হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

কেন মানুষ আত্মহত্যা করে-এই প্রশ্নটি জাগে যখন পত্রপত্রিকায় দেখি তুচ্ছ বিষয়ে অভিমান করে কোনো কিশোর বা কিশোরী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মানুষ শারীরিক তীব্র কষ্টে বা মনের যাতনায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। হাঁপানির কষ্ট, বাত বা লিভারের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করার অনেক উদাহরণ আছে। প্রেমঘটিত ব্যর্থতায়ও অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলাম সম্প্রতি আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি ও মানসিক প্রশান্তির অবনয়নের প্রেক্ষিতে।

পাঠককে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমি আত্মহননের পথ কোনোদিন বেছে নেব না। আরও জানাচ্ছি, আমি Obsession-এ ভুগছি না। তবে, অবসাদগ্রস্ত হই, আবার তা কাটিয়ে উঠি। কিন্তু আমার ভেতরের যন্ত্রণাটা অন্তহীন। যুক্তিসঙ্গত। এই অর্থে যে, আমি যেই বৃত্তের মধ্যে জীবনযাপন করছি, যন্ত্রণা সেখানে অনিবার্য আর এই যন্ত্রণার দায়ভাগ বয়ে চলেছি বহুবছর ধরে। ঠিক করেছি, ভুগব কিন্তু পরাজিত হবো না। হয়তো ভুগে ভুগে আমার মৃত্যু হবে। কিন্তু আত্মহননের দায়ভাগ নিব না।

Obsession শব্দটার ব্যাকরণীয় ব্যাখ্যা হলো: ‘An obsession is an unwelcome, uncontrollable, and persistent idea, thought, image, or emotion that a person cannot help thinking even though it creates significant distress or anxiety.’
অবসেশন বা ওসিডি (অবসেশিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার) কারু না কারুর মধ্যে জীবনের কোনো একটা পর্বে কমবেশি ক্ষণিকের জন্য হয়তো দেখা দিতে পারে। তবে তা স্থায়ী হলে সেটা ওসিডির পর্যায়ে পড়তে পারে। আমার মাঝেও কোনো না কোনো সময় হয়তো এরকম উপসর্গ কাজ করেছিল। কিন্তু আমি জানি, সেগুলো ছিল ক্ষণিকের। বরং আমার অনেক চেনাজানা মানুষের মধ্যে দেখেছি একধরনের ওসিডি কাজ করে। যেমন, বারবার একই কথা বলা, অনর্গল একই জিনিস ধোয়া বা মোছা, কিংবা অনবরত গোছগাছ করার বাতিক। এগুলো যাদের থাকে, তাদের চিকিৎসা নেয়া উচিৎ। তারা হয়তো জানে না, অজান্তেই তারা এইসব কাজ করে যায়। তাদের নিকটজনেরা হয় বিষয়টিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, না হয় তারাও জানে না যে এটি একটি রোগ।
আমি নিজে পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করি, কিন্তু আমি অবসেশিভ নই। আমি আত্মহত্যার চিন্তাকে প্রশ্রয় দিই না। এটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অ-গ্রহণযোগ্য। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘আত্মহত্যা জীবনের সবচাইতে বড় কাপুরুষতার পরিচয়।’

এই তো সেদিন আমার পরিচিত এক মেয়ে ফেসবুকে স্টেটাস দিল যে, সে আত্মহত্যা করবে। আমি নিশ্চিত, এই মেয়ে কখনও আত্মহত্যা করবে না। কেননা, আত্মহত্যার কাজটি কখনও ঘোষণা দিয়ে হয় না। যদিও জানি, মেয়েটি সংসারের নানা ঝুটঝামেলা, অশান্তি ও অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করছে।
এতক্ষণ কেবল ভূমিকাই করলাম। আসলে আমি নিজে প্রতিনিয়ত অনেক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। অনেকেরই ভেতরেই যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকে। অভিনব যন্ত্রণা বা অভ্যন্তরীণ ও পারিপার্শি¦ক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন যন্ত্রণা। কিংবা হতাশা।

আমি অবসেশিভ নই তবে অবসেশন-সদৃশ্য কিছু যন্ত্রণার শিকার। আমার দীর্ঘদিনের দীর্ঘশ্বাস আর অশ্রæভেজা সেল্যূলয়েডের গাথা আপনাদের কাছে উন্মোচিত হবে কোনো ধ্রুপদী সিনেমার ধীরগামী কাহিনির মতো, কুয়াশাচ্ছন্ন ও রহস্যঘেরা সংলাপের অন্তরালে।

আমি একটি মেঘমুক্ত নাক্ষত্রিক আকাশ চাই, আমি তা ছুঁতে পারব কিনা জানিনা। অধুনা, আমার অ্যাজমা বেড়ে যাওয়াতে এবং অ্যাজমায় প্রচণ্ডভাবে ধুঁকে ধুঁকে আমি শংকিত যে আর কোনোদিন হয়তো আমি গান করতে পারব না। তবে আমি গান করতে পারব- এই বিশ্বাসটাই আমি ধরে রেখেছি।

আমার একজন প্রিয় লেখক আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। হ্যামিংওয়ের আত্মহত্যা করার বিষয়টি আমি মানতে পারি না। জগতে তার প্রাপ্তির তো কোনোকিছুর বাকি ছিল না। পুলিৎজার পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। আর জনপ্রিয়তার শীর্ষদেশে অবস্থান করে কেন তিনি বেছে নিলেন আত্মহননের পথ? তার ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’-এর দৃশ্যাবলি এখনও আমার চোখে ভাসে। এর চলচ্চিত্রায়ন দেখিনি। বইটি পড়েছিলাম, তখন যে চিত্রকল্প ভেসে উঠেছিল মনের পর্দায় সেটা আজও ভাস্বর হয়ে আছে আমার মনে। ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ এবং ‘দি সান অলসো রাইজেস’ উপন্যাস দু’টি আমাদের পাঠ্য ছিল।

আত্মহত্যা কাপুরুষতার অভিলক্ষণ। হয়তো। কিন্তু হ্যামিংওয়ে কাপুরুষ, এই চিত্র কল্পনাতেও আনতে পারি না। হ্যামিংওয়ে খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেছিলেন। সুপুরুষ ছিলেন তিনি। তার তরুণ বয়সের বর্তমান টম ক্রুজ মার্কা চেহারা দেখলে তরুণীরা হ্যামিংওয়ের প্রেমে পড়ে যেত নিঃসন্দেহে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হ্যামিংওয়ে ইতালীয় ফ্রন্টে কিছুদিন অ্যাম্বুলেন্স চালকের কাজ করলেও মূলত তিনি ছিলেন সাংবাদিক। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার পূর্বে তিনি কিছুদিন ‘দি কানসাস সিটি স্টার’ পত্রিকার সংবাদদাতার কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি ক্যানেডার ‘টরোন্টো স্টার উইকলি’ পত্রিকার বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবেও কাজ করেন। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, তিনি যৌবনে তার প্রথম ব্যর্থ প্রেম ভুলতে পারেননি।

হ্যামিংওয়ের নির্মেদ ও নিরাবেগী ভাষা বিংশ শতকের ফিকশনের ভাষার ওপর দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মন ও গগনচুম্বী ইমেজ পরবর্তী প্রজন্মের ওপর প্রবল ছাপ ফেলেছিল।

কেন তিনি আত্মহত্যা করলেন? এর পেছনে এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে। তিনি আত্মহননের পূর্বে কোনো চিরকুট রেখে যাননি। তাই তার আত্মঘাতী হবার কারণ কী-সেবিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে একথা সত্য যে, হেমিংওয়ের ডিপ্রেশনে ভোগার এত বেশি কারণ ছিল যে, সবগুলো কারণের যোগফল বা সেসবের মাত্র একটি কারণেও আত্মঘাতী হবার নির্দেশক হতে পারে। তিনি অতিরিক্ত মদ্যপায়ী ছিলেন আর প্রবল ডিপ্রেশনে ভুগতেন। হ্যামিংওয়ে ১৯৬১-এর বসন্তে একবার আত্মহননের চেষ্টা চালান।

তারপর তিনি ইসিটি (ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি) গ্রহণ করেন। তার ৬২তম জন্মদিনের তিনসপ্তাহ পূর্বে তিনি তার আইডাহো’র বাসভবনের কিচেনে ২ জুলাই (১৯৬১) সকালে মাথায় শটগানের গুলি বিঁধিয়ে বিদায় নেন এই পৃথিবী থেকে। ইসিটি চিকিৎসাকে তিনি তার স্মরণশক্তি নষ্ট করে দেবার জন্য দায়ী করেন। হ্যামিংওয়ের চিকিৎসক বাবাও আত্মহত্যা করেছিলেন। খ্যাতিমান লেখিকা ভার্জিনিয়া উল্ফও ডিপ্রেশনে ভুগতেন। পরিণতিতে তিনিও আত্মহননের পথ বেছে নেন।

তবে বর্তমান সময়ে টিনএজারদের ডিপ্রেশন ও আত্মহত্যা, ছোটোখাটো অভিমান থেকে নিজেদেরকে হনন করার প্রবণতা বাড়ছে। টিনএজারদের ডিপ্রেশন নিয়ে বাংলাদেশের পত্রিকায় ও আমার কলাম ‘বালুকা বেলা’য় আমি লিখেছি। এখানে সার্বিকভাবে বিশ^জুড়ে সামাজিক অধঃপতন, মাদকাসক্তি ও বাবা-মায়ের নজরদারি ঠিকভাবে না থাকার কারণগুলো অন্যতম।
আমার যন্ত্রণা, আমার কষ্টের ছায়া আপনারা দেখতে পাবেন আমার প্রকাশিতব্য উপন্যাস ‘ভাইরাস অর্নিথিসাইরাস’-এ আর আমার বেদনাবিধুর জীবনের ছাপ খুঁজে পাবেন আমার কিছু কিছু গল্পে (প্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য)।

ক্যানেডায় পাড়ি দিয়ে প্রথম থেকেই আমি আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলাম। বর্তমানে তা থেমে আছে গানবাজনা ও অন্যান্য লেখালেখির ব্যস্ততায়। আশা রাখি, দেহত্যাগ করার আগেই আত্মজীবনী লেখা সমাপ্ত করে যাবো। সেখানে আমার ‘দীর্ঘশ্বাস আর অশ্রুভেজা সেল্যূলয়েডের গাথা’ আপনাদের কাছে উন্মোচিত হবে।