হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

নব্বই দশকের শুরুর দিকে নানা প্রকার এক্সপেরিমেন্ট করতাম, ছুটে যেতাম দূরে কোথাও। কখনও একা, কখনও বা সঙ্গী জুটিয়ে। ছুটে যেতাম ভৈরব-নরসিংদী-গাজীপুর, এমনকি বরিশালে। সঙ্গী হতো বন্ধু আলম বা শিমুল, অথবা এক মামাতো ভাই, কিংবা ভৈরবের কোনো বন্ধু। কখনও বা ¯্রফে একা ঘুরে বেড়াতাম।

ভ্রমণে যেমন নিজের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করতাম, তেমনি নিজের চেহারা-সুরুতেরও সুরতহাল করতাম। তেমনি এক্সপেরিমেন্ট-এর একটি হলো নিজের চেহারা ও পোশাকের মাজা-ঘষা। আর ছবি তোলা তো রীতিমতো নেশা ছিল। আমার যৌবনের সন্ধিক্ষণে দাড়িগোঁফ গজাবার পর দাড়ি নিয়মিত কামাতাম। তবে গোঁফ মাঝেমধ্যে কেটে ফেললেও সেটা রাখার পাল্লাই বেশি ভারী ছিল। ভৈরবে রফিকুল ইসলাম ভাইয়ের সাথে সখ্যতা ছিল, ও সেখানে কিছু কর্মকাণ্ডে (সমাজসেবা ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অংশগ্রহণ) সম্পৃক্ততা ছিল। তো সেই সময়টায় ভৈরবপুরে রফিক ভাইদের ছিমছাম বাংলোবাড়িটা আমার মূল আকর্ষণ ছিল। সেখানে রাতে থাকতাম। আশেপাশে ক’জন স্থানীয় বন্ধু জুটে গিয়েছিল।

তো একবার ভোল পাল্টাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। গোঁফ ছাটলাম, আমার পছন্দের রঙের (সাদা, হালকা নীল বা কালো) প্যান্ট-শার্ট পরে বিক্রমপুর হাউসের (আমাদের পুরোনো ভাড়া বাড়ি) সামনে আমার চেনা স্টুডিয়োতে একটা পাসপোর্ট আকারের ছবি তুললাম। ছবি তুলে চলে গেলাম ভৈরবে। ছবিটা আমার নিজের পছন্দের তালিকায় থাকলেও সেটা হাজার ছবির ভিড়ে হারিয়ে গেল। ক্যানেডায় গমন এবং ক্যানেডায় আগমন জনিত কারণে অনেক ছবি হারিয়ে গেছে। তবু কিছু স্মারক রয়ে গেছিল।

প্রায় দুই যুগ পর ছবিটি দেখলাম সেদিন, কেমন বিহ্বল হয়ে গেলাম। এমন ছিলাম আমি! নিজকেই চিনতে পারছি না। তবে মনোযোগ দিয়ে দেখলাম, এবং প্রীত হলাম ভেবে যে, তখন সেই ভোলে দেখতে নিতান্ত খারাপ ছিলাম না! মনে পড়ল, ছবিটি বড়পা-মেজপাকে দেখিয়েছিলাম। দেখিয়েছিলাম, ছবিটা নিজেই পছন্দ করেছিলাম বলে। ভৈরবের মতো উপজেলা শহরে রিকশায় ঘুরতাম, আর আত্মপ্রসাদ লাভ করতাম নিজের এই নতুন ভোলে।

তো বছরখানেক আগে হঠাৎ মনে হলো, ছবিটা ফেসবুকে পোস্ট করে দিই না কেন? আমার মনে কিছু খেলে গেলে আমি সাথে সাথে তা বাস্তবায়ন করে ফেলি। ছবিটাতে ৫৬টি লাইক এবং বহু কমেন্টস পড়ল। কমেন্টগুলো, সত্যি বলতে কি, আমার পছন্দ হলো। একজন লিখেছে- ‘পুরনো বাংলা ছবির নায়ক।’ অন্যজন বলেছে, ‘আগেও নায়ক ছিলেন, এখনও আছেন।’ একজন তো রাজ্জাকের একটি ছবি দিয়ে, আমাকে ‘রাজ্জাক’ বানিয়ে দিল! আরেকজন, আমার পুরোনো কলিগ বলল, ‘স্যার খুব হ্যান্ডসাম।’

এতো প্রশংসার ভার বইব কেমনে? এখন মনে হয়, বেঙ্গল স্টুডিয়োতে তো খুব যেতাম। রাজ্জাকসহ অনেক বিখ্যাত অভিনেতা-পরিচালকের সাথে যৎকিঞ্চিৎ আলাপ-পরিচয় ছিল। মনের কথাটা খুলে বললেই হতো। আর সিনেমাতে একবার ঢুকে গেলে সবাই স্বাস্থ্য ও চেহারা সচেতন হয়। তার ওপর মেক-আপ তো আছেই। কিন্তু আমার তেমন ইচ্ছে ছিল না। তখন গল্পকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি, সেই গল্প-প্রবন্ধ লেখাকেই আঁকড়ে ধরে থাকলাম। বন্ধু আলমের কথাটা মনে পড়ে, ’তোর নায়কের মতো চেহরাটা একটু দেখাইয়া দে না।’

মেজো আপা, বড় আপাকে ছবিটা দেখিয়ে বিপাকেই পড়লাম। তারা আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগল। বিক্রমপুর হাউসে আমার এক প্রতিবেশিনী মেয়ের সাথে একটু ‘সে আমারে ভালা পায়’ জাতীয় সম্পর্ক ছিল।
ছিল আগের মহল্লায় একটি অতি সুন্দরী মেয়ের সাথে আমার ভাব। সত্যি বলতে কি, মেয়েটি আমাকে খুব পছন্দ করত। কিন্তু একদিন একটা দৃশ্য দেখে আমি ঝেড়ে দৌড় দিলাম। দেখলাম মেয়েটার বাসার সামনে তিন চারটা তরুণ প্রেমের গান গাইছে, শিষ দিচ্ছে, কথা বলছে। মেয়েটার জানালার পর্দা একবার উঠছিল, একবার নামছিল।

তারপর থেকে আমি কোথাও ছিলাম না। মেয়েটার সাথে পরিচয় হয় বাসা ভাড়া করতে গিয়ে। বাসাটা ভাড়া নেয়া হয়নি; তবে মেয়েটার মায়ের সাথে আমার দিব্যি আলাপ জমে যায়। বাসাটা নিব কি নিব না- এই করে কয়েকবার তাদের বাসায় যাওয়া হয়। আমরা বিক্রমপুর হাউসে চলে এলে একদিন দেখলাম মেয়েটি তার মা সমেত আমার বাসায় হাজির। বড় আপা আতিথেয়তার ত্রুটি করল না।

এরপর আমি আর যোগাযোগ রাখিনি। বড় আপার দৃষ্টি পড়ল প্রতিবেশিনী মেয়েটার দিকে। সেখানেও আমি অনেকটা মেকিয়াভেলিয়ান রোল পালন করলাম। শেষে মেয়ে দেখাদেখি করে হয়ে গেল সেটেলড ম্যারেজ। অবশ্যি বিয়ের পর আমি নিজেকে ঢালাও ভাবে বদলাতে পারিনি। আমার রোম্যান্টিক মন টা ঘুমিয়ে ছিল মনের গভীরে।

শত বাধা-বিপত্তি ও দুর্যোগের মুখেও আমার সবুজ ও রোম্যান্টিক মনটাকে হারিয়ে যেতে দিইনি। আমি চির রোম্যান্টিক থাকতে চাই। কঠিন কোনো সময়েও যেন কোনো রোমাঞ্চ-রোমান্সের মুহূর্ত সৃষ্টি করতে পারি।

আর যেন মান্না দে’র এক কলি গান গাইতে পারি। আমার সাম্প্রতিক সৃষ্টি ‘মাধবী’ গল্পের মতো কোনো সিল্যুঅ্যাট মনের ভেতরে তৈরি করতে পারি।