ফরিদ আহমেদ : মোটেলের বুকিং দেওয়া ছিল আগেই। কিন্তু, খুঁজে পেতে জান বের হয়ে গেলো আমার। এমন না যে জঙ্গলের মধ্যে লুকানো এটা। ওয়েন সাউন্ডে হাইওয়ে সিক্সের উপরেই মোটেল। নাম স্প্রিংমাউন্ট মোটেল।
বাসা থেকে ফোনের জিপিএস অন করে রওনা দিয়েছিলাম। মাঝ পথ পার হবার পর দেখি ফোনে আর নেটওয়ার্ক নেই। জিপিএস ফ্রিজ হয়ে রয়েছে। শেষে আদিযুগের অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে পথ চলা শুরু হলো। ডাটা রোমিং অন করলেই হতো, কেন যেন চরম কিপ্টেমিতে পেয়ে বসলো আমাকে।

মোটেল খুঁজে পেয়ে পার্কিং এ আন্নাকে বসিয়ে রেখে আমি একাই গেলাম অফিসে। ছোট্ট মোটেল, অফিস আরো ছোট। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ দেখে ডোর বেল বাজালাম। খানিকক্ষণ পর কালো দাঁড়িওয়ালা, আমাদের মতোই এক বাদামি লোক এসে হাজির হলো। মাথায় বেসবল ক্যাপ পরা।
আমার বুকিং আছে, সেটা নিশ্চিত হয়েই আচমকা আমাকে প্রশ্ন করে বসলো, ‘ফ্রম করাচি?’

‘না, আমি বাংলাদেশের।’ বিরক্ত স্বরে আমি বললাম। মনটা তিতা হয়ে গেছে আমার। নিশ্চিতভাবে এক পাকিস্তানির পাল্লায় পড়েছি।
‘একাত্তরের আগে না পরে জন্মেছো?’ কী কারণে যেন তার চোখ দুটো কোমল হয়ে এসেছে।

আমি কোমল হইনা। পাকিস্তানিদের এই প্রশ্নের মাজেজা আমি জানি। একাত্তরের আগে জন্মেছি বললেই, ‘ওহ, আমরা তো একই দেশের লোক ছিলাম, বা আমরা এক সময় দুজনেই পাকিস্তানি ছিলাম।’ এই ধরনের কথা বলে আত্মতৃপ্তি নেয় তারা। একে সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না।
‘একাত্তরের পরে জন্মেছি।” মিথ্যা করে বললাম।

‘ও” করে একটা হতাশার মতো শব্দ বের হয়ে এলো তার কণ্ঠ থেকে।
এবার আমার পালা। ‘তুমি কি পাকিস্তানি?’ আমি জিজ্ঞেস করি। আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটা বলে, ‘না, আমি ভারতীয়।’
একজন ভারতীয় কেন আমাকে ‘ফ্রম করাচি’ বলে প্রশ্ন শুরু করবে বুঝলাম না। যাইহোক, পাকিস্তানি না, সেই স্বস্তিটা পাওয়া গেলো অন্তত।
আমাকে একটা ফর্ম ফিল আপ করার জন্য এগিয়ে দেন ভদ্রলোক। আমি ফর্ম ফিল আপ করতে থাকি। ঠিক তখনই তিনি বলে ওঠেন।
‘আমি একাত্তরে বাংলাদেশে যুদ্ধ করেছি।’

আমার হাত স্থির হয়ে যায়। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করি, ‘কোথায়?’
‘যশোরে। তুমি চেনো?’
‘যশোর তো আমার দেশের বাড়ি।’ তিনি শুনে দারুণ খুশি হয়ে ওঠেন, ‘তাই নাকি? বাহ!’
‘কিন্তু, আপনিতো অনেক ইয়াং লুকিং।’ আমি তাঁর কালো দাঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলি।
তিনি হাসেন। ‘ইয়াং লুকিং, কিন্তু ইয়াং না। আমার বয়স তিয়াত্তর বছর। রিটায়ার করেছি আমি অনেক আগে।’

আমাকে দাঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছেন তিনি। সে কারণে তাড়াতাড়ি যোগ করেন ‘আমার দাঁড়ি রং করা।
যে ভদ্রলোকের কথা এতোক্ষণ বললাম তাঁর নাম ইকবাল সিং চীমা। এখন প্রিন্স চীমা নামেই বেশি পরিচিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট ছিলেন। প্যারাট্রুপার কমান্ডো ছিলেন তিনি। ৩রা ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর আগেই নয় মাস ধরে চলছিল বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের যুদ্ধ। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাহিনী গঠন করে যৌথ বাহিনী, যা মিত্রবাহিনী নামে পরিচিত।

যশোর ক্যান্টনমেন্ট তখন পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী দুর্গ। এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাতে ভারতীয় বাহিনী ছত্রী সেনা নামায় সেখানে। প্রিন্স চীমা আকাশ থেকে প্যারাসুট নিয়ে নেমে আসেন যশোরের মাটিতে। যশোরেই ছিলেন তিনি বাকিটা সময়। বাহাত্তর সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার হলে যশোর থেকে কোলকাতায় চলে যান তিনি। তিরিশ বছর ভারতীয় আর্মিতে কাজ করে কর্নেল হিসাবে অবসরে যান তিনি ১৯৯৮ সালে।

আমরা বাংলাদেশি বলে খাতিরযত্ন, আদর-আপ্যায়ন বেড়ে যায় প্রিন্স চীমার কাছ থেকে। সেই পয়তাল্লিশ বছর আগে যে দেশটার জন্মের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তিনি সেই দেশের নাগরিক না হয়েও, সেই দেশের প্রতি যে প্রবল ভালবাসা বুকে বয়ে নিয়ে চলেন, সেটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় নি আমাদের।

আসার আগে শুধু বলেছিলাম। ‘আপনার কাছে কৃতজ্ঞ আমরা। যে অবদান আপনি বা আপনারা রেখেছেন আমাদের একটা দেশ পাইয়ে দিতে, সেটাকে ভুলে যাই নি আমরা।’

আমার কথা শুনে বুকে জড়িয়ে ধরেন তিনি আমাকে।