হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিত্সু ক্যানভাস।

একটা সময় সুন্দরবন আমাকে নেশার মতো আকর্ষণ করতে লাগল। খুলনায় থাকতে আমি এক বা দুই উইকএন্ড পরপর ঢাকায় আসতাম। প্রতি উইকএন্ডে আসা সম্ভব হতো না। আসতে ইচ্ছে করত কিন্তু খরচ, শারীরিক কারণ ও অফিসিয়্যাল প্রয়োজন প্রভৃতি কারণে আসা হতো না। আসার বিষয়ে প্রস্তুতিও তো কম লাগে না। অনেককিছুর হিসাব কষতে হতো। প্রথম হিসাব করতাম কয়দিন ছুটি কাটাতে পারব। তারপর সাথে কত টাকা নিয়ে যেতে পারব- তাতে পোষাবে কিনা। খুলনা থেকে ঢাকায় আসবার সময় ভেতরে আনন্দপ্রবাহ বইত। ঠিক বিপরীত ব্যাপার ঘটত খুলনার উদ্দেশে রওনা দেবার সময়। নিজকে খুব অসহায় লাগত আর খুব মন খারাপ হতো। যে উইকএন্ডে আমি ঢাকায় রওনা দিতাম সেসময় সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল বিষয় ছিল ছুটি। তবে কোনো কারণে শুক্র-শনির আগে পরে সরকারি ছুটি থাকলে অফিস ফাঁকা হয়ে যেত। তেমনটি তো আর সবসময় ঘটত না। তাই হিসেব করতে হতো। আমি সাধারণত বৃহস্পতিবার সকালে অফিস করেই নতুন রাস্তার মোড়ে ঈগল কাউন্টারে চলে আসতাম। সেখানে মোস্তফা আমার লাগেজ নিয়ে অপেক্ষা করত। আগের দিন মোস্তফা টিকেট কেটে রাখত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যানাগাদ ঢাকায় পৌঁছুতে পারলে স্বস্তি পেতাম। রবিবার আর সোমবার দুইদিনের ছুটি নিতাম। এখন মঙ্গলবার অফিস করতে হলে সোমবারই রওনা দেয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু কেউ তা করত না। আমিও ব্যতিক্রম নই। রওনা দিতাম মঙ্গলবারেই। খুলনায় নতুন রাস্তার মোড়ে নেমে রিকশায় করে সোজা অফিসে হাজিরা দিতাম, সেটা দুপুর হোক আর বিকেল হোক।

মাঝেমধ্যে জিএমজি এয়ারলাইনসে ঢাকায় আসতাম। ওদের এসি মাইক্রোবাসে যশোর আসতাম। যশোর থেকে সোজা ঢাকায়। আমার ভাগ্নে তখন জিএমজি এয়ারলাইনসে চাকরি করত। সেই সুবাদে খুলনা থেকে যশোর আসতে মাইক্রোবাসের টাকা আমাকে দিতে হতো না।

তো একবার উইকএন্ড কাটাচ্ছি খুলনাতেই, কিন্তু ভালো লাগল না। মোবাইল ফোনে মোস্তফাকে ডেকে আনলাম বাসায়। তারপর প্ল্যান করতে বসে গেলাম। মোস্তফা বৃদ্ধ কিন্তু কর্মঠ, বুদ্ধিমান ও চটপটে। কোনো অজানা কারণে তার চাকরি থেকে অবসর নেয়ার বয়স অনেকবছর যাবতই হচ্ছিল না! মোস্তফাকে জানালাম পরদিন সকালে (শনিবার) করমজল যাব। ব্যস, সাথে সাথে সে বুঝে গেল কী করতে হবে। জানাল যে সকালে নাশতা সেরে ন’টার মধ্যেই আমার বাসায় এসে হাজির হবে। আমি রাতেই ক্যামেরায় ফিল্ম লোড করে রাখলাম। খুব স্পেশাল উপলক্ষ না হলে ডিজিটাল ক্যামেরা নিতাম না কোথাও। করমজল যাওয়াটা খুব সহজ। রূপসা থেকে বাসে সোজা মোংলা। যেতে বড়জোর দেড়ঘন্টা।

তারপর মোংলা পৌঁছুলাম একটায়। খুলনা থেকে রওনা দিতে দেরি হয়ে গেছিল। মোংলায় গিয়ে রুইমাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম একটা রেস্তরাঁয়। তারপর গেলাম ইঞ্জিন নৌকার জেটিতে। কত বাহারি নৌকা যে সেখানে! কোনোটা ময়ূরপক্সক্ষী নাও, কোনোটা লঞ্চের মতো দেখতে। কোনোটা আবার স্পিডবোটের মতো। বেশিরভাগ নৌকাই রং মেখে মেকআপ করে পানিতে বসে দুলছে। মোস্তফা ইঞ্জিন নৌকার ড্রাইভারদের সাথে শুরু করল প্যাঁচাল। এরা নতুন লোক পেলে ঠকায়। কিন্তু মোস্তফার সাথে এরা খুব একটা সুবিধা করতে পারল না। মোস্তফা যে নতুন লোক না, আর তেমন সুবিধারও না, সেটা তারা বুঝতে পারলেও তর্কে ওস্তাদ তারা। ওদের সাথে মোস্তফার কথোপকথনের কিছু অংশ তুলে ধরছি। মোস্তফার বাড়ি গোপালগঞ্জে কিন্তু সে খুলনায় বসবাস করছে বহুকাল ধরে। একজন সাতশ’ টাকা চাইল। মোস্তফা বলল, ‘তর আব্বায় শতে শতে টাহা দিয়া রাখছে আমার কাছে। আমি তরে সাতশ টাহা দিই।’

‘তাইলে কত দিবেন?’
‘দুইশ টাহা দিবানে। বেলা বেলা ফিরা আসব।’
‘দুইশ টাহায় ইঞ্জিনের নাও পাইবেন না জ্যাডা। ডিঙ্গিতে যান, কাইল সকাল সকাল করমজল দিয়া আসবেনে।’
‘তর নৌকায় করমজল যাব না নে, বেয়াদব।’

মোস্তফা এরপর অন্য একটি ইঞ্জিন নৌকা ঠিক করল। এটা নেবে সাড়ে তিনশ’ টাকা। বিকেল পর্যন্ত সে থাকবে। তারপর ফিরে আসবে। বেশি থাকতে হলে প্রতিঘন্টায় বাড়তি একশ’ টাকা করে দিতে হবে। আমরা উঠে পড়লাম নৌকায়। যথাসময়ে পৌঁছেও গেলাম করমজলে। আমি আর মোস্তফা কাঠের ব্রিজে চড়ে একবার সোজা শেষ মাথায় যাই আবার ফিরে এসে ব্রিজের আরেকটি শাখা দিয়ে শেষ সীমানায় যাই। ছবি তুলে চললাম। তারপর গেলাম কুমির প্রজনন কেন্দ্রে। বড় বড় দীঘি ঘুরে, জঙ্গলের কিনারা দিয়ে ঘুরে আবার ফিরে এলাম ব্রিজে। ব্রিজের দুইপাশে জঙ্গলের ভেতরে চিতল হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা আর বানরের দল নানারকম খাবারের লোভে মানুষের খুব কাছাকাছি চলে আসে। এরপর দু’জন আবার গেলাম ব্রিজের শেষ মাথায়। আমি নেমে পড়লাম সুন্দরবনের বুকে। ছাই রঙের কাদাতে বালু মাটি। এখানে একটা খাল বয়ে গেছে। তখন ভাটার সময়। খালে অল্প পানি, খালের ধারগুলোতে অসংখ্য মাডস্কিপার তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে। এগুলো দেখতে ছোটো বেলে মাছের মতো। চোখ দু’টি বড় বড়, যেন পুরোনো আমলের গাড়ির বাইরে বের করা গোল হেডলাইট। তারপর আমরা কিছুটা হেঁটে গিয়ে অসমাপ্ত টাওয়ারের ওপর উঠে গেলাম। লক্ষ্য করলাম ব্রিজের ওপর আর তার আশেপাশে মানুষজনের কোলাহলে মুখর অথচ সামান্য দূরে এই জায়গাটার নির্জনতা আর শব্দহীনতা শরীরে কাঁটা দেয়। একটা ১৫-২০ জনের দলকে দেখলাম জঙ্গলের গভীরে ঢুকে যেতে। মোস্তফা বলল, ‘শুনছেন! কয়দিন ধইরা একটা বাঘিনী নাকি ক্ষেপছে। সাথে বাচ্চা আছে দুইটা।’ বললাম, ‘ওটা বাঘিনীর গর্জন না। কেউ হয়তো শয়তানি করছে।’ আর কোনো কথা বলল না মোস্তফা। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে নেমে এলাম নিচে। ওপর থেকে মোস্তফা চিল্লাচ্ছে, ‘যা ভালো বুঝেন করেন, আমি নাই।’

মোস্তফার বারণে কান দিলাম না। দুই ধারের মাথাসমান ঝোপঝাড়ের মাঝখানের চলার পথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। চারপাশে ঝাঁ-ঝাঁ নিস্তব্ধতা। শুধু বড় বড় কেওড়া, গেওয়া আর জানা গাছের শাখা আর পত্র আন্দোলিত হচ্ছে সাঁই সাঁই শব্দে। বানরের দল খেলায় মেতেছে। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চললাম। কেন চললাম জানি না। চলতে চলতে একসময় থামলাম। ভ্যাপসা গরমে হাঁপিয়ে উঠেছি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আর যাওয়াটা সমীচিন হবে না মনে করে ফিরতি পথ ধরলাম।

কিন্তু এ কী! কোথায় যাচ্ছি! সব তো একই রকম লাগছে। কুলকুল করে ঘামের ধারা নামল শরীর বেয়ে। বুঝতে পারলাম পথ হারিয়েছি। অনেক কষ্টে চিত্কার করে মোস্তফাকে ডাকা থেকে বিরত হলাম। আশেপাশে বাঘ থেকে থাকলে আমার ডাকে আকর্ষিত হয়ে চলে আসতে পারে। সবগুলো পথ একই রকম লাগল, মনে হলো ওই তিন কোণা আকৃতির ঝোপের মোড়টা দিয়ে এসেছিলাম। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখি এই মোড়ের পথটা গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেছে। আমার সমস্যা হলো আমি দিক নির্ণয় করতে পারি না।

একটা সময় অনুভব করলাম আমার পা দু’খানা আর চলতে চাচ্ছে না! মনে হলো, অনন্তকাল ধরে এখানে অবস্থান করছি। আমার হাতে একটা লাঠি ছিল, সেটাও পড়ে গেল হাত থেকে। লাঠিটা উঠাতে আর সাহস পেলাম না। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করে বলছি আমি যেন জ্ঞান না হারাই। প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছে এই বুঝি বাঘটা এগিয়ে আসছে। হালকা চালে, দুলেদুলে আসছে আমার দিকে। অতিকষ্টে কান্না দমন করলাম। একসময় মনে হলো একদিকে হাঁটা ধরি, কোথাও না কোথাও তো পৌঁছুবই। যদিও কোনোরকম শব্দ আসছিল না কোথাও থেকে, তবুও কান পেতে শুনলাম। মনে হলো অতি ক্ষীণ কোনো শব্দ যেন বাতাসে ভেসে আসছে।

যেদিক থেকে শব্দ ভেসে আসছে মনে করছি, সেদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। অতি ধীরে। শ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছি। একসময় দেখতে পেলাম জিনিসটা। মনে হলো মাটিতে গড়াগড়ি দিই। না, ভয়ে না। আনন্দে। আমি টাওয়ারের একটা অংশ দেখতে পেলাম। সেদিকে থেকে চোখ ফেরাচ্ছি না। যদি টাওয়ারটা অদৃশ্য হয়ে যায়! তবে পিঠ শিরশির করছিল, আর হৃত্পিণ্ড ধপাস ধপাস করে লাফাচ্ছিল যদি পেছন থেকে বাঘ লাফিয়ে পড়ে, সেই আতঙ্কে। তার সম্ভাবনাই বেশি, বাঘ সাধারণত পেছন দিক থেকেই লাফিয়ে পড়ে। মুখোমুখি কমই আক্রমণ করে। শরীর আর চলছিল না। মনে হচ্ছিল শুয়ে পড়ি। সেটাই করতাম কিন্তু হঠাত দেখলাম পুরো টাওয়ারটাকে। টাওয়ারটার এরকম আকৃতি দেখে অবাক হলাম। টাওয়ারটা তো এরকম ছিল না! আরো কিছুদূর অগ্রসর হবার পর ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আমি যে পথে টাওয়ারটা ফেলে এসেছিলাম, ঠিক সে পথে ফিরে আসিনি। কিছুটা অ্যাঙ্গেল থেকে ফিরেছি।
মোস্তফা তেমনি দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে তার কোনো ভাবান্তর হলো না। শুধু বলল, ‘আমি তো মনে করছিলাম বাঘের পেটে গিয়া সেই কখন হজম হইয়া গেছেন।’
‘সেটা হলে ভালো হতো মোস্তফা?’

‘খারাপটাই বা কী হইত, যার একলা জঙ্গলে ঢোকার সাহস আছে বাঘের পেটে গিয়া শহীদ হইলে ক্ষতি কী? আমি তো কেবল নামতে গেছিলাম এহানকার অফিসে জানাইতে। তারপর ফিরা গিয়া অফিসে জানাইতাম।’
‘সত্যি করে বলো তো মোস্তফা তুমি কী ভাবছিলে?’
‘স্যার, আপনি খুব সাহসী মানুষ। ভাবতাছিলাম, হয়তো পথ হারাইছেন। বাঘের শিকারে আপনার মতো মানুষের মৃত্যু হইতে পারে না। আর আপনার অকাল মৃত্যু হইলে দেশের অনেক ক্ষতি হইব।’

এরপর আমরা ব্রিজের কাছে চলে এলাম। লক্ষ্য করছিলাম, একটা অজানা ভয় মোস্তফাকে গ্রাস করে আছে। চোখে তার তখনও ভীতির চিহ্ন। আমি বললাম, ‘মোস্তফা জলদি। ওই যে আমাদের পিছনে।’ মোস্তফার লাফ দেয়াটা দেখার মতো ছিল। সে এক লাফে ব্রিজে উঠে গেল। এই বয়সে একটা বেঁটে শাদা শশ্রুধারী লোক লাফ দিচ্ছে সেটা যেমন দেখার মতো ছিল, তেমনি গতি ও টাইমিংটা ছিল চমত্কার। বললাম, ‘বান্দরের মতো লাফ দিলা কেন?’ মোস্তফা বলল, ‘ওই যে কী দেহাইলেন!’ একথায় আমি একটু দূরে গাছের পটভূমিকায় দাঁড়ানো হরিণটা দেখিয়ে দিলাম। মোস্তফা সেইদিকে ভালো করে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, ‘ওইডা তো অরিণ।’
দু’জনই হাসতে লাগলাম প্রায় গড়াগড়ি দিয়ে।