ফরিদ আহমেদ : মানব সভ্যতার একটা অনিবার্য দিক হচ্ছে যুদ্ধ। যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি এমন সমাজ খুঁজে পাওয়া বিরল। পরিচিত সভ্যতাগুলোর মধ্যে নব্বই থেকে পঁচানব্বই ভাগই কোনো না কোনো সময়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। মানব সভ্যতার বিকাশের পর থেকেই যে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা নয়। যুদ্ধের অস্তিত্ব তার আগেও ছিলো। হয়তো সভ্যতার বিকাশের অনেক আগে থেকেই মারামারিতে পটু ছিলাম আমরা। শিকার-সংগ্রাহক যুগে আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা ভালো শিকার ভূমির অধিকার নিয়ে কিংবা ভালো ফলমূল পাওয়া যায় এমন জাগার দখল নিতে মারামারি করেছে। হয়তো বা মারামারি করেছে সুন্দরী কোন নারীর দখল নিতে। ওই সময়ও যে হেলেন অব ট্রয় ছিলো না, সেটাই বলি কী করে! ভূমি আর নারী দখলের যুদ্ধের ইতিহাস প্রাগৈতিহাসি। এই সুপ্রাচীন ইতিহাসের কারণেই আমাদের রক্তের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে যুদ্ধের বীজ।

ইতিহাসেরও আগে মানুষ মারামারি করেছে খালি হাতে। প্রাচীন যুগে তীর ধনুক আর তরবারির আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে পৃথিবী, মধ্য যুগে বারুদের বিষাক্ত গন্ধে দম বন্ধ হয়েছে মানুষের আর আধুনিক যুগে এসে দেখেছে আণবিক-পারমাণবিক বোমার ভয়ানক ধ্বংস যজ্ঞ। তবে, এটা স্বীকার করতে হবে যে আগে যে রকম যত্র তত্র যুদ্ধ দেখা যেতো, এখন সেটা আর সেভাবে দেখা যায় না। গত শতাব্দীর সঙ্গে তুলনা করলে, নিশ্চিত করেই বলা যায় যে যুদ্ধের পরিমাণ কমে এসেছে। পৃথিব্রী অনেক দেশই এখন সামরিক বাহিনীতে বিপুল বিনিয়োগের পরিবর্তে মানব কল্যাণে বেশি টাকা ব্যয় করছে। তবে, এটা ঠিক যে যতই মানব সভ্যতার উন্নতির দিকে যাক না কেনো, যতোই যুদ্ধ বিগ্রহ কমে আসুক না কেনো, কোথাও না কোথাও যুদ্ধ ঠিকই থাকবেই। কোথাও না কোথাও একজন জর্জ বুশ বা একজন ভ্লাদিমির পুতিন হাজির হবে। বিনা কারণে তারা বাধিয়ে দেবে যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষতি কী পরিমাণ হবে তা নিয়ে মাথাব্যথা থাকবে না তাদের। নিজেদের লাভ হলেই হলো। এতে করে কোন সভ্যতা বিলীন হলো, কোন মানব প্রজাতি ধ্বংস হলো, সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। মাথাব্যথা না থাকার অন্য কারণও আছে। এদের অসংখ্য অন্ধ ভক্ত আছে। সেই অন্ধ ভক্তরা এদের হাতের রক্ত মুছিয়ে দেবার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। যুদ্ধের স্বপক্ষে গান গায় তারা। ফলে, যুদ্ধ বাধিয়েও কোনো মনোবিকারে ভোগে না বুশ এবং পুতিনরা।

এমন যুদ্ধময় পরিবেশেও, যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে দূরে থাকতে পেরেছে শুধুমাত্র সেই সমাজগুলোই, যারা কোনো কারণে বিচ্ছিন্ন থেকেছে। সেটা ভৌগলিক কারণে হতে পারে, কিংবা জীবন যাপন প্রণালীর কারণে হতে পারে। এরা হয়তো কাউকে আক্রমণ করতে যায়নি নিজেদের দুর্বল শক্তিমত্তার কারণে, আবার অন্যেরাও এদের পিছনে লাগেনি এই কারণে যে এদের পিছনের যুদ্ধের শ্রম দিয়ে খুব একটা লাভবান হবার সুযোগে নেই। মশা মারতে কামান দাগার কোনো মানে হয় না।

বড় এবং প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার মধ্যে একটা সভ্যতা ছিলো যারা কখনোই যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। সেই সভ্যতাটা হচ্ছে হরপ্পা সভ্যতা। আমাদের এই উপমহাদেশের সভ্যতা এটা। গড়ে উঠেছিলো সিন্ধু নদীর অববাহিকায়, এখন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। এখনকার পাকিস্তানে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। তবে, এটা আফগানিস্তান এবং ভারতেও বিস্তৃত ছিলো। মিশরের মেসোপটেমিয়া সভ্যতা যখন গড়ে উঠেছিলো, ঠিক একই সময়ে হরপ্পা সভ্যতার বিকাশ ঘটে।

হরপ্পা খুবই উন্নত একটা সভ্যতা ছিলো। এর জনসংখ্যাও ছিলো বিপুল পরিমাণে। বড় বড় শহর ছিলো এই সভ্যতায়। সেই সব শহরের নগর পরিকল্পনা ছিলো অত্যাধুনিক।
এখানে বিকশিত হয়েছিলো এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির। জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছিলো। এর ফলশ্রুতিতে প্রযুক্তিরও উদ্ভাবন ঘটেছিলো। এই সভ্যতার মানুষেরা দূর দূরান্তের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কেও লিপ্ত ছিলো।

হরপ্পা সভ্যতা আবিষ্কারের পর থেকে প্রত্নতাত্তি¡কেরা সেখানে খনন কাজ অব্যাহত রেখেছেন। একশো বছরের খননকাজ এবং গবেষণার পরেও তারা এমন কোনো নিদর্শন খুঁজে পাননি, যা দিয়ে বলা যায় যে এই সভ্যতা কখনো শত্রুবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। পুরো সভ্যতা জুড়ে অল্প কিছু দুর্গ ছাড়া সামরিক নিদর্শন নেই বললেই চলে। এই সভ্যতার বড় কোনো সামরিক বাহিনী ছিলো এমন নিদর্শনও নেই। বলা চলে, তারাও কাউকে আক্রমণ করেনি, নিজেরাও কখনো আক্রান্ত হয়নি। আধুনিক যুগের সুইজারল্যান্ডের প্রতিভূ যেনো হরপ্পা সভ্যতা। আরেকটা জিনিসও এখানে পাওয়া যায়নি। অন্য যে কোনো সভ্যতাতে গেলেই গ্রেট লিডারদের মনুমেন্ট পাওয়া যায়। হরপ্পাতে সেটা ছিলো না। এটাও যুদ্ধ না হবার আরেকটা কারণ হতে পারে। এইসব গ্রেট লিডাররাই সাধারণত নিজের অহমিকা এবং অহংবোধের কারণে যুদ্ধ বাধায়।

যুদ্ধে লিপ্ত না হবার পরেও এই সভ্যতাটা এক সময় ধ্বসে পড়ে। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ সালের দিকে এই পতন দেখা দেয়। দলে দলে লোক শহর ছেড়ে চলে যেতে থাকে। পরিত্যক্ত হতে থাকে নগরগুলো। ঠিক কী কারণে এই পতন ঘটেছিলো, সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হয়। কারণ, এই সভ্যতার যে লিখনপদ্ধতি, সেটার পাঠোদ্ধার এখনও করা যায়নি।

তবে, ধারণা করা হয় যে এর পিছনে জলবায়ুর পরিবর্তন হয়তো মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলো। শুধু হরপ্পা নয়, একই সময়ে অন্য সভ্যতাগুলোতেও এর ছাপ পড়েছিলো। জলবায়ুর পরিবর্তনে শুষ্ক এবং অনুর্বর হয়ে পড়েছিলো সিন্ধু অববাহিকা। দেখা দিয়েছিলো খাদ্যাভাব। নগরের মানুষ ঘনবসতিতে থাকে বলে নানা ধরনের সংক্রামক রোগেও আক্রান্ত হয় দলে দলে। সে রকম কিছুও হয়তো এখানে ঘটেছিলো যে কারণে মানুষ নগর ছেড়ে চলে গিয়েছে। কারণ যাই হোক না কেনো, সাড়ে তিন হাজার বছর আগে হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলো সব জনশূন্য হয়ে যায়। যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন পড়েনি এই সভ্যতার বিনাশে। কোনো রকমের অসভ্যতা ছাড়াই ধ্বংস হয়ে যায় একটা সমৃদ্ধ সভ্যতা।