ডঃ বাহারুল হক
*** পরীক্ষা চলছে অংকের। “ত্রিভুজের যে কোন দুই বাহুর সমষ্টি ৩য় বাহু অপেক্ষা বৃহত্তর”। এটা প্রমান করতে হবে। ছাত্র নানা ভাবে আঁকলো। কিন্তু হয় না। শেষে সে হিজি বিজি করে কি একটা আঁকলো এবং লিখলো- “ত্রিভুজের——–বড়”। এটা সত্য স্যার। প্রমান কিভাবে করবো তা আমি একদম ভুলে গেছি স্যার। আপনিও জানেন স্যার এটা সত্য। তারপরও আমি ঠিক করেছি পরীক্ষার পর একদিন স্যার আমি প্রমান করে দিব। আমাকে এখন নম্বর দেন স্যার। স্যার খাতা পেলেন । দেখলেন। তারপর লিখলেন- “তুমি প্রমাণ করা বাকি রেখেছ। আমিও নম্বর দেয়া বাকি রাখলাম। যেদিন প্রমান দবে সেদিন নম্বর পাবে। আপাতত তোমাকে ০০ দিলাম”। শুধু এর জন্য নয়, সব মিলে ছাত্র অংকে ১০০ তে পেল ০০১। ছাত্র অভিমান করে গেল স্যারের কাছে। বললো- “১ কোন অংকে পেলাম বুঝলাম না স্যার”। স্যার বললেন- “১? ১ তোকে এমনি দিয়েছি”। ছাত্র বললো- “স্যার, ১ এমনি যখন দিলেন তখন ০ দুইটার আগে বসিয়ে দিলেই তো পারতেন। ০০ পরে কেন দিলেন স্যার! এখন আব্বাকে খাতাটা কিভাবে দেখাই”!

*** ভারতে এক জাতের বানর আছে; সে জাতের বানরদের বৈশিষ্ট হলো একটা পুরুষ বানরের ৪০/ ৪৫টা স্ত্রী থাকবে। ওদের নিয়ে তার সুখের হেরেম। হেরেম মাঝে মাঝে শক্তিমান নওজোয়ান পুরুষ বানর দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং শুধু হেরেমের মালিক পুরুষ বানরটা আক্রান্ত হয়। দুই পুরুষের মধ্যে তুমুল ফাইট চলে। মজার বিষয় হলো এই ৪০/৪৫ টি স্ত্রী বানর (হেরেমের রানীরা) এখানে সেখানে বসে দাঁড়িয়ে ফাইট দেখে কিন্তু স্বামীকে নওজোয়ান বানরের আক্রমন থেকে উদ্ধারের কোন চেষ্টাই করে না। প্রায় ক্ষেত্রে নওজোয়ান পুরুষ বানর জয়ী হয়। সব চেয়ে দুঃখজনক যা তা হলো এই ৪০/ ৪৫ স্ত্রী বানর জয়ী নতুন পুরুষকে তাদের নয়া স্বামী বলে মেনে নেয় এবং নতুন করে সেই নতুন স্বামীকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করে।

*** ঘর থেকে বের হবার সময় আমার হাতে থাকে একটা কেইন। সেদিন বৃস্টি হচ্ছিল। ফলে কেইনের সাথে ছাতা ছিল একটি। রাত ১০টা বাজতে আর বেশি বাকি নাই। জরুরীভাবে দরকার হওয়ায় কয়েকটা দ্রব্য ক্রয় করতে গেলাম একটা চাইনিজ ফুড মার্টে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে , বাতি নেভানো শুরু হয়েছে। আমি যা হাতে ছিল সেগুলোর দাম দিয়ে বের হয়ে আসলাম। তারপর কোন খেয়ালে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে বাসায় চলে এলাম। আসার সময় বৃস্টি ছিল না, ফলে ছাতাটাকে কেইন ভেবে কেইনের মত ব্যাবহার করেছি। বাসার দরজার সামনে দাঁড়ালে হঠাৎ মনে পড়লো কেইনের কথা। কি আর করা! রাত পোহালো; সকাল ৮টা; গেলাম ফুড মার্টে। ফুড মার্টে কাজ শুরু হয়েছে, তবে কর্মীদের একজনকেও পেলাম না যে চাইনিজ নয়। এই কর্মী বাহিনির একজনও ইংলিশ জানেনা, বুঝে না।
ম্যানেজারকে বললাম। ম্যানেজার বললো – কৈ আমার কাছে তো কেউ কিছু জমা দেয়নি। আমি ভিতরে গিয়ে সবাইকে কেইনের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। কেউ শুনতেও চাইলো না আমার কথা। কারণ সেই একটা তারা কেউ ইংলিশ বুঝে না। বিফল হয়ে ফিরে আসছি এমন সময় দেখি একজোড়া চাইনিজ। তাদের চেহারা আর ড্রেস দেখে মনে হলো তারা শিক্ষিত। সাহস করে পুরুষটার দৃস্টি আকর্ষণ করে বললাম আমার কেইন হারানোর কথা। তারপর বললাম- আপনি যদি কেইনকে চাইনিজ ভাষায় কি বলে আমাকে বলে দেন তাহলে আমি আবার তাদের কাছে যেতে পারি। তিনি বললেন- কেইনকে চাইনিজ ভাষায় বলে ‘ওয়াই ছা’। আমি আবার গেলাম ভিতরে। গিয়ে একজনকে ‘ওয়াই ছা’ বলতেই সে দেখিয়ে দিল এভোগার্ডোর টেবিলের নিচে আছে। আরেকজন এসে কেইনটা বের করে আমার হাতে দিল। কি যে খুশী হলাম কেইনটা মানে ‘ওয়াই ছা’টা পেয়ে! ‘ওয়াই ছা’!

*** আমরা তো বলি রবীন্দ্রনাথ মানব মনের কোন দিকটা তুলে ধরেননি? তিনি কবি- বিশ্বকবি। তিনি সাহিত্যিক- বিশ্ব সাহিত্যাকাশে প্রোজ্জল এক তারা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি ভাবতেন নিজেকে নিয়ে? কিভাবে তিনি নিজেকে মুল্যায়ন করেছেন? দেখি কিভাবে। নবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি হৈ রৈ শুরু করে দিল। তাদের প্রশ্ন- কেন, কি জন্য রবীন্দ্রনাথকে নবেল পুরস্কার দেয়া হলো? তিনি কাদের জন্য লিখেছেন আমরা জানি। তিনি কি প্রলেতারিয়েতদের জন্য কিছু লিখেছেন? বিশ্বের কথা বাদ দিলাম, বাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য তিনি কি লিখেছেন? তারা বললো- রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন অনেক গান। কিন্তু সে সব গান কি ধরনের গান, কাদের জন্য লিখেছেন? তারা নিজেরাই উত্তর দিলো- রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন সুখী মানুষদের জন্য নানা রকম ঘুম পাড়ানি গান। এভাবে কমিউনিস্টরা তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকলো। রবীন্দ্রনাথের ভক্তরা সহ্য করতে পারছিলেন না এই রবীন্দ্র বিদ্বেষ। তারা রবীন্দ্রনাথকে বার বার বলছিলেন- গুরুদেব, আপনি চুপ করে থাকবেন না; কিছু বলুন। ভক্তদের কথায় ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ একদিন ভক্তদের উদ্দেশ্যে লিখলেন-
“আমার কবিতা সে জানি আমি
গেলেও বিচিত্র পথে হয়নি সর্বত্রগামী”।
বিশ্ব সমাজে উঁচু আসনে স্থান করে নেয়া একজন বিশ্বকবির কি সহজ স্বীকারউক্তি।

***
“আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।”

সৃষ্টির আনন্দে সেদিন আমি কাজী নজরুল হয়ে গিয়েছিলাম। কি সৃষ্টি করেছিলাম? সৃষ্টি করেছিলাম একটা পেনফ্রেন্ড। আমি তখন কলেজে ইন্টার -এর ছাত্র। বালক জীবন পার হওয়া কল কল প্রাণ এক যুবক। কাগজে পেনফ্রেন্ডশিপে আগ্রহী বিদেশি খুঁজতেছিলাম। পেয়ে গেলাম আমেরিকার হাই স্কুলের ছাত্র রবিন ক্র্যামারকে। শুরু হলো চিঠি আদান প্রদান। কঠিন কাজ। ডাক খরচ ছিল অনেক। যাই হোক তারপরও চালিয়া গেলাম। রবিনের হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। তাছাড়া সে লেখার জন্য যে কাগজ ব্যাবহার করতো তার মান ছিল খুব উন্নত। হালকা ক্রিম কালারের খুব পাতলা কাগজ। কাগজ পাতলা হলে চিঠির ওজন কম হয়, আর ওজন কম হলে ডাক মাসুল কম লাগে। সেরকম সুন্দর কাগজ আমি সে সময় ঢাকায় কোথাও খুঁজে পাইনি।

১৯৭০ সনে ১২ নভেম্বর ভয়াভহ এক সাইক্লোন (পৃথিবীর বুকে সে সময় পর্যন্ত হয়ে যাওয়া অন্যতম সাঙ্ঘাতিক একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়) পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) আঘাত হানে। সে সাইক্লোনে নিহতের সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষের উপরে। রবিনের দেশ আমেরিকায়ও এই ভয়াভহতম সাইক্লোনের খবর বিপুলভাবে প্রচারিত হয়। রবিন সাইক্লোনের, ধ্বংসের, মৃত্যুর, মানুষের দুর্দশার খবর শুনে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল। সে চিঠি পড়ে বুঝেছিলাম রবিনের আছে মানুষের প্রতি গভীর মমত্ব বোধ। আমাকে সে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিল আমি যেন দেরী না করে তার চিঠির উত্তর দেই। ১৯৭১ সনের মার্চ মাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। জান নিয়ে ছুটাছুটি। বাক্স-পোটলার মধ্যে পুরোনো চিঠি-পত্র ভরবার সময় সুযোগ কোথায়! ঢাকা থেকে গ্রামে যাওয়ার সময় চিঠিগুলো সাথে নেওয়া একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। চিঠিগুলো আর পাইনি। দেশ স্বাধীন হলো। নতুন দেশ, নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে নতুন এক জীবন। রবিন আর মাথায় নাই। আজ ৫৪ বছর পর হঠাৎ রবিনকে মনে পড়লো।

*** রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি একটা কালজয়ী প্রতিভার নাম। রবীন্দ্র প্রতিভা দ্রæবতারা হয়ে বিশ্বসাহিত্যাকাশে উদিত হয়েছে। এ তারা বহু কাল সাহিত্যাকাশে ঝিকমিক করতে থাকবে।আমরা শুনে যাব তার গান- রবীন্দ্র সঙ্গীত; তার সঙ্গীতে কি নাই? আমরা পড়ে যাব তার লেখা- রবীন্দ্র সাহিত্য; মানব মনের কোন ভাবকে তিনি তুলে ধরেননি? তার যেমন বড় বড় লেখা আছে তেমনি আছে ছোট ছোট কথাও। কান্না নিয়ে, চোখের জল নিয়ে তিনি কি কম লিখেছেন? কিন্তু আমার ভালো লেগেছে চোখের জলের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতি সংক্ষেপে দুটি কথা। চোখের জলকে কবির একটা ছোট্ট প্রশ্ন আর চোখের জলের ছোট্ট একটা উত্তর। দেখুন কি প্রশ্ন আর কি সে উত্তর।

“কিছু কথা ভাবতে ভাবতে
চোখে এল জল,
জলকে বলিলাম-
তুই হঠাৎ কেন বাইরে এলি বল?
জল বললো-
চোখটি তোমার সুখ সৃষ্টির নীড়,
কি করে সইবো বলো
এত কষ্টের ভীড়??”

*** স্রোতস্বিনী যেমন শ্রোত হারা হলে মজে যায়, রুপ হারায় সম্পর্কও সেরকম; কোনরকম যোগাযোগ না থাকলে সম্পর্ক থাকে না। সম্পর্ক তা যার সাথে হোক রক্ষা করার জন্য শ্রম দিতে হয়, সময় দিতে হয়, অনেক সময় অর্থও ব্যায় করতে হয় (যদি সামর্থ থাকে)। আপনার শরীর ভালো না; তারপরও মনের টানে কষ্ট করে গেলেন দেখা করতে- শ্রম দিলেন। আপনি খুবই ব্যাস্ত। একদম সময় পান না। তারপরও সময় ব্যায় করে মনের টানে দেখতে গেলেন- সময় দিলেন। তার কিছুর দরকার নাই; তার অনেক আছে; তারপরও আপনি তার প্রিয় কিছু তার জন্য কিনে তার হাতে তুলে দিলেন। তিনি হাসি মুখে গ্রহণ করলেন। বা এরকমও হতে পারে আপনি জানেন তিনি অভাবে নাই, যে কোন সময় যে কোন পরিমান টাকা ব্যায় করার সামর্থ তার আছে। তারপরও আপনি তার হাতে কিছু টাকা দিলেন; তিনি নিলেন; আপনি মহা খুশি- আপনি অর্থ ব্যায় করলেন। আপনি হয়তো বলবেন- সম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন। আসলে, মন ভালো রাখতে চাইলে, মনের মধ্যে পরিতৃপ্তির একটা আবহ বজায় রাখতে চাইলে আপনাকে কঠিন কাজ করতেই হবে-আপনাকে দিতে হবে হয় শ্রম, নয় সময়, নতুবা অর্থ (দ্রব্যে বা নগদে), কঠিনেরে ভালোবাসতে হবে। আর যদি সিদ্ধান্ত নেন ভাই-বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি-সহকর্মী কারো সাথে সম্পর্ক রাখবেন না তাহলে ভিন্ন কথা।

*** বিশ্বাস কী? বিশ্বাস হলো অন্তরের অন্তঃস্থলে বিদ্যমান একটা জ্ঞান যা সব সময় থাকে প্রমাণের নাগালের বাইরে।
বিশ্বাস বলতে কী বোঝায়? বিশ্বাস বলতে সাধারণতঃ পারিপার্শ্বিক বিষয়-বস্তুরাজি ও জগৎ সম্পর্কে কোনো সত্ত¡ার স্থায়ী-অস্থায়ী প্রত্যক্ষণকৃত ধারণাগত উপলব্ধি বা জ্ঞান এবং তার নিশ্চয়তার উপর আস্থা বোঝানো হয়। সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, জ্ঞানতত্ত¡ ইত্যাদি বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্বাস শব্দটি বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে খানিকটা আলাদা অর্থ বহন করতে পারে। তাই জ্ঞান, সত্য, ইত্যাদির মত বিশ্বাসেরও কোনো একটি সর্বজনসম্মত সংজ্ঞা নেই বলে অনেকের ধারণা ।

*** ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভবন হিসেবে চিহ্নিত হবার আগে কার্জন হল ছিল যেন গরিবের সুন্দরী স্ত্রী, সবার ভাবি। কার্জন হল তৈরি শুরু হয় ১৯০৪ সনে।এটি বর্তমান অবয়বে আত্ম প্রকাশ করে ১৯০৮ সনে। তারপর থেকে এটি টাউন হল, সচিবালয়, ইত্যাদি নানা কিছিমের ভবন হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে। কোন মর্যাদা নাই, পরিচিতি নাই, আভিজাত্য নাই, কিছুই নাই। ১৯২১ সনে ঢাকা ইউনিভার্সিটি শুরু হলে কার্জন হল ঢাকা ইউনিভার্সিটির কাছে হস্তান্তরিত হয়। কার্জন হল রাতারাতি হয়ে যায় ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভবন। অনিন্দ সুন্দর কার্জন হল ঢাকা ইউনিভার্সিটির মত সবোচ্চ শিক্ষালয়ের অংশ হওয়াতে একটি অভিজাত, মর্যাদাপুর্ণ, বনেদি, গৌরবছোঁয়া স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। সেই থেকে আজও কার্জন হলের সেই স্ট্যাটাস আছে। আজ কার্জন হল ছোঁয়া প্রতিটি ষ্টুডেন্ট গর্ব করে বলে- কার্জন হল আমার হল। আমি কার্জন হলের।