মণিজিঞ্জির সান্যাল : পৃথিবীর আশ্চর্যতম এক গ্রাম যেখানে পারস্পরিক সুন্দর ব্যবহারই এই গ্রামের মূল বিষয়। এখানকার প্রতিটি মানুষ শান্ত, মার্জিত, ধীর স্থির এবং শিক্ষিত, সর্বোপরি পরিচ্ছন্ন। পরিচ্ছন্ন এখানকার প্রকৃতি। সবুজ আর নীলের মেলবন্ধন স্বচ্ছ ভাবনার শিক্ষা দেয়। মাথার উপর মেঘমুক্ত নীল আকাশ, চারপাশে শুধুই সবুজের সমাহার, যেন একে অপরের গলা জড়িয়ে আছে। গাছেরা সবুজ থেকেও আরো সবুজ, কথা বলে নিবিড় আলিঙ্গনে। মন ভাল করা প্রকৃতির মধ্যে শুধুই গাছ আর গাছ। কতো সুন্দর নানান রংয়ের, নানা গন্ধের সব ফুল। উড়ে বেড়াচ্ছে কত রংয়ের প্রজাপতি। বাড়িগুলো ছবির মতো সুন্দর ভাবে সাজানো। ছোটবেলার পুতুল খেলার ঘরগুলোর মতো। এ গ্রামের সবাই শিক্ষিত, সুন্দর রুচির ছাপ সর্বত্র। ছোট্ট এই সবুজ-শ্যামল পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন গ্রামটির মূল বৈশিষ্ট্য হল সবার সাথে ভালো ব্যবহার করা। এই বিষয়টির উপরেই সবসময় জোর দেয় এখানকার বাসিন্দারা।

এখানে যখন তখন যেখানে সেখানে কেউ কোনো আবর্জনা বা টুকরো কিছু ফেলে না। অদ্ভুত সুন্দর সব ডাস্টবিন। এই গ্রামের যাবতীয় বর্জ্য বাঁশ দিয়ে তৈরি ছোট ছোট ডাস্টবিনের মধ্যে সংগ্রহ করা হয়। তারপরে সেই বর্জ্য থেকেই সার তৈরি করা হয়। শুধু গ্রামকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখেই যে পৃথিবীর সেরা গ্রাম, তা নয়। গ্রামের মানুষের পোশাক পরিচ্ছদে পবিত্রতার ছোঁয়া। বাড়িঘর, সব কিছু একদম ঝকঝকে, তকতকে। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে এক একটি বাড়ি। প্রতিটি বাড়ি ঘিরে সাজানো রঙিন সব ফুলের গাছ। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে রঙিন সব প্রজাপতি। যেন রূপকথার রাজ্য থেকে উঠে আসা একটি গ্রাম! এখানে বাইরে কেউ মদ খায় না। কারোর সঙ্গে কেউ কখনও খারাপ ব্যবহার করে না। কেউ কখনও জোরে কথা বলে না। দুঃখও দেয়না কেউ কাউকে। ছোটরাও কখনও গাছ থেকে ফুল তোলে না বা গাছের পাতা ছেঁড়ে না। গ্রামের জঙ্গল এবং চারপাশের সবুজকে আরো প্রসারিত করতে তারা নিয়মিত গাছ লাগায়। আসলে সবুজ সুন্দর রাখে মনকে, ভাল রাখে চোখদুটোকে, চারপাশকে করে তোলে আরও সুন্দর। রাস্তাঘাট এতোটাই ঝকঝকে তকতকে, ময়লা-আবর্জনা তাই একটুও দেখতে পাওয়া যায়না। চারপাশে শুধুই ফুলের বাগান। এই গ্রামটিকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম বলা হয়। প্লাস্টিকের ব্যবহারও এখানে পুরোপুরি বন্ধ। ধূমপানও নিষিদ্ধ এখানে। এ গ্রামের সব বাসিন্দাই শিক্ষিত, তবুও কৃষিই তাদের মূল জীবিকা।

সবকিছুর জন্য এখানে রয়েছে সুন্দর আরো কিছু নিয়মবিধি। ছোট বড় প্রতিটি মানুষ সুন্দর ভাবে মেনে চলে সেইসব নিয়ম। ভারতের মেঘালয়ের পূর্ব খাসি পাহাড় জেলার এই গ্রামটির নাম মাওলিননং। শিলং থেকে যার দূরত্ব ৯০ কি.মি। এই জায়গায় যারা থাকেন তাদের বলা হয় মাওলিননং। ‘বরাক উপত্যকার প্রবেশদ্বার’ হিসেবে পরিচিত কালাইন, যা মাওলাইনং থেকে ১৮৭ কি.মি দূরে অবস্থিত। অপরদিকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একেবারেই কাছাকাছি এই গ্রাম। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামটিতে ২০০৩ সালের আগে পর্যটকদের পায়ের ছাপ পড়েনি। মেঘালয়ে ছিল না কোনো সড়ক। যেতে হতো শুধুমাত্র পায়ে হেঁটে। গ্রামটি এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন গ্রামের স্বীকৃতি পেয়েছে পরপর দুবার আন্তজার্তিক ট্রাভেল ম্যাগাজিনের থেকে। এর আগে এ গ্রামটি এশিয়ার পরিচ্ছন্ন গ্রামের স্বীকৃতি পায়। World Cleanest Village বলা হয় গ্রামটাকে! এখানে স্বাক্ষরতার হার ১০০ শতাংশ। বিরল মাতৃতান্ত্রিক এই গ্রামে নিয়ম অনুযায়ী এই খাসি সমাজে ধন-সম্পদের মালিক হন মেয়েরা। মায়ের সম্পদের একমাত্র উত্তরাধিকারী হন এই পরিবারের মেয়ে। মায়ের নামের পদবি গ্রহণ করে সন্তানরা। ভারত এবং বাংলাদেশের সীমান্তে পাহাড়, জঙ্গল, ঝর্নায় ঘেরা এই গ্রামটি মেঘালয়ের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উঠে এসেছে। গ্রামের পাহাড়ি একটি ঝর্নার উপরে গাছে শিকড়ের তৈরি সাঁকো অর্থাৎ Living root Bridge পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণের স্থান।

প্রকাশ্যে মলমূত্র ত্যাগ যেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাভাবিক বিষয়, সেখানে এ গ্রামের সব বাড়িতেই টয়লেট রয়েছে। এ গ্রামের প্রশংসা করেছেন খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী। মহাসড়কে ও স্মৃতিস্তম্ভের আশেপাশে ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য কুখ্যাতি আছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মানুষদের। এ দুর্নাম দূর করতে প্রধানমন্ত্রী মোদী শুরু করেন ক্লিন ইন্ডিয়া প্রচারাভিযান। আর এর অংশ হিসেবে এক রেডিও ভাষণে তিনি গ্রামের প্রশংসা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমি জেনে চমৎকৃত হয়েছি, উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ে এমন একটি প্রত্যন্ত গ্রাম আছে, যেটি বছরের পর বছর ধরে পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে আসছে।

বছরের পর বছর ব্যতিক্রমধর্মী পরিচ্ছন্নতার কারণে এ গ্রামটি পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। ভারতের বড় বড় শহরের ধুলোবালি আর কোলাহল থেকে অনেক আলাদা এই গ্রাম। গ্রামের কোনায় কোনায় দেখা যায় বাঁশের তৈরি ডাস্টবিন। স্বেচ্ছাসেবীরা নিয়মিত বিরতির পরপর রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেয়। প্লাস্টিকের ব্যাগ ফেলে দিতে দর্শণার্থীদের প্রতি কড়া নির্দেশমূলক সংকেত চোখে পড়ে প্রায়ই। আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা একেবারেই নিষিদ্ধ।
এলাকাবাসীর ভাষ্য “আমরা প্রতিদিন পরিষ্কার করি। কারণ, আমাদের দাদা-দাদি ও পূর্ব-পুরুষরা আমদের শিখিয়েছে কীভাবে গ্রাম ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখতে হয়। কারণ, পরিচ্ছন্ন থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।”

১২ থেকে ১৪ বছর আগে এ গ্রামে প্রথম সড়ক নির্মিত হয়। তারপর ডিসকোভার ইন্ডিয়া নামে একটি ট্রাভেল ম্যাগাজিনের এক সাংবাদিক ঘুরে যান গ্রামটি। তারপরই তাঁর লেখা একটি নিবন্ধে গ্রামটিকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। এরপরই যেন দর্শণার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে গ্রামটিকে ঘিরে। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ২৫০ পর্যটক এ গ্রামে বেড়াতে যান। গ্রামের জনসংখ্যা বেড়ে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ক্রমেই, খ্যাতির বিড়ম্বনার মুখোমুখি হয় মাওলিনং।

২০০৩ এবং ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক ট্র্যাভেল ম্যাগাজিন থেকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পায় মাওলিননং। এছাড়া ২০০৫ সালে ভারত সরকার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম হিসেবে ঘোষণা দেয়। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই গ্রামের মোট জনসংখ্যা ৫০০ জন। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাওলাইনং-এ পরিবার আছে ৯৫টি।
মাওলাইনং গ্রামের লোকদের উর্পাজনের প্রধান উৎস কৃষি। সুপারি তাদের প্রধান ফসল ও শস্য? এই গ্রামে দলবদ্ধ হয়ে খাসিয়া স¤প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করে। শান্তিপ্রিয় এ গ্রামে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত।

মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং,
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ