হাসান জাহিদ : কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

কানাডায় একটি কথা খুব চালু? পেয়িং থ্রু দ্য নোজ (Paying through the nose)। এটার সাথে সম্পর্কিত আরেকটি কথা রিপ অফ (Rip off). এই দু’টি কথাই একটার পিঠে আরেকটা আসতে পারে। প্রথমটির মানে হলো চরম মূল্য দেয়া, মানে পকেট থেকে বেশকিছু মালপানি বেহুদা খরচ হয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়টির মানে ঠকে যাওয়া-কোনোকিছু কিনে ঠকে যাওয়ার অনুভূতি বা এরকম মনে করা যে দোকানি কারুর কাছ থেকে বেশি মূল্য রেখেছে। এই বহুলপ্রচলিত দুইটি কথার অভিধানগত মানে বললাম না এখানে; কেবল ভাবগত অর্থ বললাম যাতে আমার পরিস্থিতিটা পাঠকেরা উপলব্ধি করতে পারেন।

আমাদের ক্লাসে প্রফেসর ডেভ একদিন আমার হাতে একটা ফোল্ডার ধরিয়ে দিলেন। তাতে দুনিয়ার কাগজপত্র। অন্টারিও মিউজিয়াম অ্যাসোসিয়েশন-এর মেম্বারশিপ। ওএমএ’র মেম্বার হলাম। ক’দিন পর জানলাম ওএমএ কনফারেন্সে যোগ দিতে হবে। ১৫-১৭ অক্টোবর ২০১৪ কনফারেন্স। স্থান নটাওয়াসাগা ইন, অ্যালিস্টন, সিমকো কাউন্টি। টরোন্টো থেকে ১০০ কি.মি. দূরত্বে। দূরত্ব এতখানি আমার জানা ছিল না; বেশ দূরে সেটা বুঝেছিলাম। তবে চিন্তিত হইনি। কারণ ডেভ (আমাদের টিচার) ক্লাসে চমৎকার সমাধান দিয়েছিলেন। ক্লাসের জোয়ানার সাথে তিনি আমাকে ট্যাগ করে দিলেন। জোয়ানা পরে আমাকে ওর সেলফোন নাম্বার দিয়েছিল।

১৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার আমাদের যাবার দিন। অনেকটা সময় হাতে ছিল। সুতরাং সেটা নিয়ে ভাবলাম না। কিন্ত বিপত্তি ঘটল আগের দিন। অন্যান্য অ্যাসাইনমেন্ট, পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে ভুলেই গিয়েছিলাম। যখন মনে পড়ল রাত সাড়ে দশটা তখন। জোয়ানাকে মেইল করলাম, পরে ফোন করলাম। ফোন কেউ ধরল না। টেক্সট করলাম, তা-ও জবাব এলো না। দ্বিতীয়বারের টেক্সটের রিপ্লাই এলো: এটা জোয়ানার নাম্বার না। সাংঘাতিক চিপার মধ্যে পড়ে গেলাম-এখন কী করি? একমাত্র ভরসা ইমেইল, কিন্তু জোয়ানা যদি মেইল চেক না করে? পরদিন ভোরে রওনা হতে হবে বলে সে যদি আগেভাগে ঘুমিয়ে পড়ে? তা-ই হলো; উত্তর পেলাম না।

উৎকন্ঠা নিয়েই অনেকরাতে ঘুমোতে গেলাম। আমাদের রওনা দেবার কথা সকাল সাড়ে ছ’টায়। মানে ভোরে চারটায় জেগে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে রওনা দিয়ে স্ক্যারবরো টাউন সেন্টারে পৌঁছুতে হবে সাড়ে ছ’টার মধ্যে। কনফারেন্স শুরু হবে সকাল সাড়ে আটটায়। সেখানে পৌঁছানোর জন্য দুইঘন্টা ধরা হয়েছে। কিন্তু আমি অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম ভোর সাড়ে ছ’টায়, যেহেতু জোয়ানার সাথে আমার যোগাযোগ হয়নি।

ঠিক সাড়ে ছ’টায় অ্যালার্ম বাজল এবং জোয়ানার ফোন এলো। অনেকটা ঘুমের ঘোরেই জোয়ানার সাথে কথা বললাম। কোনো জটিলতায় না গিয়ে জোয়ানাকে বললাম চলে যেতে, আমি পরে যোগ দেব।

বললাম তো যোগ দেব, কিন্তু কীভাবে? শেষে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই রেডি হতে লাগলাম। একঘন্টায় রেডি হয়ে সাড়ে সাতটায় ড্যানফোর্থে এলাম। সারি সারি ট্যাক্সি ক্যাব দাঁড়ানো ছিল। একটাকে ঠিকানা বললাম। সে যেতে রাজি হলো। উঠলাম ক্যাবে, প্রথমে এলাম টিডি ব্যাংকে। আমার পকেটে ছিল কুড়ি ডলার। আরো একশ’ পঞ্চাশ ডলার উঠালাম ম্যাশিন থেকে। ভেবেছিলাম, ওখানে যেতে হয়তো এক-দেড়শ’ ডলার ভাড়া উঠবে। কিন্তু যাত্রার শুরুতেই আঁৎকে উঠলাম। পিক আওয়ার মানে অফিসের সময় হওয়াতে জ্যাম ও স্টপে পড়তে লাগলাম। হু হু করে মিটারে ডলার বাড়তে দেখে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেল। একটা সময় গ্রেটার টরোন্টো এরিয়া (জিটিএ) পার হয়ে গাড়ি চলল কান্ট্রিরোড (হাইওয়ে) ধরে। সিমকো কাউন্টির ভেতরে ঢুকলাম। দুইপাশে কুয়াশা ঢাকা গাছ, খেতখামার, খড় ও ফার্ম। যেতে হবে নটাওয়াসাগা-সেটা কোন্ চুলোয় কে জানে। আমার যাত্রার যেন শেষ ছিল না।

ঘোরের মধ্যে চলে একসময় পৌঁছুলাম নটাওয়াসাগা ইন-এ। প্রথমত ভাড়া দেখে ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, দ্বিতীয়ত নয়া এক বিপত্তি দেখা দিল। ভাড়া উঠল দুইশ’ এগারো ডলার! মানে বাংলাদেশের টাকায় পনেরো হাজার একশত বিরানব্বুই টাকা (সেই সময়)। একস্থান থেকে আরেকস্থানে যেতে পনেরো হাজার টাকার ওপর! একবার মনে হলো নিজের পায়ে কুড়াল মারলাম। পরমুহূর্তে মনে হলো, এরকম একটা কনফারেন্সের জন্য দুইশ’ ডলার কেন, চারশত ডলার খরচা করা যেতে পারে। আসলে মনকে সান্ত¦না দিচ্ছিলাম।
আমার পকেটে সাকূল্যে ছিল একশত সত্তর ডলার। সেটা ড্রাইভারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাকিটা দেবার জন্য আমি ডেবিট কার্ড বের করলাম। ইতোমধ্যে আমি একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম। পাকিস্তানি ড্রাইভার সেটা দেখে বলল, তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন। গাড়িতে বসেই তো তুমি খেতে পারতে। আমি বললাম, বেশি দেরি করতে পারছি না। তুমি তোমার ম্যাশিনের মাধ্যমে বাকি টাকাটা গ্রহণ করো। ড্রাইভার কিছুক্ষণ তার ডেবিট ম্যাশিন নড়াচড়া করে তারপর জানাল যে সে নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না। মহা মুসিবতে পড়লাম। তারপর তাকে আমার সেলফোন নাম্বার দিলাম এবং তার সেলফোন নাম্বার নিলাম। জানালাম, তুমি ড্যানফোর্থে থাকলে তো ভালোই, না থাকলে আমাদের সেভেন ক্রেসেন্ট প্লেসে এসে বাকি টাকাটা নিয়ে যেয়ো।

নটাওয়াসাগা ইনের রাজকীয় পরিবেশ ও আয়োজন দেখে কিছুক্ষণের জন্য হলেও টাকার শোক ভুলে গেলাম। নটাওয়াসাগা ভ্যালিতে অবারিত খোলামেলা স্থানে এটি অবস্থিত। একদিকে, নিচু ঢালুতে গলফ কোর্স আর অন্যদিকে হাইওয়ে, তারপর দিগন্ত, বাকি একদিকে বিশাল জলাশয় ও অন্যদিকে গ্রাম ও ফার্মহাউস। এর পুরো নাম নটাওয়াসাগা ইন রিসোর্ট অ্যান্ড কনফারেন্স সেন্টার। এখানে রেইন ফরেস্টের আবহে তৈরি একটা বিশাল সুইমিংপুল আছে।

আমরা শুধু কনফারেন্সে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। এই রিসোর্ট, অত্যাধুনিক ফ্যাসিলিটিস আর এর নির্মাণশৈলী, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন বা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি দেখার সুযোগ আমাদের ছিল না। সেটা উদ্দেশ্যও নয়। সাড়ে আটটা থেকে বিকেল পাঁটটা পর্যন্ত (লাঞ্চটাইম ও কয়েকটি ব্রেক বাদ দিয়ে) টানা প্রোগ্রাম।

যাইহোক, কনফারেন্স রুমে আমার বন্ধুদের দেখতে পেলাম। ওরা কিছুটা অবাক হলো। আমাকে আশাই করেনি ওরা; কারণ আমি জোয়ানার সাথে আসিনি। শাহনাজ আমাকে প্রথম দেখতে পেয়ে বলল-‘ইয়্যূ মেড ইট!’

খাবারের বৈচিত্র্যময় আয়োজন ছিল। গোটা কনফারেন্স ও প্রশ্নোত্তর পর্বে ভালোভাবেই পার্টিসিপেইট করলাম। তারপর তো আসার সময় জোয়ানার সাথে ওর গাড়িতে গল্প করতে করতে চলে এলাম টরোন্টো। চমৎকার ড্রাইভ করে জোয়ানা। ও আমাকে স্ক্যারবরো টাউন সেন্টারে নামিয়ে দিল। আমার কাছে মান্থলি পাস ছিল; আর.টি. সাবওয়ে ট্রেনে চেপে অবশেষে বাসায় ফিরলাম।

একদিন পর পাকিস্তানি সেই ড্রাইভার বাজওয়াকে ফোন করেছিলাম। বাজওয়া এসে টাকাটা নিয়ে গিয়েছিল। আমি তাকে দশ ডলার বেশি দিয়েছিলাম।

একটু ঠকে গিয়েছিলাম পয়সার মাপকাঠিতে। তবে পরে লাভ হলো; আর্থিক কোনো ফায়দা নয়। মাথাটা কাটা যায়নি আরকি। কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ প্রোগ্রামের অন্তত একটা কোর্সের পাস-ফেইল নির্ভর করছিল এই কনফারেন্সে যোগদান আর এর ওপর আমার রিপোর্ট ও অংশগ্রহণ।