িয়ে থাকে ঐ ঘটনার সাথে। অভি’র বয়স তখন কতই বা হবে স্বাধীনতার পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। পড়াশোনার চেয়ে সারাক্ষণ বন্ধুদের সাথে ছুটাছুটিতে ব্যাস্ত থাকাই যেন ছিলো মুখ্য কাজ। বাস্তব জীবনের কড়াগন্ডা হিসাব বোঝার মতো সময় ও বয়স কোনোটাই তখনো ওর হয়নি। ভর্তির কাজ শেষ করেই অভি ছুটে গেছে নিজের প্রিয় শহরে বন্ধুদের সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসতে। এর পরেই তো ক্লাস শুরু হয়ে যাবে আর তার পরেই সবাই নতুন করে ব্যাস্ত হয়ে পরবে লেখাপড়া নিয়ে। বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একা হাঁটতে হাঁটতে ওদের নির্দিষ্ট আড্ডাস্থলে যাচ্ছিল, ওখানে সব পুরোন বন্ধুরা বসে গল্প করে সময় কাটিয়ে আবার সন্ধ্যার পর যে যার মতো বাড়ি ফিরে যায়।

বাড়ি থেকে বেরোনোর পর পরই ‘ভাইয়া’ ডাকে থেমে ঘুরে দাঁড়ালো অভি, অপরিচিত একটা মুখ চিনলো না। চিনতে চেষ্টা করলো, তাও পারলো না। ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। হয়তো অভির অপেক্ষাতেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো।

অভি বল্লো, কিছু বলবে আমাকে? আগন্তুক হাতে ধরা একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বল্লো, রিয়া এটা আপনাকে দিতে বলেছে। অভি জিজ্ঞেস করলো, রিয়া কোথায়? তুমি কে? রিয়া ওদের বাড়িতেই আছে। ওদের বাড়ির পাশেই আমরা থাকি। আমার নাম ঝন্টু। কথাগুলো বলে ঝন্টু থামলো। ওর মুখে রিয়া’র নাম শুনে অভি ভালো করে তাকালো ছেলেটার দিকে, হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলো। ঝন্টু আর কথা না বলে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। একটু সরে নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে অভি কাগজটা খুল্লো, সম্বোধনবিহীন একটা সাদা মাটা চিঠি। এটাকে চিঠি না বলে বলা যেতে পারে অনুরোধের একটা চিরকুট।

“এই কয়দিনেই ভ‚লে গেলে?
কাল সন্ধ্যা সাত টায় এসো,
আমি বাড়ীর গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে
থাকবো।”
খুবই সাধারণ ভাষায় লেখা কিন্তু লেখার মধ্যে রিয়া’র মনের গভীরের একটা আর্তি যেন লুকিয়ে আছে। অভি জীবনে প্রথম এমন একটা ঘটনার মুখোমুখি হলো, কি করবে এখন? কিছুক্ষণ থ’মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো, পুরো ঘটনাটার অদ্যোপান্ত মনে করার চেষ্টা করলো। যুদ্ধের তিনটে মাসের কিছু স্মৃতি ওর মনে পাকা পোক্তো আসন গেড়ে বসে আছে। সবাই শহর ছেড়ে পরিবার নিয়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে, গ্রাম কি শহর সব স্থানের মানুষই কম বেশি আতংকগ্রস্থ। কখন কি হয় বলা যায় না। রাতের বেলায় যুবকদের পালা করে এলাকা পাহারা দেয়া যেন একটা জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এর মূল উদ্দেশ্য হয়তো সবার ভিতরের ভয়কে দূর করে সাহস আনার সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

আর তখন কার সেই সময়েই রিয়া’কে হঠাৎ করেই ভালো লেগেছিলো অভি’র। জীবনের অনিশ্চয়তার মুহূর্তগুলোতে মানুষ মাঝে মাঝে নতুন কিছুর সন্ধান পায়, আর তখন হঠাৎ করেই আলোর ঝলকানী যেন জীবনকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পায় যেন নতুন করেই, কাউকে কেন্দ্র করে। জীবনে কত রকম ঘটনা যে ঘটে, আর সেটা যে পরিকল্পিতভাবে ঘটে তাও না। পরে অভি চিন্তা করে দেখেছে আগেও তো রিয়া’কে সে দেখেছে, কিন্তু তখন তো ওকে এমন করে ভালো লাগেনি এর কারণটা কি? সেটা কি দুজনের যৌথ প্রয়াস? বেশির ভাগ সময়েই সেটা অলৌকিকভাবেই ঘটে যায়।

ঠিক যেমনি করে মানসিক নৈকট্যতার সৃষ্টি হয়েছিলো ওদের দু’জনের মধ্যে। এটা কি সময় ও পরিস্থিতির কারণে? এর মাসখানেক পরেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় পর্যায় চলে আসতে থাকে, ফলে সবাই আবার বৃত্তচ্যুত হয়ে পড়ে। গ্রাম থেকে সবাই যার যার আপন ঠিকানায় ফিরে যায়, সবাই শহরের নিজ নিজ বাড়িতেই ফিরে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবাই আগের মতো যার যার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো, অভি কলেজের পাট শেষ করে চলে গেল ঢাকায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য। হঠাৎ করেই রিয়ার চিন্তাটা মাথায় ঢুকলো, কি করবে সে? কাল কি দেখা করতে যাবে? (চলবে)
ইউসুফ কামাল : ডেল সিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ