ভজন সরকার : বাঙালি জাতিসত্বার মহান পুরুষ নিহত হয়েছিলেন ১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্মরণে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(১)

কালের দুখাই
(বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্মরণে চতুর্দশপদী)

কাঁপানো শীতের রাতে খেসারীর মাঠে একা একা
হেঁটে গেছে কুয়াশার পায়ে এক কালের কিশোর
দূরন্ত দস্যুতা ছিলো মনে ছিলো বাসনা দুর্জয়
বালি জ্যোতস্নার মৃদু অন্ধকার ফেরাতে পারেনি
তাকে। কিংবা শিশিরের জলে গলেনি কষ্টের নদী।
আহবান ছিলো তার মাঠের ওপারে বাঁধা ঘর
বর্তমান তুচ্ছ ছিলো ইতিহাস ডেকেছিলো দূরে
খালি পায়ে নেমে গেছে মধ্যমাঠে শীতের শিশিরে।
ঠিকানা কোথায় ছিলো বোঝা ভার কিন্ত ছিলো তার
পায়ের স্বর্ণালী ছাপ ছোপ মারা ঈগলের ক্ষুর
ভিতরে নক্ষত্র ছিলো সারা রাত তারার আকাশ
ঠিকানা কোথায় ছিলো বোঝা ভার কিন্ত ছিলো সব
বর্তমান তুচ্ছ ছিলো ভবিষ্যত ডেকেছিলো তাই
খালি পায়ে নেমে গেছে মধ্যমাঠে কালের দুখাই।

(২)
১৯৪১ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত এমন কোন উপায় নেই, যা দিয়ে তাঁকে ব্যবচ্ছেদ করা হয়নি; তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রেম-কাম-বিবাহ-পরকীয়া-স্বকীয়া-দুর্বোধ্যতা-অশ্লীলতা এসব নিয়ে দিস্তার পর দিস্তা নামিয়ে দেয়া হয়েছে। লক্ষ আর কিছু নয় শুধুই আত্মপ্রচার, তাঁর আলোতে নিজেদেরকে আলোকিত করা। সে প্রচেষ্টা কী অবির্মা-নিরন্তর, ভাবতেই অবাক লাগে! রবীন্দ্রনাথের প্রাইভেসি -এক্সক্লুসিভ-ইনক্লুসিভ সহ কত বাহারি নামে নিজেদেরকে একটু জাতে তোলার কত রকম হাস্যকর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা!!!
রবীন্দ্রনাথের পরে আরেকটি মানুষকে নিয়ে বিগত চার দশক ধরে একই রকম প্রচেষ্টা-কখনো পক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশোভনভাবে বিপক্ষে,তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। তাঁর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”-কে নিয়েও ফরহাদ মজহার ও তাঁর ভাবশিষ্যদের সে কী অক্লান্তকর প্রতিক্রিয়া ও টানাটানি! এসব শুনি আর অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উদ্ধৃতিটি মনে পড়ে,”

“একাত্তর জুড়ে যত কিছু ঘটেছে, বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যত সংবাদ পৌঁছেছে, যত প্রচার হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা যত সেতু উড়িয়ে দিয়েছে, যত পাকিস্তানি জন্তু বধ করেছে, যত বাঙালি নিহত হয়েছে, যত নারী লাঞ্ছিত হয়েছে, আর আমরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছি, তার সবটাই মুজিবের নামে। অন্য কোনো নামে এটা ঘটতে পারত না; অন্য কোনো নাম থেকে এ প্রেরণা উৎসারিত হত না।

বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে দিয়েছিলেন মুজিব, বন্দি থেকেও তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন মুক্তিযুদ্ধ, তিনিই সৃষ্টি করে চলছিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। মুজিবকে আমরা প্রচণ্ড সমালোচনা করতে পারি, কয়েক দশক ধরে তো কোটি কোটি বামন প্রাণভরে তাঁর সমালোচনা করছে।”

(৩)
“বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে স্বাধীনতা আসেনি”- এ কথা এখন এই সময়ে এসে বলা খুব সহজ। কিন্তু ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে একক এবং একমাত্র নেতৃত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর; আর কারো নয়। এ প্রসংগে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বলেছেন,
“মুক্তিযুদ্ধের সময়টি ভরে তিনিই ছিলেন নিয়ন্ত্রক ও প্রেরণা, তিনিই ছিলেন, এক অর্থে, মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের কারাগারে তিনি হয়তো মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতেনও না, পাকিস্তানিরা তাঁকে তা জানতে দেয়নি, মুক্তিযুদ্ধের রূপ কী তা হয়তো তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি, কিন্তু সমগ্র বাঙালির রূপ ধরে তিনিই করে চলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাই ছিলো মুজিবের দ্বিতীয় সত্ত¡া।”

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)