হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

শৈশব-কৈশোর-যৌবনে অনেক দুরন্তপনা করেছি। অ্যাডভেঞ্চার তো ব্যাপক হারে করেছি। তবে অনৈতিক কিছু করিনি; সেটা করা ঠিক নয় বাই ডিফল্ট এই বোধটুকু আমার শৈশব থেকেই ছিল। তবে অনিয়ম বা অনৈতিক দুয়েকটি কাজ করে যে ফেলিনি, এমনটা নয়। এটা এমন ছিল যে, দোষ ধরলে দোষ, না ধরলে তেমন কোনো অপরাধ নয়। যে অনৈতিক কাজটা করেছিলাম, সেটা আসলে অনেকটা অনুরোধে ঢেঁকি গিলে এবং কিছুটা চাপে পড়ে।

সেটি সম্ভবত ১৯৮৩ সালের ঘটনা, তখন গোপিবাগে থাকি। মগবাজার এলাকায় একসময় থাকার সুবাদে সেখানে আমার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল, যাদের সাথে আবার আমার প্রয়াত বন্ধু আলম ও শিমুলেরও (যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী) বন্ধুত্ব ছিল। টঙ্গি ডাইভারশন এলাকা, মগবাজার মোড়, নয়াটোলা, এমনকি মধুবাগ এলাকায় ছিল বন্ধু।

এমন বন্ধুদের একজনের শখ জাগল সে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিবে। বিষয়টি আমি জানতে পারি আলমের কাছে। আর যে পরীক্ষার্থী সে আলমকে সাথে নিয়ে আমাকে কনভিন্সড্ করার জন্য কয়েকবার আমার গোপিবাগের বাসায় এসেছিল। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। কিন্তু পরীক্ষার্থী (আমার মাস্তান বন্ধু, নামটা ধরা যাক ‘ক’) কান্নাকাটি শুরু করল।

আসল বিষয়টি বলতেই তো ভুলে গেছি। ক পরীক্ষা দেবে, আর তার সব ব্যবস্থা সে পাকাপোক্ত করে ফেলেছে ঘোড়াশাল জামালপুরের এক কেন্দ্রে, সেখানের এক গাঁয়ে ক-এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বাস করে। ক-এর সেই আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে, পরীক্ষাকেন্দ্রের খুব কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে ইংরেজি প্রথম পত্র ও দ্বিতীয় পত্রের উত্তর ফটাফট লিখে দেব আমি। পরীক্ষার আগের দিন এসে পৌঁছুলাম সেই বাড়িতে। দিনে দিনেই সেরে এলাম আমার অস্থায়ী কার্যালয়ের পরিদর্শন। বেড়া দিয়ে ঘেরা ছোট একটি টং, খেতে পানি দেবার সেচ ম্যাশিনের ঘর। এটিই আমার কার্যালয়। দেখলাম, ক বেশ আঁটঘাঁট বেঁধেই নেমেছে। মোট তিনজন এই মিশনের সদস্য। একজন স্থানীয় ‘গণিতবিদ’ও যোগ দিল। অন্য একজন, পরীক্ষার প্রশ্ন পাওয়া মাত্রই সেটা নিয়ে ছুটে আসবে টংয়ে বসা আমাদের দুইজনের কাছে। আর আমরা কাগজে উত্তর লিখে দিলে বাহক সেটা নিয়ে এক দৌড়ে পৌঁছে দেবে ক-এর কাছে। কাজটায় প্রচুর ঝুঁকি ছিল, মান-সম্মানের বিষয় ছিল। ধরা পড়ার ভয় ছিল। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়–য়া এই আমার জন্য সেটা একটা বড় রকমের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারত। যাক শেষ অব্দি ভালোয় ভালোয় শেষ হলো মিশন।

গ্রামটায় (গ্রামের নাম মনে নেই) এসেই শুনেছিলাম সেখানে শেয়ালের খুব উৎপাত চলছে। পত্রিকায় খবরও এসেছিল দলবদ্ধ কয়েকটি শেয়াল এক গ্রামবাসী পরিবারের জীর্ণ ঘরে ঢুকে পড়ে কামড়ে কয়েকজনকে আহত করেছে। যে রাতে শুনলাম, এই গাঁয়ে প্রচুর শেয়াল আছে, সেইরাত থেকেই আমার মনে হতে লাগল ক একজন শেয়াল পণ্ডিত আর সেই পণ্ডিত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা উতড়াতে শেয়ালী পন্থা অবলম্বন করেছে।

তো যাবার আগের রাতে আমার শেয়াল দেখার ইচ্ছে হলো। মনের কথা খুলে বলতেই ক আমার হাতে একটা বড় টর্চলাইট দিয়ে, গণিত বিশেষজ্ঞকে সাথে দিয়ে দিল। বাড়ির পাশেই আমগাছ ঘেরা টুকরো টুকরো আখ খেতের দিকে চলে গেলাম। দলবদ্ধ কোনো শৃগাল দেখতে পেলাম না। দুয়েকজন পণ্ডিত গোছের সদস্যকে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে দেখলাম খেতের ফাঁকে ফাঁকে। আমাদের উপস্থিতি ও টর্চের আলোয় তারা বিরক্ত বা বিভ্রান্ত হয়ে পলকেই অদৃশ্য হয়ে গেল। যাইহোক মিশন সমাপনান্তে পরদিন ফিরে এলাম ঢাকায়।

আমার সেই একদা এক অনৈতিক কাজ আজও আমাকে পীড়া দেয়। অপরাধবোধে ভুগি। আগামী পর্বে উপহার দিব অন্য এক গল্প। ততদিন ভালো থাকবেন আমার প্রিয় পাঠকেরা।