হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

আজ সামান্য একটু স্মৃতিচারণ। আমার ক্যানেডায় আগমণের প্রথমদিকের ঘটনা।
ড্যানফোর্থ থেকে ফিরছিলাম। বাসায়, সাথে জাফর। সে ঢুকে যাবে সাবওয়েতে। আর আমি আসব বাসায়। কথায় আছে-‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।’ আমার অবস্থাও তাই। ক্যানেডায় এসেছি একবছর হলো। ওই এক নায়াগ্রা ছাড়া কোনো উল্লেখযোগ্য স্থানে যাওয়া হলো না বা দূরগমণও হলো না। ড্যানফোর্থে কেন যাই? কেনাকাটা করতে, চা-কফি পান করতে বা ‘আড্ডা’ দিতে। এখানে আমার দুয়েকজন নতুন বন্ধু হয়েছে। তাছাড়া, ড্যানফোর্থের বিশাল শপারস’ ওয়র্ল্ড চত্বর কেনাকাটার জন্য, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য একটি স্বর্গরাজ্য। শপারস’ ওয়র্ল্ড ও ড্যানফোর্থের বাংলাদেশি দোকানপাট ও অন্যান্য গ্রোসারি বা সুপারস্টোর সবধরনের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম এবং কেনাকাটা সারার জন্য আদর্শস্থানীয়।
আমাদের ক্রেসেন্ট প্লেসের ভেতরেই তো রয়েছে বিশাল সুপারস্টোর হ্যাস্টি মার্কেট (এখন অন্য নাম), রেস্তোরাঁ, কমিউনিটি সেন্টার, সুইমিংপুল, ডাক্তার, সুপার ড্রাগ, ডেন্টিস্টসহ আরো কতো কী এবং কে। আমাদের বসবাসের এলাকাটাকে প্রয়োজনীয় জিনিসপ্রাপ্তি, যোগাযোগ প্রভৃতির একটি হাব বলা যেতে পারে। একদিকে সাবওয়ে, বাসস্টপ, অন্যদিকে বাঙালি দোকানপাড়া আর শপারস’ ওয়র্ল্ড-এর ভেতরে মেট্রো, ডলারামা, জেলারস (বর্তমানে টার্গেট), স্ট্যাপল্স, শপারস’ ড্রাগমার্টসহ অসংখ্য স্টোর ও ফ্যাসিলিটিস। শপারস’ ওয়র্ল্ড-এর বাইরে, কিন্তু ধারেকাছে আছে ফ্রেশকো, লব ল’জ ইত্যাদি।

কথার পিঠে কথা আসে। তাই মূল প্রসঙ্গটিও পিছিয়ে যায়। কথা হচ্ছিল, আমি আর জাফর ফিরছিলাম। জাফর আমার বন্ধু। পাকিস্তানি। ভালো মনের মানুষ। এখানে যে কয়েকজন শুভাকাক্সক্ষী আমার আছে, জাফর তাদের অন্যতম। আমাদের বন্ধুত্ব রাজনীতি, ভিন্ন্ দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্ন কালচার বা ভিন্ন ভাষার উর্ধ্বে। ¯্রফে বন্ধুত্ব। জেলারস-এর ভেতরে অবস্থিত বেল-ক্যানেডা’র একটি ডিলার আউটলেটে কাজ করে জাফর। সেলফোন কিনতে গিয়ে একবছর আগে জাফরের সাথে পরিচয়। জাফর আগে ডিলার আউটলেটে ফুলটাইম কাজ করত। এখন উইকএন্ডে কাজ করে। সে পড়াশোনায় ঢুকে গেছে।
চারবছর আগে ক্যানেডায় আসে স্ত্রী-পুত্রসহ। থাকে স্কারবরোতে নিজের কন্ডোতে। গাড়ি আছে। রোজগারও ভালোই করে। তো আমি সেদিন জাফরের বেল-স্টোরে কিছু প্রয়োজনীয় কথাবার্তা শেষে কফি ও গল্পে মত্ত হলাম। প্রায় প্রতি উইকএন্ডেই জাফরের সাথে মুলাকাত হয় আমার। গল্পে-গল্পে অনেকসময় ছয়টা বেজে যায়, তখন আমরা একসাথে বের হই।

জাফর কিছুদিন হলো গাড়ি ব্যবহার করছে না। আমার সাথে আসে সাবওয়ে ট্রেন ধরার জন্য। সাবওয়েতে জাফরকে দিয়ে আমি বাসায় আসি। এরকমটাই ঘটে আসছে কিছুদিন যাবৎ। আগে অন্য চিত্র ছিল। জাফর তার গাড়িতে আমাকে আমাদের বিল্ডিংয়ে নামিয়ে দিয়ে তারপর যেত। যাই হোক, হাঁটছিলাম দু’জন। মাঠের ধার ঘেঁষে। জাফরকে বললাম, বসবে নাকি কিছুক্ষণ, বেশ গরম পড়েছে। জাফরেরও তেমন ইচ্ছে। কিন্তু আমাদের বসার পাথরের চেয়ার-টেবিল দখল করে আছে একজন। মাঝখানে টেবিল, দুইদিকে দুইটা চেয়ার। এমন দুইজোড়া আছে, রাস্তার দিকটায়। দুই জোড়াই দখল হয়ে আছে। একটায় এক বুড়ো, অন্যটায় এক জোয়ান। আমরা বারবার সেদিকে তাকাচ্ছি দেখে জোয়ান লোকটা বলল, তোমরা চাইলে বসতে পারো। বসলাম। একদিকের একটা চেয়ারে আমি আর জাফর ভাগাভাগি করে বসলাম। মাঠের প্রান্তে, গাছতলায় এই স্থানটা যতটা ঠাণ্ডা, ঠিক ততটাই গরম রোদের অংশে।

লোকটাকে দেখে আমার কাছে মজার মনে হলো। দেখতে ছোটোখাটো। লোকটা জানাল, তার নাম টনি, আদতে সে জ্যামাইকার অধিবাসী আর তেরো বছর বয়স থেকে ক্যানেডায় আছে। তবে কথাবার্তায় বুঝা গেল সে খুব শিক্ষিত নয় আর কোনোরকম ঠাঁটবাটও নেই তার। খুবই সাদাসিধে আর নিরীহগোছের। আমি আর জাফর নানা রসালো আলোচনায় মত্ত হলাম। আমাদের আলোচনা শুরু হলো ইয়োরো কাপ-২০১২ দিয়ে, শেষ হলো ব্যাম্বু দিয়ে। আমি সিগারেট বের করলাম। টনি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে জানাল যে, সে সিগারেটে অ্যালার্জিক। আমি বললাম, তাহলে তোমার ওই জায়গামতো ব্যাম্বু আর দিতে চাই না। টনি ব্যাম্বু জিনিসটা বুঝল আর এর ব্যবহারটাও সে জানে রীতিমতো। মজা পেল সে। বলল, লাইফ ইজ আ ব্যাম্বু।

পাশ থেকে জাফর বলল, বিভিন্ন ধরনের ব্যাম্বু আছে। সাম আর ভেরি পেইনফুল। আমি বললাম, আমরা বাংলাদেশিরা খুব ভাগ্যবান। আমাদের দেশে অনেক ব্যাম্বু জন্মে। জানালাম, মুলি বাঁশ, আইক্কা বাঁশ, তল্লা বাঁশ, হল্লা বাঁশ, বরাক বাঁশ প্রভৃতি। টনি হাসতে হাসতে বলতে লাগল, অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া একটা বাঁশ, কেনাকাটা মানে বাঁশ। তাই মাঝেমধ্যে এখানে এসে বসি। বাইবেল পড়ি আর চার্চে যাই। বললাম, সেটাই ভালো। বাঁশ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। সবশেষে আব্বার বলা বাঁশ হাতে এক পাগলের মুখোমুখি হবার গল্পটা বললাম। জাফর বোধহয় ক্যানেডা আসার পর এত মজার কাহিনি শোনেনি। সে প্রাণভরে হাসতে লাগল।

গল্পটা হলো (সত্যিকারের কাহিনি) আব্বা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে গাঁয়ে এলেন বেড়াতে। পোশাকে-ব্যক্তিত্বে তিনি জবরদস্ত একজন। তিনি একটা খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ কোত্থেকে এক পাগল এসে সামনে পড়ল। সে আব্বার দিকে তাকিয়ে স্থানীয় ভাষায় বলল, ‘দুনিয়াডা কার রে?’ আব্বা কিছু বলছেন না দেখে পাগলটা বুক ঠুকে বলল, ‘আমার আমার।’
আব্বা সামনে পড়ে থাকা একখণ্ড বাঁশের টুকরো নিয়ে পাগলটাকে দৌড়ানি দিলেন। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পাগল বলল, অর্ধেকটা তর।’ আব্বা থামলেন।
পরে আব্বা আমাদেরকে বলেছিলেন- ‘এক দৌড়ানিতে অর্ধেকটা দিয়ে দিল, আরেকটা দিলে বোধহয় পুরোটাই দিয়ে দিত।’