হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

কতিপয় দেশের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে বিশে^ আজ অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে। সেইসাথে বাড়ছে মানবিক সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য ও পানীয় সংকট আর রক্তপাত। প্যান্ডেমিক-এর রেশ এখনও রয়ে গেছে। এইসময় পরাশক্তি রাশিয়া আক্রমণ করে বসে ইউক্রেনকে। এখান থেকে জন্ম নিল নতুন সংকট ও মেরুকরণ।

হামাসের আক্রমণে গোটা ইসরায়েল স্তব্ধ ও হতভম্ব হয়ে পড়ে। অথচ ফিলিস্তিনি নারী ও শিশু হত্যার সময় তারা হতভম্ব হয় না। এখন তারা গাজা উপত্যকায় খাদ্য, পানি ও বিদুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ইসারয়েলের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহী রণতরী সহ আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ইসরায়েলে পাঠিয়ে দিয়েছে।

হামাসের আক্রমণের পরপরই ইসরায়েল বিমান হামলার মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের আবাসস্থল, হাসপাতাল ও বিভিন্ন স্থাপনা। ইসরায়েল-ভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের এতে কী লাভ হচ্ছে, তার চেয়েও বড় কথা, তাদের একবার ভাবা উচিৎ ছিল সামান্য বন্দুকধারী, ড্রোন ও কিছু রকেট ব্যারেজের অধিকারী হামাসদের প্রতিরোধ করতে রণতরী, আধুনিক ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাবার কতোটুকু প্রয়োজন ছিল। এটা কি ইরানকে ধ্বংস করার একটা মওকা তাদের জন্য? ইরান হামাসকে রকেট-ড্রোন দিয়ে সাহায্য করছে। আর ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে বহুকাল ধরেই।

বহুযুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট হয়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বাস্তুহারা করে রেখেছে। নির্বিচারে হত্যা করেছে ফিলিস্তিনি নারী-শিশু, সাধারণ যোদ্ধা ও কমান্ডারদের। হামাসের আক্রমণের প্রেক্ষিতে ভয়াবহ বিমান হামলা ছাড়াও ইসরায়েল এখন আক্রমণ করছে স্থলপথে। যে আধুনিক মারণাস্ত্র ও বিপুল সংখ্যক সৈন্যসহ তারা আক্রমণ করছে হামাসের ওপর, তা যে কোনো দেশকে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম। জাতিসংঘ, পশ্চিমা দেশসহ বিশে^র প্রায় প্রতিটি মানুষেরই জানা আছে ফিলিস্তিনিদের একটুকরো ভূখণ্ড দরকার। যে কোনো মাপকাঠিতেই তারা নিজস্ব ভূখণ্ডের দাবিদার। অথচ বহুকাল ধরে জেরুজালেম, গাজা উপত্যকা আর পশ্চিম তীর ইসরায়েল দখল করে রেখেছে। গাজায় যে কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি রয়েছে, তাদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলছে নারকীয় অত্যাচার, নিপীড়ণ ও দমননীতি।

এবার একটু পেছন ফিরে তাকাই, এবং অ্যামেরিকার ভেল্কিবাজি দেখি।
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ (অক্টোবর যুদ্ধ, রমজান যুদ্ধ ও ইয়ম কিপুর যুদ্ধ বলেও পরিচিত) মিশর ও সিরিয়ার জোট এবং ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৭৩ সালের ৬ থেকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে সংঘটিত হয়।

ইহুদিদের পবিত্র দিন ইয়ম কিপুরের সময় ইসরায়েল-অধিকৃত অঞ্চলে আরব জোটের হামলার মাধ্যমে এই যুদ্ধ শুরু হয়। এসময় মুসলিম পবিত্র মাস রমজান ছিল। মিশরীয় ও সিরীয় সেনারা যুদ্ধবিরতি রেখা ভেদ করে যথাক্রমে সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমিতে ঢুকে পড়ে। এই অঞ্চলগুলো ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের সময় ইসরায়েল অধিকার করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ে তাদের নিজ নিজ মিত্রদের সহায়তা করে। ফলে দুইটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়।

মিশরের সফলভাবে সুয়েজ খাল অতিক্রম করার মাধ্যমে যুদ্ধের সূচনা হয়। যুদ্ধবিরতি রেখা অতিক্রম করার পর মিশরীয় সেনারা সিনাই উপদ্বীপের দিকে যাত্রা করে। তিনদিন পর ইসরায়েল এর অধিকাংশ সেনা নিয়োগ করে মিশরীয় অগ্রযাত্রা থামাতে সক্ষম হয়। সিরীয়রা গোলান মালভূমির ওপর হামলা চালায়। প্রথমদিকে তারা ইসরায়েলি অধিকৃত অঞ্চলে সাফল্য লাভ করে। তিনদিনের মধ্যে ইসরায়েলিরা সিরীয়দের যুদ্ধপূর্ব যুদ্ধবিরতি রেখার বাইরে পাঠাতে সক্ষম হয়। এরপর তারা সিরিয়ার অভ্যন্তরে চারদিনব্যাপী পাল্টা আক্রমণ চালায়।

এক সপ্তাহের মধ্যে ইসরায়েলি গোলন্দাজরা দামেস্কের উপকন্ঠে গোলাবর্ষণ শুরু করে। নিজ মিত্রের ক্ষতির কথা চিন্তা করে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ধারণা করতেন যে সিনাইয়ের ভেতরে দুইটি কৌশলগত পথ অধিকার আলোচনার সময় তার অবস্থান শক্ত করবে। তাই তিনি মিশরীয়দের পুনরায় আক্রমণের নির্দেশ দেন। কিন্তু এই আক্রমণ প্রতিহত করা হয়। এরপর ইসরায়েলিরা পাল্টা আক্রমণ করে এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে কায়রোর দিকে ধীরে অগ্রসর হওয়া শুরু করে। এসময় উভয় পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

২৪ অক্টোবর নাগাদ ইসরায়েল নিজেদের অবস্থান শক্ত করে নেয় এবং মিশরের থার্ড আর্মি ও সুয়েজের শহর ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়। এসময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ২৫ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি হয় এবং যুদ্ধের সমাপ্তি হয়।

এই যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল ছিল। ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে ভারসাম্যহীন অবস্থায় পড়া মিশরীয়-সিরীয়-জর্ডানি মিত্রতা প্রাথমিক সাফল্যের ফলে খন্ডিত হয়। ইসরায়েল যুদ্ধক্ষেত্রে সফল হলেও এটি একচ্ছত্রভাবে আরব রাষ্ট্রগুলো সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তা প্রতীয়মান হয়। এসব পরিবর্তন ‘শান্তি প্রক্রিয়ার’ দিকে এগিয়ে যায়।

১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে মিশরকে সিনাই উপদ্বীপ ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং প্রথমবারের মতো কোনো আরব রাষ্ট্র কর্তৃক ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। মিশর সোভিয়েত ইউনিয়ন বলয়ের প্রভাব ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে।

সেই প্রেক্ষাপটে মিশরের জন্য, এবং অদূর ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনিদের জন্য ভালো হয়নি। বিপদগ্রস্ত রাষ্ট্র্রের জন্য কোনো বলয়ই ভালো নয়। এটা দড়ি টানাটানি খেলার মতো। আনোয়ার সাদাত নিজের ভূখণ্ড বুঝে নিলেন। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেন। দুরদর্শিতার অভাবে আর ছলচাতুরির ফাঁদে পড়ে যে সিদ্ধান্ত তৎকালিন মুসলিম নেতারা মেনে নিয়েছিলেন, তা পরবর্তীতে ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায় ও সংগ্রামকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। বিশ^ ম্যাপে ইসরায়েলের ভূখণ্ড দেখানো হয়, আর ফিলিস্তিনিরা প্রতীয়মান হয় যায্বার হিসেবে।

এখানে নাৎসি জার্মান প্রধান হিটলারের বক্তব্য স্মর্তব্য। ১৯৪৩ সালে ফিলিস্তিনে আশ্রিত হয় ইহুদিরা। যাদেরকে মেরে হিটলার জার্মানি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এইসময় দুনিয়ার কোনো দেশ ইহুদিকে আশ্রয় দিচ্ছিলো না। রাশিয়া, ব্রিটেন, অ্যামেরিকা, ফ্রান্স, কেউ না। যে দেশেই তারা জাহাজের নোঙর দিয়েছে তারাই তাড়িয়ে দিয়েছে। অবশেষে তারা নিজের জাহাজে বসে একটি আবেদন প্রকাশ করে, যাতে লেখা ছিলো; ‘জার্মানরা আমাদের ঘর ও পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তোমাদের কাছে আমাদের বিশ্বাস তোমরা আমাদের আশা ধ্বংস করবে না। আশ্রয়প্রার্থী হয়ে আমরা ফিলিস্তিনে এসেছি।’

তাদের এই আবেদনের ভিত্তিতে মানবিক কারণে ফিলিস্তিনিরা ইহুদিদেরকে আশ্রয় দিয়ে নতুন জীবন দান করেছিলো। ফিলিস্তিনিরা সেদিন তাদের বাড়ি-জমি দিয়ে সাহায্য করেছিলো। এই ইহুদিরা পরবর্তীতে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ফিলিস্তিনিদের ওপর জুলুম নির্যাতন করে সেই এহসানের পূর্ণাঙ্গ বদলা দিলো।

৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যার পর কিছু ইহুদি ছেড়ে দিয়ে হিটলার বলেছিলেন: কিছু রাখলাম যাতে দুনিয়ার মানুষ বুঝতে পারে ওরা কী জিনিস।

গাজায় ধ্বংসযজ্ঞে পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি স্পষ্ট ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট, মানবাধিকার নিয়ে সরব পশ্চিমা দেশগুলোর আচরণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী দেশগুলোর ফিলিস্তিনের পক্ষে মত প্রকাশে বাধা দেওয়া-এমন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান।

তার বলা কিছু কথা এখানে তুলে ধরছি। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়ার বিষয়ে পশ্চিমা বিশ^ যেমন স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, আরব বিশে^ কিন্তু ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ইরান শক্ত অবস্থান নিয়েছে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। হিযবুল্লাহ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে ইসরায়েলকে ঘায়েল করতে। এই প্রস্তুতি হয়তো যথেষ্ট নয়। কেননা, ইসরায়েল সর্বকালের সেরা প্রস্তুতি নিয়েছে গাজায় স্থলভাগে আক্রমণের জন্য। তিনলক্ষ সেনা মোতায়েনসহ সর্বাধুনিক সাঁজোয়া বহর, অত্যাধুনিক ট্যাংক ও ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত ইসরায়েলি বাহিনিকে কি রুখতে পারবে হামাস ও হিজবুল্লাহ। যদিও জর্র্ডান, কাতার, মিশর তুরস্ক সরব হয়েছে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। আর রাশিয়া ও চিন অনেকটা তাদের স¦ার্থেই (আঞ্চলিক প্রাধান্য বিস্তার বজায় রাখতে) ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বার্তা দিয়েছে। এদিকে ভারতের অবস্থান এখনও সুস্পষ্ট নয়। নরেন্দ্র মোদির টুইটার বার্তা অনেকটা ধুঁয়াশার মতো। এই ধুঁয়াশার ভেতর থেকে একটা কথা সর্বশেষ বেরিয়ে এসেছে যে, তারা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামকে সমর্থন করে।

প্রথম মারাত্মক ভুলটি করা হয়েছিল ফিলিস্তিনিরা হিটলারের তাড়া খাওয়া ইহুদিদেরকে তাদের ভূখণ্ডে স্থান দিয়ে। দ্বিতীয় ভুল করা হয়েছিল মিশর ‘ঠান্ডা আবহ’ বজায় রাখার স্বার্থে ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে।

গত ১৭ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনি গাজায় একটি হাসপাতালে বিমান আক্রমণ করে ৫০০জনকে মেরে ফেলেছে। এ নিয়ে তারা আবার মিথ্যাচার করছে। ইসলামি জিহাদ নাকি এ আক্রমণ চালিয়েছে! মুহূর্তেই এতোবড় হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দেবার মতো ভয়াবহ মারণাস্ত্র জিহাদিদের নেই। এদিকে, এই হামলায় নিন্দার ঝড় বইছে বিশ^জুড়ে। নিন্দাজ্ঞাপন ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে আরব বিশ^।

এদিকে শুরু হয়েছে তথ্য যুদ্ধ। প্রমাণ করার চেষ্টা যে, এটি হামাসের ‘কাজ!’ ‘ফেইলড রকেট হামলা’ দাবি করা হলেও আল জাজিরা এর কোনো প্রমাণ পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল তা প্রমাণ করতে পারেনি। তারা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোতে যুদ্ধ বিরতি ভেস্তে গেল।

গাজায় খাদ্য, পানীয়, পানি ও বিদুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ইসরায়েল চরম কাপুরুষতার নিদর্শন রেখেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার ভয়াবহ অভিযানের পর আবার বিশ^ সংকট নতুন মোড় নিয়েছে। বিশ^ব্যাপী খাদ্যমন্দা ও দুর্ভিক্ষের আলামত দেখা যাচ্ছে।

অন্যদিকে গাজায় হামাস ও হিযবুল্লাহ’র পাল্টা আক্রমণের কথা শোনা যাচ্ছে। তারা কাদের সমর্থন নিয়ে, এবং তাদের সাথে ইরান ছাড়া আর কোন্ রাষ্ট্র যোগ দেবে, ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা এবার কী অস্ত্র ব্যবহার করবে, কীভাবে করবে-সেসব স্পষ্ট নয়।

ইসরায়েলি স্থলবাহিনি, বিমানবাহিনি ও বিমানবাহী মার্কিন রণতরী প্রভৃতির কাছে হামাস ও হিযবুল্লাহ যোদ্ধারা কতোটা কার্যকরী হবে, সে প্রশ্ন থেকে যায়।
এবার আসি কুগেলম্যানের বক্তব্য সম্পর্কে। তার বিশাল বিশ্লেষণ এখানে সংক্ষেপিত আকারে তুলে ধরলাম।

‘ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ মিত্র। ‘সন্ত্রাসবাদে’র বিরুদ্ধে লড়াই করাও যুক্তরাষ্ট্রের মূল অগ্রাধিকার। তাই যুক্তরাষ্ট্র যে এই সংকটকে একেবারে সামনে রাখছে তা বোধগম্য। এটি আপাতত ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্র-চিন প্রতিযোগিতাকে পেছনে ফেলে ওয়াশিংটনের সবচেয়ে সমসাময়িক পররাষ্ট্রনীতিগত উদ্বেগ হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

এটি বিশ্বের এমন একটি ঘটনা যার প্রভাব প্রতিটি দেশের ওপর পরোক্ষভাবে হলেও পড়বে। অর্থনীতি, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং অবশ্যই ভূ-রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। গত তিনবছরে কোভিড মহামারি, ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর এটি বিশ্বে বড় প্রভাব ফেলার মতো তৃতীয় বৃহৎ ঘটনা। এই সংকট যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের জন্য একটি পরীক্ষাও।

কারণ যুক্তরাষ্ট্রকে তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে সমর্থন করতে হচ্ছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন পররাষ্ট্রনীতির মূল্যবোধ থেকে বেসামরিক জনগণের সুরক্ষাকে গুুুরুত্ব দেয়। এখানেও যুক্তরাষ্ট্রকে সংযম দেখাতে হচ্ছে। ঘনিষ্ঠ মিত্রকে সমর্থন আর মূল্যবোধভিত্তিক নীতি বাস্তবায়ন-এই দুইয়ের দ্ব›েদ্বর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ‘আটকা পড়েছে’ বলা যায়।

বাংলাদেশের বিবৃতিতে আবার একইসঙ্গে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের কল্যাণের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিলে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি না দেয়া অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বিবৃতি অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ।

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রসারে যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো ও সরব ভূমিকা এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের আচরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতায় বিপরীতধর্মী অবস্থান প্রকাশ পায়। এমন প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনের পক্ষে জোরালো সমর্থন আছে, বাংলাদেশের মতো এমন দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব, বিক্ষোভ দেখা যেতে পারে।
অনেক মুসলিম দেশেই হামাসের প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই, বিশেষ করে আরববিশ্বে। সেখানে অনেকেই হামাসকে ইরানের বিপজ্জনক ছায়াশক্তি হিসেবে দেখে। তবে অনেকে এখনও প্রকাশ্যে এর সমালোচনা করতে চায় না। কারণ হামাসকে তারা ফিলিস্তিন অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখে।

এখানে মুসলিম দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও বিবেচনায় নিতে হবে। ওই দেশগুলোর প্রভাবশালী কিছু ইসলামী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক আছে। তবে এ সম্পর্কটা অনেকটাই আড়ালের।
ফিলিস্তিনিদের বেসামরিক জনগণের ওপর ইসরায়েলের ফসফরাস বোমা ফেলার পরও যুক্তরাষ্ট্র নীরব। এখন অভিযোগ উঠেছে, ওই বোমাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সিল আছে। অর্থাৎ সেই বোমাগুলো যুক্তরাষ্ট্রই সরবরাহ করেছে। অন্যের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেয়াকে সমর্থন দিয়ে আবার মানবাধিকার নিয়ে কথা বলার মতো নৈতিক অবস্থান কি যুক্তরাষ্ট্রের আছে?
আছে, গায়ের জোরে অনেককিছুই সম্ভব। তেমনই যুক্তরাষ্ট্র তার সামর্থ্য দেখাচ্ছে বিশ^বাসীেেক।

যে কোনো মাপকাঠিতেই ফিলিস্তিনিরা নিজস্ব ভূখণ্ডের দাবি রাখে। তারা যাবে কোথায়? এই ভূখণ্ড তাদেরই ছিল। ইহুদিদের আশ্রয় দিয়ে তারা নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরে এখন মাশুল গুনছে। তারা নিজেদের ভূখণ্ড দাবি করলে ইসরায়েল বিষাক্ত সাপের মতো ফুঁসে ওঠে। তাতে মদদ দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
বলতে গেলে তো অনেককিছু বলা যায়, তা আমার এই এপিসোডে আঁটবে না। অতএব, সংক্ষিপ্ত পরিসরেই থাকা যাক।
আবারও একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক।

প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন নামটা এসেছে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে। তবে প্যালেস্টাইন দেশটি কিন্তু বাইবেলের থেকেও পুরোনো। আর এই বিষয়টিকেই জোর দিয়ে দেখিয়েছেন ফিলিস্তিনি লেখক নুর মাসালহা। আমরা যদি ফিলিস্তিন জাতি এবং তাদের সংস্কৃতির আদি উৎসের খোঁজ করতে যাই, তাহলে দেখা যাবে-বাইবেলেরও বহু আগে থেকেই ফিলিস্তিনি জাতির একটি নিজস্ব সংস্কৃতি এবং পরিচয় রয়েছে।

সেই ব্রোঞ্জ যুগ থেকে শুরু করে আমরা যদি বিভিন্ন ধরনের প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন দেখি, তাহলে দেখা যাবে যে, বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনার কারণে আসলে ফিলিস্তিনিদেরও প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। ইসরায়েলের সাথে কণফ্লিক্টও এর একটি বড় কারণ। তবে ফিলিস্তিনের ইতিহাস আসলে খুবই রোমাঞ্চকর এবং অনেক জটিল। নুর মাসালহার লিখিত বইয়ের পাতায় পাতায় সেই জট খোলা হয়েছে।

সবচেয়ে প্রাচীনকালে যেসব অঞ্চলে মানুষ বসতি স্থাপন করেছিল তার মধ্যে একটি হলো বর্তমান ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন অঞ্চল। কিন্তু এই অঞ্চলের দখল নিয়ে ইতিহাসের প্রথম থেকেই চলছে একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ভেবে অবাক হতে হয়, কয়েক হাজার বছরের পুরোনো সেই লড়াই এখনও পর্যন্ত চলছে। তার অবশ্য কারণও রয়েছে। একদিক থেকে বিবেচনা করলে এই অঞ্চলটি হলো তিনটি মহাদেশের মিলনস্থল, তাই ভূ-রাজনৈতিক কারণে অঞ্চলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কালে কালে বিভিন্ন সা¤্রাজ্য এই অঞ্চলকে দখলে রাখতে চেয়েছে।

প্রাচীন মিশরীয়রা, প্রাচীন পার্সিয়ানরা, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, রোমান সাম্রাজ্য, মধ্যযুগীয় মুসলিম রাজবংশ, ক্রুসেডাররা, অটোমান সা¤্রাজ্য, আর একদম হাল আমলে এসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এই অঞ্চল শাসন করেছে। ব্রিটিশরা এই অঞ্চল ছেড়ে দেয়ার পর সারা বিশ্বের ইহুদিরা এই এলাকার একটি বড় অংশ দখল করে তাদের নিজেদের জাতির জন্য ‘ইসরায়েল রাষ্ট্র’ স্থাপন করে। আর এরপর থেকে লেগেই আছে ইসরায়েল -প্যালেস্টাইন যুদ্ধ।
কিন্তু কারা আসলে এই অঞ্চলের আসল দাবিদার? এই প্রশ্নটির উত্তর জানতে হলে এই অঞ্চলের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে সেই কয়েক হাজার বছর আগের থেকে। আর সেই কাজটিই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করেছেন প্যালেস্টাইন বংশোদ্ভুত লেখক নুর মাসালহা। তিনি ইংল্যান্ডের সেন্ট ম্যারি’স বিশ্ববিদ্যায়ের ইতিহাসের প্রফেসর।

তথাকথিত ইসরায়েলের ইহুদিরা মনে করে যে, প্যালেস্টাইনের বাসিন্দারা এই অঞ্চলে নতুন এসে বসতি গড়েছে, আর ইহুদিরা নিজেরা হলো এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। কিন্তু নুর মাসলাহা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তিনি প্রচুর প্রতœতাত্তি¡ক প্রমাণ ও প্রাচীন লিপির সাহায্যে দেখিয়েছেন যে, প্যালেস্টাইন ধারণাটাই আসলে বাইবেলের প্যালেস্টাইনের চেয়ে অনেক পুরোনো। অর্থাৎ ইহুদিরা ওল্ড টেস্টামেন্টের রেফারেন্স দিয়ে যে ইতিহাস বলে, আসলে এই অঞ্চলের ইতিহাস আরও বেশি পুরোনো। তার মানে ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত সময়ে আদি ইহুদি গোষ্ঠি যখন এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে, তার আগের থেকেই এই অঞ্চলে প্যালেস্টাইনের জনগণ বসবাস করত। তিনি ব্রোঞ্জ যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত প্যালেস্টাইন অঞ্চলের ইতিহাসকে একদম ছবির মতো করে তুলে ধরেছেন।
চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে সমস্ত মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হয়ে উঠেছে। কারা কোন্ পক্ষে যোগদান করবে তা স্পষ্ট না হলেও ইরাক, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও আরও দুয়েকটি আরব রাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তো সরাসরি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তাদের রণতরী ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ছোঁড়া রকেট হামলা ইন্টারসেপ্ট করেছে পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। সামান্য পেছনে ফিরে আমরা দেখতে পাই যুুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতি বাহিনি ইরাককে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল। আফগানিস্তান আক্রমণ করে প্রথমে রাশিয়া, তারপর দেশটির চূড়ান্ত পতন ঘটায় অ্যামেরিকা।

এর আগে ইরান ও ইরাক দীর্ঘ আটবছর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে উভয়ের সর্বনাশ ডেকে আনে। ইসরায়েলকে প্রতিরোধে এই মুহূর্তে আরব বিশে^র ঐক্য ও ফিলিস্তিনিদের প্রত্যক্ষ সাহায্য করার কোনো বিকল্প নেই। একতাবদ্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশে^র ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক প্রস্তুতি, কেননা এবার যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সরাসরি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে।

সংঘাত ও আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে এই যুদ্ধ অতীতে শুরু হয়ে এখনও চলছে। এটা বিশ^ ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন যুদ্ধ, এখনও চলছে। ইসরায়েল ছলে-বলে-কৌশলে তাদের আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডও কব্জা করে নিচ্ছে। এই যুদ্ধ থামতে পারে একমাত্র স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই।
বিশে^র শক্তিধর দেশ, পশ্চিমা ও আরব বিশ^কে এই দিকটি নিয়েই ভাবতে হবে।