হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

আমি এর আগে ‘বালুকা বেলা’র কোনো এক কিস্তিতে তারেক ভাইয়ের কথা উল্লেখ করেছিলাম। বলেছিলাম যে, অকালে ঝরে গেছেন তিনি। টরোন্টোতে তারেক ভাইয়ের সান্নিধ্যে অনেক সুন্দর সময় পার করেছি।

কয়েক বছর আগে তিনি লিভার ক্যান্সারে মারা যান। এই তারেক ভাইয়ের সাথে অনেক আনন্দের সময় পার করেছি। তিনি ও তার স্ত্রী আমার এবং আমার স্ত্রীর সিনিয়র হলেও আমরা বন্ধুর মতোই ছিলাম। মূলত স্বপ্না আপার সাথে আমার স্ত্রীর সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। পরে আমরা এই দুই পরিবার একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম।
কোনো এক ঈদ-আনন্দের রেশ ধরে আর তারিক ভাই ও স্বপ্না আপার ম্যারেজ ডে কে কেন্দ্র করে আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম লং ট্রিপে যাব।

সাল ঠিক মনে নেই। তারিখ মনে আছে এজন্য যে, ২২ অগাস্ট ছিল তাদের ম্যারেজ ডে। ২২ অগাস্ট তারিখ মনে থাকার কারণ হলো ২৮ অগাস্ট আমাদের আক্দ দিবস।
আমরা ট্রিপ থেকে ফিরে এসে ২৮ অগাস্ট আমাদের বাসায় আমরা দুই ফ্যামিলি আমাদের আক্দ দিবস পালন করলাম।

যাইহোক, দেখে এলাম পৃথিবীর দীর্ঘতম ফ্রেশওয়াটার সী-বিচ ওয়াসাগা। ২২ তারিখ সকালবেলায় আমরা রওনা দিলাম ওয়াসাগা বিচের উদ্দেশ্যে। টরোন্টো ছাড়িয়ে, অন্য একটি কাউন্টিতে-নাম সিমকো কাউন্টি। টরোন্টো থেকে প্রায় দুইঘন্টা লাগে সেখানে পৌঁছুতে, দূরত্ব ১৩০ কি.মি. বা ৮১ মাইল (ডাউনটাউন থেকে)। আমাদের ক্রেসেন্ট প্লেস থেকে আরো দূরে।

তারেক ভাইয়ের ডজ ক্যারাভানে চড়ে আমরা চারটি প্রাণী-আমরা দুজন আর তারা দুজন বিচে এলাম। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। আমরা কোনো উইকএন্ডে যাইনি সেখানে, তবুও দেখা গেল বহু সংখ্যক বিচ-পাগল মানুষকে। শুনলাম, বিকেলের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে মাতামাতি, উল্লাস, মদ্যপান, সঙ্গীত-নৃত্য। আর নৃত্যের তালে-তালে আলিঙ্গন ও চুর হয়ে পড়ে থাকা। বিচটাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে হোটেল, মোটেল, ইন ও দোকানপাট। তারেক ভাই ক্যানেডা-ডেতে একবার এসে নাকি মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে পিঠটান দিয়েছিল। সেই অবস্থাটা কল্পনা করে আমাদের আগমনের সময়টাতে ছড়ানো-ছিটানো স্বল্পসংখ্যক সাগর-বিলাসীদেরকে দেখে খুশি উঠলাম। এ যে রীতিমতো স্বর্গ হাতে পাওয়া। এইসময়টা (অগাস্টের শেষ পর্যন্ত) মোটামুটি সরব থাকবে বিচ। এরপর সাগর অনুরাগীদের সংখ্যা কমতে থাকবে শীতের আগমনের সাথে সাথে। লক্ষ্য করুন, আমরা মোটামুটি শীতের সময় যাই কক্সবাজারে, আর এখানে সবাই যায় গ্রীষ্মে। কারণ এখানকার ঠান্ডার সময় ভূতেরাও পারতপক্ষে সমুদ্রচারী হতে চায় না।

সিমকো কাউন্টির ওয়াসাগা বিচ একটি শহর। শহরটা মূলত গড়ে উঠেছে সী-বিচকে কেন্দ্র করেই। ১৪ কি.মি. দীর্ঘ সাদা বালিময় এই বিচটি নটাওয়াসাগা বে আর সর্পিল আকৃতির নটাওয়াসাগা নদীজুড়ে অবস্থিত। আন্তর্জাতিক পরিবেশগত মানমাত্রা বজায় রেখে শোরলাইনের দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য ওয়াসাগা বিচ প্রভিন্সিয়াল পার্ক ক্যানেডার ব্লু-ফø্যাগ মর্যাদা পেয়েছে। সত্যিই তাই, রাস্তাঘাট, পার্ক, রিসোর্টস-সব আয়নার মতো পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। আর এই সাগরের (ইনল্যান্ড সী) পানি তো একদম বোতলজাত পানির মতো স্বচ্ছ। তারেক ভাই জিজ্ঞেস করেছিল, ফ্রেশওয়াটার কী? বললাম, মিঠে পানি। সমুদ্রের পানির মতো লবণাক্ত না।

আমরা গাড়িতে খাবার, বিচ চেয়ার, কাঁথা-বালিশ সবই নিয়ে গিয়েছিলাম। আর নিয়ে গিয়েছিলাম পোলাও, রোস্ট, চিকেন টিকিয়া, গোরুর গোশত, বিস্কিট, কোল্ড ড্রিংকস প্রভৃতি। পার্কের উঁচু স্থানে, গাছের ছায়ায়, জঙ্গলের পাশে আমরা চাদর বালিশ, চেয়ার পেতে পেটপুরে দুপুরের খাবার খেলাম। আমি একটি রিমোট নিয়ন্ত্রিত হেলিকপ্টার নিয়ে গিয়েছিলাম।

সেটা উড়ালাম। সেটা হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আকাশ থেকে পড়ল গিয়ে এক আধ-ন্যাংটো বুড়ির পায়ে। বুড়ির সে কি চিৎকার! আসলে বুঝতে পারেনি-আকাশ থেকে পড়েছে তো, তাই। চিকনা বুড়ি বলল, এটা তোমার? আমি চটপট বলে ফেললাম, হ্যাঁ, আশা করি তুমি ব্যথা পাওনি? যলে প্রশস্ত হাসি দিলাম। আর সেই ফাঁকে কপ্টারটা নিয়ে নিলাম।
অজস্র ছবি তুললাম, আমার সেলফোনে, ডিজিটাল ক্যামেরায়, তারেক ভাইয়ের এসএলআর ক্যামেরায় আর স্বপ্না আপার ডিজিটাল ক্যামেরায়।
খাওয়াদাওয়ার পর আমরা প্রত্যেকেই পানিতে নামলাম। আমি শর্টস নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি সাগরের অনেক গভীরে চলে গেলাম। তারেক ভাই পানিতে নামেনি। সেতু ও স্বপ্না আপা কিনারের দিকে খানিকটা নেমে হাত-পা ভিজিয়ে তারপর উঠে এলো।

পানিতে-বিচে শুয়ে ছিল সংক্ষিপ্ত পোশাক-পরা (কোনোভাবে লজ্জা নিবারণ করার মতো) অসংখ্য নারীপুরুষ ও শিশু। একই পোশাকে, শুধুমাত্র সংক্ষিপ্ত ব্রা আর প্যান্টি-পরা অসংখ্য তরুণী-কিশোরী, এমনকি বুড়িরাও ঘুরে বেড়াচ্ছিল রাস্তায়, দোকানপাটে, বিচে।
যাকে বলে চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন। এই প্রথমবারের মতো নিজচোখে ক্যানেডার প্রকৃত গ্রাম আর গ্রামীণজীবন দেখলাম আসা ও যাওয়ার পথে। ফেরার পথে একটা ফার্মের কাছে নেমেছিলাম। পুরো সিমকো কাউন্টিজুড়ে একই দৃশ্য-দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, র‌্যাঞ্চ, ভুট্টাখেত, গোরুছাগল, ঘোড়া আর খামারবাড়ি।
ফেরার পথে গান গাইবার বিষয়টি কয়েকবার উঠে এসেছিল। কিন্তু আমি ছিলাম ক্লান্ত-কিছুটা ঘুমিয়েও পড়েছিলাম গাড়িতে। সন্ধ্যের পর আমাদের আঙিনায় ফিরে তারেক ভাই ও তাহমিনা আপাকে ম্যারেজ-ডে উপলক্ষে গিফ্ট দিলাম। তারা চলে গেল, আমরা ফিরলাম অ্যাপার্টমেন্টে। রাতেই সেলফোনের ও ডিজিটাল ক্যামেরার ছবিগুলো দিয়ে দিলাম ফেসবুকে।

অনেকগুলো ভালো স্মৃতির মতো ওয়াসাগা বিচের স্মৃতিও মনের কোণে জ্বলজ্বল করতে থাকবে বহুদিন। ভাবছি, যদি বেঁচে থাকি আর বুড়ো হয়ে যাই, তখন জীবনের অসংখ্য স্মৃতি, ছবি, ঘটনা-এসব কোন্রকম দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখব? তখন কী করব?