ভজন সরকার : এক সময় মনখারাপ থাকলে হাঁটতাম। একা একা হাঁটার অভ্যেস সেই ছোটবেলাকার। প্রাইমারী স্কুল কাছেই ছিল। আমাদের গ্রামের এক মাথা থেকে অন্য মাথা ছাড়িয়ে পাশের ছোট একটা পাড়া। তারপরেই প্রাইমারী স্কুল। নিচু বিল এলাকা। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি থেকে হেমন্তের প্রথম অর্থাৎ কার্তিক মাস পর্যন্ত জল-কাদায় পূর্ণ হালোট। সেই হালোট পেরিয়ে স্কুলে যেতাম পায়ে হেঁটেই। জমি থেকে দশ-বিশ-ত্রিশ ফুট উঁচুতে ভিটে বাড়ি। লম্বা দড়ির মতো সরল রেখায় আঁকা দীর্ঘ গ্রাম, যেনো স্কেল দিয়ে মেপে মেপে বাড়িগুলো বসানো। সামনে চার-পাঁচ ফুট প্রশস্তের নিচু কাচা রাস্তা। এরই নাম হালোট। হালোট ধরে ধরে এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে ছেলে-মেয়েরা হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। তাই হাঁটার অভ্যেসটা তখন থেকেই।

ক্লাস সিক্সে হাই ইস্কুলে যেতে হবে। প্রাইমারীর পাশেই হাই স্কুল; প্রাইমারী স্কুলের লম্বা বিল্ডিংয়ের এক পাশেই। স্কুলটি তখনো নতুন। তাই গুনে-মানে তেমন উত্তীর্ণ নয়। তাছাড়া বাবা যে স্কুলে পড়েছেন এবং পড়ান, সেটি অনেক পুরানো। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত। তাই ওখানেই পড়তে হবে।

স্কুলটি বাড়ি থেকে পাক্কা চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে। বর্ষার সময়ে নৌকায় যেতে দেড়-দু’ঘন্টা। হেঁটে গেলেও তেমনি। শুকনো মরশুমে ক্ষেতের আইল ধরে কিংবা চক-পাতিলা যাওয়া যায়। আঞ্চলিক ভাষায় ফসলের মাঠকে চক বলা হয় বা হতো। আর সেই মাঠের কোণাকুণি সরলরেখায় চলাকে বলা হয় “চক পাতিলা” চলা। ছাত্র হিসেবে তেমন খারাপ ছিলাম না। তাছাড়া ছোটবেলাতেই বই পড়ার অভ্যেসের জন্য জেনে গেছি, আইল ধরে ধরে চলার চেয়ে কোণাকুণি চলাতে সময় কম লাগে।

যখন একটু উপরের ক্লাসে গিয়ে জিতেন স্যার জ্যামিতি পড়ালেন, ত্রিভুজের যে কোনো দুই বাহুর যোগফল তৃতীয় বাহুর চেয়ে বেশি। প্রতিদিনের “চক পাতিলা” চলার সহজ বুদ্ধিটা তখন মনে পড়ল। মনে পড়ল, জ্যামিতি না জেনেও প্রতিদিন আমরা জ্যামিতির এই নিয়মটাই তো অনুসরণ করি। এখনো যখন সময় বাঁচানো জন্য আড়াআড়ি চলি তখন স্কুলে শেখা জ্যামিতির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে হাইস্কুলের দীর্ঘ সময় প্রতিদিন হেঁটে আসা দীর্ঘ চার-পাঁচ কিলোমিটার পেরিয়ে আসার কথাও।

এতো অল্প বয়সে সপ্তাহে পাঁচ দিন এতো দূর হেঁটে স্কুলে আসা-যাওয়ার ক্লান্তি তো ছিলই। দশটা পাঁচটা স্কুলের সাথে আসা-যাওয়া মিলিয়ে আরো তিন-চার ঘন্টা যোগ করলে দিনের অর্ধেক সময় এমনিতেই কেটে যেত। তারপরে লেখাপড়া-খেলাধুলা মিলিয়ে ঘুমের সময় আর কতোটুকু বাকী থাকে? তাই কখনো কখনো হেঁটে যেতে যেতেই এক ঘুম হয়ে যেত। হেঁটে যেতে যেতে ঘুম? কথাটি পরবর্তী জীবনে অনেককেই বিশ্বাস করাতে পারিনি। যারা শখের স্বাস্থ্যরক্ষার হাঁটাহাঁটি করেন তাদের কথা আলাদা; কিন্তু নিয়ম করে প্রাত্যহিক একই পথে যাদের হাঁটার অভ্যেস আছে তাঁদের কাছে এটি অবাক করা নতুন ঘটনা নয়।

একই পথে দীর্ঘদিন চলতে চলতে পা এমনি সামনে চলে, মস্তিস্ককে তেমন কাজ করতে হয় না। এই পৌণঃপুনিক অভ্যস্ততা, যাকে টেকনিক্যাল পরিভাষায় বলা হয় “ফ্যাটিগ”। এই ফ্যাটিগ অবস্থায় মস্তিস্কও একটু অলস হয়ে পড়ে। তাই অনায়াসেই দশ-বিশ মিনিট তন্দ্রা বা স্বল্পস্থায়ীভাবে ঘুমিয়ে নেওয়া যায়।

অনেক প্রাণী দাঁড়িয়ে ঘুমায়, যেমন ঘোড়া। অনেক মানুষকেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে নিতে দেখেছি, বিশেষত যারা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করেন কিংবা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। পৃথিবীতে কতো বিচিত্র পেশায় মানুষ নিয়োজিত আছে। তাই প্রাত্যহিক কাজগুলোও মানুষ পেশাগত দায়িত্বের সাথে সাথে সম্পন্ন করা শিখেছে। ‘মানুষ অভ্যেসের দাস’ কথাটি যখন পড়ি তখন মনে পড়ে সেই অভ্যেসের নিয়মেই দীর্ঘ হাঁটার অভ্যেসটি আমার হয়েছিল সেই ছোটবেলাতেই।

কলেজে উঠেও ঢাকা কলেজের আশপাশ টইটই করে ঘুরে বেড়িয়েছি। ৮০’-এর দশকের ঢাকা, এখনকার যে কোনো প্রত্যন্ত মফস্বল শহরের চেয়েও ফাঁকা ছিল। কতোদিন হেঁটে হেঁটে আজাদ স্যারের কাছে কলাবাগান পড়তে গিয়েছি। বিডিআর পিলিখানায় পুরানো বাংলা সিনেমা চলতো। উত্তম-সুচিত্রা জুটির জনপ্রিয় সব সিনেমা বন্ধুরা মিলে কতোবার যে দেখেছি, তার হিসেবে নেই। অনেক সময় সিনেমা শেষে হেঁটে হেঁটে ফিরতে দেরী হতো। হোস্টেলের ডাইনিং বন্ধ হয়ে যেতো। নিউমার্কেটের পোস্ট অফিসের গেটের সামনে চারুকলার ছাত্রদের হল। হলের পাশেই অনেকগুলো খাবার হোটেল।

আমাদের প্রিয় ছিল ‘ভাই ভাই হোটেল’। কয়েক দশক পরে যতোবার ওদিক দিয়ে গিয়েছি, ‘ভাই ভাই হোটেল’-এর সেই খাবারের এক অন্যরকম গন্ধ যেনো নাকে এসে লাগতো, অথচ আশির দশকের মাঝামাঝি সময়েই ওই এলাকার হোটেলগুলো বন্ধ করে ওখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হোস্টেলের প্রবেশ পথ করা হয়েছিল। কিন্তু স্মৃতি কি এতো সহজেই মুছে দেওয়া যায়?

সে সময়ে প্রতিদিন বিকেলে নীলক্ষেত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি, শহীদ মিনার নিয়মিত হেঁটে যেতাম। এক ফেব্রুয়ারিতে নীলক্ষেত পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর হয়ে শহীদ মিনারে যাচ্ছি একুশে ফেব্রুয়ারির মাসব্যাপি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। ভিসির বাড়ির সামনে ফুলার রোডে ঢুকতেই কলাভবন এলাকা থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী দৌড়ে এদিকে আসছে। ডানদিকে তাকাতেই দেখি ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিলের দিক থেকে শতশত বিডিআর জোয়ানেরা এদিকে আসছে। পেছন ফিরে নীলক্ষেতের দিকে ঘুরতেই চোখে পড়ল পুলিশ। একমাত্র পালানোর পথ মহসিন হলের মাঠ। ওদিকেই দৌড় দিলাম। সামনে শত শত মানুষ দৌড়াচ্ছে। পেছনে পায়ের আওয়াজ।

৮০’-র দশকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চামড়ার স্যান্ডেল পরার প্রচলন ছিল। ফুলার রোড থেকে মহসিন হলের গেইট পর্যন্ত অর্ধেক কিলোমিটার রাস্তায় স্যাণ্ডেল সারেসারে পড়ে আছে। নিজের স্যান্ডেল জোড়াও পায়ে নেই। সাথে থাকা দুই বন্ধুও পাশাপাশি দৌড়াচ্ছি।
সেদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পুলিশ গুলি চালিয়ে জাফর-জয়নাল-দীপালি সাহাসহ অসংখ্য ছাত্রদের হত্যা করেছে। নিহত ছাত্রদের গায়েবানা জানাজা কলাভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গায়েবানা জানাজায় পুলিশ-বিডিআর-এর আক্রমন। সেদিন কোন মতে মহসিন হলের দেয়াল টপকে আমি ফিরতে পেরেছিলাম। কিন্তু সাথের দুই বন্ধুকে রাতে মহসিন হল থেকে ধরে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে দীর্ঘদিন নির্যাতন করে পরে ছেড়ে দিয়েছিল। এখনো ভাবি, এতো সব দুর্ভোগের পেছনের কারণ হাঁটার সেই ছোটবেলার অভ্যেস।

প্রবাস জীবনের প্রথম দিকে ছিলাম কানাডার টরন্টোর ড্যানফোর্থে। তখনো ড্যানফোর্থ পুরোপুরি বাঙালি পাড়ায় পরিণত হয়নি। ড্যানফোর্থের সাবওয়ে স্টেশনের ধার ঘেঁষে গল্ফ খেলার মাঠ। নাইন হোলের এ ছোট মাঠটি বেশ চ্যালেঞ্জিং। মাঠের বুক চিরেই বহে গেছে একটি ছোট জলধারা। তাই উঁচু-নিচু পাহাড় উপত্যকার মতো এর গঠন। এই মাঠের পাশে দিয়ে সকাল-বিকেল-রাত হেঁটে বেড়াতাম অভিবাসী জীবনের প্রথম বছরের কর্মহীন অলস সময়ে।

একদিন রাতে ড্যানফোর্থ সাবওয়ে স্টেশনের পাশ দিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক রোড দিয়ে ড্যানফোর্থ এভিনিউয়ের দিকে হাঁটছিলাম। জুন-জুলাই মাসের স্বস্তিদায়ক তাপমাত্রার রাত। সাবওয়ের ওভারব্রিজ পার হয়ে ড্যানফোর্থ এভিনিউয়ের দিকে তাকাতেই এক বিশাল গোলাকার আলোর বৃত্তে চোখ আটকে গেল। এতো স্নিগ্ধ-এতো নরম আলো আগে কখনো চোখে লাগেনি। ভালো করে তাকিয়ে দেখি ড্যানফোর্থ এভিনিউয়ের ওই ঢালু পথের ওপার থেকে পূর্ণিমার চাঁদ আলোর বৃত্ত সাজিয়ে উদিত হয়েছে। জীবনে অনেক ভরা পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছি। কিন্তু এমন করে এতো কাছে এতো মোহনীয় রূপে কখনোই পৃথিবীর এই উপগ্রহটি আমার কাছে ধরা দেয়নি।

মনে আছে, সেদিন চাঁদের দিকে উদভ্রান্তের মতো হেঁটেছিলাম। সদ্য অভিবাসী হয়ে এসেছি। তাই অভিবাসী জীবনের টানাপোড়েন তো আছেই। সেই সাথে যা ফেলে এসেছি তার জন্য পিছুটান। অনিশ্চিত জীবনের শঙ্কা। সব কিছু মিলিয়ে একটু স্বস্তি, একটু সান্ত¡না পাওয়ার চেষ্টা করতাম পথে হেঁটেই। সেদিন বুঝেছি অস্থিরতা কাটাতে পথের কোনো বিকল্প নেই। জীবনের মতো যেন পথও সীমাহীন। তাই এই দুই অসীমকে মেলানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা আমার জীবনব্যাপি।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)