ইউসুফ কামাল : নতুন নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ সব কিছু মিলিয়ে দিনগুলো একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিল অভি’র সপ্তাহে দুই দিন লাঞ্চের পর ক্লাস ছিল বাকী দিনগুলোতে আর বাধা ধরা কোন কাজ থাকে না। কাজ না থাকলে অভি দুপুরের খাওয়া সেরে হলেই বন্ধুদের সাথে গল্প করে সময় কাটিয়ে দিতো অথবা দুপুরে ঘুমিয়ে বিকেলে বন্ধুদের নিয়ে নিউ মার্কেটে ঘুরাঘুরিতে সময় কাটিয়ে দিতো। দুই মাস হয়ে গেল অভির হল জীবন, হল জীবনের বড় সুবিধা হলো যথা সময়ে ক্লাসে যাওয়া যায় আর বেশি রাত করে ফিরলেও কোন সমস্যা হয় না। বেশির ভাগ সময় বলাকা’য় নতুন ভালো ছবি আসলে সেকেন্ড শো সিনেমা দেখে বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে হলে ফিরে আসতো। সকালের দিকের ক্লাস শেষ করে দুপুরের খাওয়াটা হলে সেরে আবার ক্লাসে যাওয়া যায়। জীবনের স্বাধীনতা এখানে ভরপুর, কেউ পড়ার জন্য তাগাদা দিবে না। সকালের ক্লাসের জন্য কেউ ঘুম থেকে জাগিয়ে দেবে না, সব কিছুই নিজের ভালোই জন্য নিজেকেই করতে হয়। এটা দায়িত্ববান হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার বিশেষ একটা স্থান, সব কিছুই থাকে নিজের হাতের মধ্যে। অভির মনে ছিলো রিয়ার পরীক্ষার কথা, মার্চের ৪ তারিখ ওর পরীক্ষার প্রথম দিন। ৩ তারিখ বিকেলের বাস ধরে চলে গেল ওর শহরে, বাসে দুই ঘন্টার পথ। পৌঁছতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেলো। নিজের শহরে এলেই মনের ভিতরে একটা মায়াবী শান্তি অনুভব করে অভি। সারা শরীর মন ভরে ওঠে আনন্দের ছোয়ায়। অভি মনে করলো আগের থেকে রিয়া’কে জানানোর দরকার নাই, পরীক্ষার হলে যেয়ে সারপ্রাইজ দিলেই ভালো হবে। ওর বাড়িতে যেয়ে দেখা করা তো সম্ভব না পরীক্ষার হলে দেখা করাটাই ভালো। ও খানে তো অনেকেই আসে, তাই সবার ভিড়ের মধ্যে দেখা করে চলে আসাটাই ভালো হবে।

ছোট শহর, চারিদিকে একটা নিরিবিলির ছোয়া। এ খানেই ওর জন্ম তাই হয়তো নাড়ীর টানটাও এই শহরের জন্যই বেশি। বেশি দিন না আসলে ভিতরে ভিতরে নাড়ীর টান অনুভব করে, সেই সাথে পরিবারের একটা টান তো থাকেই। স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিলো অভি, রিয়া’র সাথে বাইরে থেকে দেখা করে যাওয়াটাই সঠিক ভেবে গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ করেই বন্ধুর কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওর মুখের দিকে তাকাতেই বুঝলো কেউ যেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ ঘুরিয়ে বাম দিকে তাকাতেই দেখলো রিয়া অলক্ষ্যে এসে দাঁড়িয়ে আছে পাশে, আর তাই বন্ধুর এই নিরবতা। ছোট শহর, মোটামুটি সবাই সবার পরিচিত। বন্ধু রহমত কিছুটা থমকে গেলো, কিছুটা অন্যমনস্ক মনে হলো, কিছু একটা বুঝেই যেন তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে চলে গেলো। রিয়া’ও কেন জানি অভি’র বন্ধুকে দেখে একটু চিন্তা করলো। শুধু বল্লো, রহমত তোমারও বন্ধু নাকি? ও তো আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু, না জানি তোমার সাথে কথা বলা দেখে আবার কোন ঝামেলা না বাধিয়ে বসে! একটু থেমে রিয়া বল্লো, কবে এসেছো। জানাওনি তো? অভি বল্লো, গত কাল রাতে। তোমার পরীক্ষার জন্যই তো তাড়াহুড়ো করে এসেছি। আবার কালই চলে যাবো, একটা পরীক্ষা আছে।

রিয়া হেসে বল্লো, বুঝেছি। আর জানাওনি কেনো তাও বুঝেছি। অভি বেশি কথা না বাড়িয়ে কথা সংক্ষেপ করতে চাইলো। হলের সিট খোঁজার বিষয় আছে তাই কথা সংক্ষিপ্ত করতে চাইলো। বল্লো, পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন হয়েছে? ভালো তো? মাথা ঝাকিয়ে রিয়া বুঝিয়ে দিলো প্রস্তুতি মোটামুটি ভালোই হয়েছে। রিয়া কিছু একটা চিন্তা করে সরাসরি অভির মুখের দিকে তাকিয়ে বল্লো, তোমার সাথে অনেক কথা আছে। পরীক্ষা শেষে ‘ছবি’র বাসায় যাবো, ওখানে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। তুমি এসো।

ছবি রিয়া’র বান্ধবী, অভি ওকে ভালোভাবেই চিনে দুজন এক সাথেই পরীক্ষা দিচ্ছে সেটাও জানে। ছোট্ট শহর সবার বাসাই মোটামুটি অভি’র চেনা, রিয়া’র কথায় সম্মতি জানিয়ে চলে আসলো ওখান থেকে। তার মানে রিয়া পরীক্ষা শেষে ছবি’র বাসায় যাবে অভির জন্য, বিষয়টা অভির কাছে খুব একটা পছন্দ হলো না কিন্তু মুখে কিছু বল্লো না। ভাবলো এখন ‘না’ বল্লেই ওর মনের বিরুদ্ধে চলে যাবে, মন খারাপ হলে পরীক্ষা খারাপ হয়ে যেতে পারে। মুখে কিছু না বলে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। অভি কথা সংক্ষেপ করে রিয়া’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো। চলে এলো ঠিকই কিন্তু মনের মধ্যে কেমন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। কি করবে চিন্তা করলো, এমন হবে অভি সেটা কল্পনাও করেনি। আর রিয়া’র মুখের উপর না’ও বলতে পারেনি। পরীক্ষা শেষের সময় হিসেব করে দশ মিনিট পরে অভি যেয়ে হাজির হলো ছবি’র বাসায়। কলিং বেল টিপতেই ছবি এসে দরোজা খুলে দিলো, ছবি জানতো অভি ঠিকই আসবে তাই দরোজার কাছেই ছিলো। ছবি মন খারাপ করে বল্লো, রিয়া আসতে পারেনি। পরীক্ষা শেষে হল থেকে বেরিয়ে দেখে, ওর মা হলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন ওকে নিয়ে যাবার জন্যে। বেচারা মন খারাপ করে যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেছে, আপনাকে এটা জানাতে। রিয়া’র না আসতে পারার সংবাদে অভি একটু চিন্তা করলো, রিয়া’র মায়ের আকষ্মিক পরীক্ষা কেন্দ্রে আসার কারণ কি, উনার তো আসার কথা না, এর পিছনে অন্য কোন কারণ থাকতে পারে! অভির মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো, কি কারণ থাকতে পারে? তবে কি রহমত কোন অঘটন ঘটিয়েছে? রিয়া’র সন্দেহই কি তবে সত্যি হলো!

একটু চিন্তা করে অভি বল্লো, রিয়া’কে বলে দিও আগামী কাল সকাল দশটায় আমার একটা পরীক্ষা আছে। আজ বিকেলেই আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি। পরীক্ষাটা না থাকলে হয়তো একদিন পরেই যেতাম। ও যেন মাথা ঠান্ডা করে মন দিয়ে পরীক্ষা দেয়।

ছবি বল্লো, ভাই খুব বেশি দরকার না হলে রিয়া’র সাথে দেখা না করে যাবেন না, ও কান্নাকাটি করবে আমি জানি। আমি ওর সম্মন্ধে খুব ভালো জানি। কথা না বাড়িয়ে অভি বাড়ী এসে দুপুরের পর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। যাওয়ার সময় মনটা খারাপ হয়ে গেলো রিয়া’র সাথে দেখা করতে না পারার জন্য। ও কি বলতে চেয়েছিল জানা হলো না, সারাটা পথ চিন্তা করতে করতেই অভি এক সময় ঢাকা পৌছে গেলো। ভাবলো সে দিন অমন করে পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে দেখা না করলেই হয়তো ভালো হতো। হয়তো মায়ের কাছ থেকে রিয়া’কে কোন কথা শুনতে হয়েছে। হয়তোবা মনে কষ্ট পেয়েছে, রিয়া’র কথা মনে হওয়ায় অভি’র নতুন করে কষ্ট লাগলো। সেবার রমজান মাসের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেলো, ছুটির পর দিন অভি ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ীর পথ ধরলো। অনেক গুলো দিন পার হয়ে গেছে ও বাড়ী আসেনি। বাড়ীর কাছাকাছি আসতেই ওর অনেক কথা মনে হতে শুরু করলো। রিয়া’র সাথে দেখা করা দরকার, কেমন আছে রিয়া? সেই দিনের পর থেকে কোন খবরই তো আর অভি পায়নি, রিয়া ভালো আছে তো? ছোট শহর সবাই সবার পরিচিত এতে সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও অনেক। কার কাছে রিয়া’র খবর জানা যাবে ভাবতেই রিয়া’র বান্ধবী ছবি’র কথা অভি’র মনে পড়লো। ওর কাছেই তো সব খবর পাওয়া যাওয়ার কথা। (চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেল সিটি, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র