হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

বহুবার নিরুদ্দেশের যাত্রায় বেরিয়েছি। তেমনি একটা ভ্রমণ ছিল গাজীপুরের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আমি ও প্রয়াত বন্ধু আলম গিয়ে হাজির হলাম এক বিস্তৃত আনারস বাগানে। হলুদ লালচে নধর আনারস দেখে জিভে পানি এসে গেল। একটা আনারস কায়দা করেছি সবে, এসময় চিৎকারটা শুনতে পেলাম।

কে যেন আমাদেরকে ধমকাচ্ছে। না, আনারস চুরি করে খাওয়ার অপরাধে নয়; আনারস চুরি করে খাচ্ছি, এটা প্রায় অন্ধ লোকটি দূর থেকে ঠাহর করতে পারেনি। সে আমাদেরকে ধমকাচ্ছিল গরু চরানোর অপরাধে!

আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম বেশ ক’টা গরু চরছে। লিচুর সাদা অংশের মতো দেখতে মোটা ঘোলাটে কাচের চশমার খ্যাংড়াকাঠি বৃদ্ধ লোকটি আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছিল। পরনে ঢোলা প্যান্ট, ততোধিক ঢোলা শার্ট। অর্ধভুক্ত আনারস ফেলে লোকটির কাছে এগিয়ে গেলাম। লোকটি বলছিল: ‘আমার গরু কী খাবে? এটা আমার গরু চরানোর জায়গা। নিয়ে যাও, নিয়ে যাও তোমাদের গরু।’ (এর সাদা মানে দাঁড়ালÑআমি আর আলম রাখাল, আর অবৈধভাবে আমাদের গরু নিয়ে এসে লোকটির খেতে চরাচ্ছি)।

বললাম, আমরা বেড়াতে এসেছি। গরু চরাচ্ছি না। লোকটি আরও কাছে এসে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে দেখার মতো আমাদেরকে দেখল। তারপর কিছুটা শান্ত হলেও তখনও গজগজ করছিল। সে চাচ্ছিল না আমরা স্থানটায় বেশিক্ষণ অপেক্ষা করি। বললাম, ‘আনারস বাগানটা কি আপনার?’
‘তো! কার আবার?’ খেঁকিয়ে উঠল বৃদ্ধ, ‘এখানে যা কিছু আছে সব আমার।’

স্থানটা আমাদের জন্য তেমন একটা সুবিধের হবে না ভেবে আমি আর আলম চম্পট দিলাম। তবে বৃদ্ধ’র আনারস বাগানের বেশ ক’টি আনারস উপড়ে ফেলে পায়ে মাড়িয়ে তারপর দ্রুত ছুটে গেলাম। পেছন থেকে হৃদয় বিদীর্ণ করা চিৎকার শুনতে পেলাম- ‘গেল, গেল। সব গেল।’ এদিকে আমরা প্রায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বাসস্টপে এসে তবে হাঁপ ছাড়লাম।

যদিও এটা একটা ছোট্ট ভ্রমণ ছিল আর তা নেহায়েতই খেয়ালীপনা ছিল, তবুও কিছুটা জ্ঞান সঞ্চিত হলো। প্রমাণিত হলো যে, লোকটাই গরু আর আমরা রাখাল বালক নই।

ভ্রমণ জীবনের একটি অংশ। ভ্রমণের মাধ্যমে জীবনকে জানা যায়। ভ্রমণের স্বরূপ উপলব্ধি করা এবং সেসবের আলোকে নিজের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রোথিত করা যায়। ভ্রমণ হলো জীবনকে জানার প্রতি একটা হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ। এখানে একটি বিষয় খোলাসা করে বলে ফেলা ভালো যে, জীবনকে সঠিকভাবে এখনো উপলব্ধি করতে পারিনি আমি, হয়তো বা তা সম্ভবও নয়। জীবনের যে দিকটি রহস্যাবৃত বা আমার জানা নেই, সেসব নিয়ে আমি নাড়াচাড়া করিনি। যা জানি তা নিয়েই আলোকপাত করি।

ভ্রমণ বলতে কেউ কক্সবাজারে গেল এবং তার একটি জরুরি কাজ সেরে ফিরে এলো-সেটা বুঝায় না। ভ্রমণের আরও কিছু উদ্দেশ্য থাকে। ভ্রমণ হলো একটি প্যাকেজ ডিল। সশরীরে গমন করে চোখ, নাক, কান নামের তিনটি ইন্দ্রিয়ের সর্বোত্তম ব্যবহার ও মানসপটের বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিপক্কতা অর্জন। আমার ভাগ্যে সুন্দরবনের চারটি পয়েন্ট দিয়ে চারবার সুন্দরবন দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সুন্দরবন স্বচক্ষে দেখে আসার পর থেকে আমার মনে হয়েছে যে, সুন্দরবন সম্পর্কে আমি মহাকাব্য রচনা করে ফেলতে পারব। জীবদ্দশায় সময়-সুযোগ পেলে হয়তো আমি সুন্দরবন সম্পর্কে লিখে যাবো।

সুন্দরবনের প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল তখন সুন্দরবনের ওপর খানিকটা আলোকপাত করার লোভ সামলাতে পারছি না। বেশি কিছু বলার অবকাশ নেই। কেননা সুন্দরবন ভ্রমণের কিছু বিবরণ ইতোমধ্যেই আমি ‘বালুকা বেলা’য় বয়ান করেছি। সুন্দরবনের গল্প বা প্রসঙ্গটিকে আচারের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। দেখলে তো বটেই এমনকি নাম শুনলেও জিভে জল এসে যায়। তাই গল্পে বা আড্ডায় সুন্দরবনের প্রসঙ্গ এলে আনমনা হয়ে পড়ি। একইসাথে মুখিয়ে থাকি সুন্দরবন সম্পর্কে মনের ভাব প্রকাশ করতে। বাংলাদেশ অনেক দিক থেকে ভাগ্যবান। এই দেশে আছে বিশ্বের দীর্ঘতম সাগরসৈকত, আছে স্বল্পপরিসরের ভৌগোলিক এলাকায় সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র। আছে কুয়াকাটার মতো স্থান, যেখানে অবস্থান করে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়-দু’টিই দেখা যায়। আছে সুন্দরবন যা পৃথিবীর দীর্ঘতম ম্যানগ্রোভ বা পেরা বন। সুন্দরবন ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বীকৃতি লাভ করেছে।

আছে নানা প্রত্নতাত্তি¡ক নির্দশন। সুন্দরবন প্রায়ই উঠে আসে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের তালিকায়। সুন্দরবনকে বা কক্সবাজারকে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় রাখতে বা সর্বোচ্চ অবস্থানে নিতে ব্যাপক ভোট প্রদানের একটা প্রথা চলে আসছে। কিন্তু এই দু’টি নৈসর্গিক ক্ষেত্র চরম হুমকির মুখে। ভোটাভুটির পাশাপাশি এই দিকটাও আমাদেরকে ভাবতে হবে।

আজ এই পর্যন্তই। সামনের সংখ্যার লেখায় ভ্রমণবিষয়ক কিছু থাকবে না; থাকবে অন্যকিছু। সেটা কী, তা বালুকা বেলায় বিচরণ করতে করতে ভেবে নেবো।