হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

আমি বোধহয় জন্মগত ভাবেই টেনশনের অগ্নি রোগী। তাতে ঘৃতাহুতি দেয় বৈরি পারিপার্শি¦কতা। আমি আমার ভাবে চলতে গিয়ে দেখেছি চলতে পারি না সমাজের সহ¯্র-অর্বুদ ঘুণ পোকার কারণে।

কিছু বিষয় আমি মেনে নিয়েছি, মানতে বাধ্য হয়েছি। সামাজিক রীতি-নীতির মধ্যে যে গড়বড় ও অনৈতিকতা, সেসবের অনেকক্ষেত্রেই আমি প্রতিবাদ করেছি। আর তার ফল হয়েছে আমি ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে পড়েছি।
একটা উদাহরণ দিই, আজকাল টিকটক, শর্টস, রিল প্রভৃতি ছাড়াও চল হয়ে গেছে ফলোয়ারস ও সাবস্ক্রাইবারস বাড়াবার। আমি এখানে একটা গানের গ্রæপের উদাহরণ দিব। একজন প্রবাসী নারী সেই গ্রুপে গানের পোস্ট দেন। যথেষ্ট ডলার খরচ করে তিনি স্টেজ সাজান। নিজে ঝলমলে পোষাকে সাজেন। আর স্টেজজুড়ে গানের আধুনিক সব যন্ত্রপাতি বসান। তিনি কেমন গান করেন, সে বিষয়ে যাচ্ছি না; তিনি কেমন করে লক্ষ ফলোয়ারস জোগাড় করেন, সেই টেকনিকের কথা বলবো।

আমি নিজের গান পোস্ট করি, অনেকেই লাইক দেন, কমেন্ট করেন। অন্যের কোনো গান ভালো লাগলে আমি লাইক/ কমেন্ট করি। অনেক সময় অতি সাধারণ বেশে কেউ গান পোস্ট করলে তাকে উৎসাহ দিতে আমি লাইক দিয়ে থাকি।

একটা বড়সড় গানের গ্রুপে আমি জয়েন করেছিলাম। আমার গানে বহু লাইক কমেন্ট পড়তো। কেউ আবার লেজেন্ডারি শিল্পীদের সাথে আমার তুলনা করেছেন। আমি ভদ্র-নম্র ভাবে উত্তর দিয়েছি জানিয়েছি যে, সেসব লেজেন্ডসদের কাছে আমি নিতান্তই খড়কুটো।

সেই গ্রুপের কর্ণধার আবার আমার সাথে ফেসবুকে সংযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে আমার ম্যাসেঞ্জারে সেইসব প্রবাসী ‘মহারানি’দের লিংক পাঠান আমার লাইক ও কমেন্টস এর জন্য। আমি অনেকদিন নির্লিপ্ত ছিলাম। শেষে সেই কর্ণধার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি সাড়া দিই না কেন। আমি জানালাম, আমার মন থেকে সায় না দিলে আমি কোনোকিছু করি না। বলাই বাহুল্য, আমি আমি কর্ণধারকে ফেসবুকে ব্লক করে দিলাম আর গ্রুপ থেকে বের হয়ে এলাম। আমার কয়েকটি গানে উচ্চমার্গের কমেন্ট পড়েছিল। কই, তিনি তো একবারও আমার গান শেয়ার করেননি!

টরোন্টোতে ও ঢাকায় আমি সদা প্রফুল্ল ও হাস্যময়। এই প্রফুল্লতা ও হাসির গভীরে লুকিয়ে আছে গভীর বেদনা ও বিষন্নতা। এই অবস্থাটা মারাত্মক। এমনিতেই আমি সবসময় পারফেকশনিস্ট হতে চেয়েছি, যদিও সেটা সম্ভব হতো না বা অপূর্ণ থেকে যেত প্রতিকূলতা ও বিরূপ পারিপার্শি¦কতার কারণে। তার মধ্য থেকেই চেষ্টা করতাম ভালো কিছু খুঁজে নিতে। আর তাতে আমার মানসিক অবস্থায় চাপ পড়ত।

ভেতরে বিষাদ আর বাইরে হাসি, একে বলা হয় ‘স্মাইলিং ডিপ্রেশন’ আর তা আমার মতো মানুষের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়। নিজেকে আমি যতটুকু জানি, সেই অনুভব থেকেই বলছি- এই স্মাইলিং ডিপ্রেশন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আর সম্প্রতি হাফিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত Laura Coward-এর নিবন্ধ ‘What You Need To Know About ‘Smiling Depression’ পড়ে নিজকে স্মাইলিং ডিপ্রেশনের সাথে মিলিয়ে নিতে পেরেছি।

সাধারণভাবে ডিপ্রেশন উদ্যোমী ও সাহসী মানুষেরও মাঝে আসতে পারে। সেটুকু স্বাভাবিক, কারণ সেইসব মানুষদের আশা-আকাক্সক্ষা উর্ধ্বগতি সম্পন্ন। কোনো কারণে অধোগতি দেখা দিলে বা বাধাগ্রস্ত হলে ডিপ্রেশন আসতেই পারে। কিন্তু আমাকে ঘরের ভেতরে-বাইরে যুঝতে হয়েছে। আর পলে পলে সম্মুখিন হয়েছি ভৎর্সনা ও অসহযোগিতার। আমি জানি, চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল ও গোছানো মানুষের মধ্যে আমি পড়ি অনেকাংশেই। চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল-গোছানো স্বভাব মানে আবশ্যিকভাবে জীবনে চরম উন্নতি বা ধন-সম্পদের নির্দেশক নয়। এটা এক ধরনের দর্শন বা আত্মতৃপ্তি কিংবা পারফেকশন।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে আমি একজন বিখ্যাত লেখকের কথা বলবো। তিনি নীরদ সি. চৌধুরী বা নীরদচন্দ্র চৌধুরী (জন্ম ২৩ নভেম্বর, ১৮৯৭-মৃত্যু ১ অগাস্ট, ১৯৯৯)।

ভারতীয় এই বরেণ্য লেখকের আদিবাড়ি কিন্তু বাংলাদেশেরই কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদিতে। তিনি একজন খ্যাতনামা দীর্ঘজীবী বাঙালি মননশীল লেখক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। স্কলার এক্সট্রাঅর্ডিনারী শীর্ষক ম্যাক্সমুলারের জীবনী লিখে ১৯৭৫ সালে নীরদচন্দ্র চৌধুরী ভারত সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা হিসেবে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
তিনি তার ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তির্যক প্রকাশভঙ্গির জন্য বিশেষভাবে আলোচিত ছিলেন।

তিনি গভীরভাবে বাংলার সমাজ জীবনকে কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। বাঙালি সমাজ জীবনে ভন্ডামি, কপটতার পাশাপাশি সামাজিক স্তর ও শ্রেণিবিভাজন দেখে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন। তার লেখায় তীর্যক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি মিসঅ্যানথ্রোপি ও সিনিক আখ্যা পেয়েছিলেন। এই তীর্যক দৃষ্টি কিন্তু অসম সমাজব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ। কিন্তু অনেকেই তা মেনে নিতে পারেননি; তারা প্রচলিত সমাজের ধারক ও বাহক হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন।

আমি যেহেতু সেই কর্ণধারের রীতিনীতির পরোক্ষ প্রতিবাদ করেছিলাম, সেই কারণে আমি হয়তো তার কাছে সিনিক। অথচ প্রকৃত ভালো কাজে বাহবা পাইনি; কেননা ‘প্রকৃত ভালো লোক দেখানো কাজ’ করে বাহবা পেতে আজকালকার মানুষগুলো গড্ডালিকা প্রবাহে সন্তরণরত।

নীরদচন্দ্র চৌধুরী পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন। যে দেশ এই উপমহাদেশকে যুগ যুগ ধরে শোষণ করেছে, সেই দেশেই তিনি পাড়ি দেন। কারণ, তারা আইন, রীতিনীতি ও ভদ্রতা মেনে চলে।

নীরদ চৌধুরী ভারত ত্যাগ করে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে পাড়ি জমান ১৯৭০ সালে। এসময় Scholar Extraordinary বইটি লেখার কাজে হাত দেন। বইটি Scholar Extraordinary : The Life of Professor the Right Honourable Friedrich Max Muller, P.C. নামে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে।

মজার বিষয় হলো, তিনি সর্বদা ফিটফাট থাকতেন। ইংলিশ পোষাক পরতেন, অথচ বাসায় তিনি সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন। এর অর্থ এই যে, নিজ দেশকে ভালোবাসতেন তিনি। কিন্তু তিনি বর্ণিত কিছু কারণে দেশত্যাগে বাধ্য হন। এই ইংল্যান্ডেই তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক হয়ে ওঠেন।
একটা মুভি দেখেছিলাম, মানে মুভির অংশবিশেষ। টিভির চ্যানেল বদলাতে বদলাতে একটা চ্যানেলের একটা দৃশ্যে এসে চোখ-কান আটকে গেল। মা-মেয়ের কথোপকথন। মেয়েটি (সম্ভবত অসুস্থ) মাকে বলছে- ‘We don’t have enough time.’ মা উত্তর দিল ‘Yes, honey. I’m busy with work.’ মেয়ে বলল, ‘No, I mean, we don’t have enough time before we die.’

কী অসাধারণ দর্শনসমৃদ্ধ কথা! পাঠক নিশ্চয়ই বুঝেছেন কেন আমি তাড়া অনুভব করছি নিজেকে কিছুটা হলেও মেলে ধরতে?

হয়তো আমার স্বপ্ন অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।