মণিজিঞ্জির সান্যাল : সত্যিই শ্রাবণ যেন নতুন রূপে, নতুন রঙে ধরা দিল আমার জীবনে। পাহাড়ী নদীর রূপ, রস, গন্ধকে অনুভব করতে হলে বর্ষাকেই বেছে নিতে হবে। আর তাই সঙ্গী করলাম এমনই একটি দিনকে। রোজকার এই একঘেয়ে জীবনে মাঝে মধ্যেই মন হাঁপিয়ে ওঠে, প্রাণ উশখুশ করে। একটু সময় বাঁচিয়ে একটু ছুটির অবকাশ কিম্বা প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বা নিজের কাছে নিজেকে মেলে ধরার অবকাশ। সবুজের হাতছানি, অরণ্যের রোমাঞ্চ কিংবা পাহাড়ের নীরবতাকে বড় আপন করে নিতে ইচ্ছে করে। এর জন্যে কিছুই প্রয়োজন নেই, শুধু সঙ্গী হিসেবে একটি ভ্রমণ পিপাসু মন-ই যথেষ্ট। আর তার-ই জন্যে বেছে নিলাম এক মনোরম সুন্দর নদী, জঙ্গল, পাহাড় ঘেরা সামসিং-কে, শিলিগুড়ি থেকে যার দূরত্ব ৮০ কি.মি.।

যাত্রাপথের শুরুতেই বৃষ্টি উধাও, মনটা আমার কেমন যেন মেঘলা হয়ে উঠল। আসলে শ্রাবণের বারিধারায় পাহাড়ী নদী, ঝরণাকে উপভোগ করব ভেবেছিলাম নিজের মতো করে। যাই হোক মেঘলা মনকে সঙ্গী করেই রওনা দিলাম সামসিং-এর উদ্দেশ্যে।

কিছুটা পথ যেতেই সবুজ আমাকে জড়িয়ে ধরল। আহা! কি মনোরম দৃশ্য। দুপাশে চা বাগান, চা গাছের ওপরে ছায়া দিচ্ছে বড় বড় বৃক্ষ, হ্যাঁ একটু বৃক্ষ বলতেই ইচ্ছে হলো। অদ্ভুত এক রাজকীয় রূপ এই আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষদের। এতটুকু মাথা নত করতে রাজি নয় তারা, অর্থাৎ বাঁচব যে’কদিন রাজার মতো বাঁচব। সত্যিই তো জীবন একটাই আর নিজের ছন্দে বাঁচার মধ্যে একটা অদ্ভুত মজা আছে কিন্তু। এই সবুজ আমাকে আসল শিক্ষটাই দিয়েছে, তাই তো মন চাইলেই তার কাছে ছুটে আসি। তবে আমি সামনে এলেই তারা আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে, ভুলেই যায় তাদের রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার। কিন্তু নিজেকে নিজেই আমি শুধরে নিতে শিখেছি।

আসলে তার ডালে-ডালে অদ্ভুত এক মৌনতা। চারদিকে সবুজ শান্ত সমুদ্রসম তার বিস্তার। তাই নিশ্চুপে আমি প্রেম নিবেদন করি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই খেয়াল করলাম পৌঁছে গেছি একেবারে সেবকে, আর পেয়ে গেলাম লাস্যময়ী তিস্তাকেও। তিস্তার সাথে আমার দারুণ সম্পর্ক। দু-পাশে পাহাড়, পাহাড়ের মাথায় মাথায় বৃক্ষ লতাপাতা, আর তার উপর খুশিয়াল মেঘ, নীল ছাদ।

আর করোনেশন সেতু? সে তো বড় মজার! আর একটু এগিয়ে গিয়েই পাহাড়ী ঝর্ণা। সেবক ছাড়িয়ে মংপং, তারপর ওয়াশাবাড়ি চা বাগান, তারপর একে একে ওদলাবাড়ি, ডামডিং চা বাগান ছাড়িয়ে মালবাজার, তারপর পৌঁছলাম চালসা। অদ্ভুত ব্যাপার সকালের মন খারাপ কখন যে উধাও হয়ে গেছে তা টের-ই পাইনি। আসলে আকাশ তখন মেঘলা, আহা! বৃষ্টি এল বলে।

চালসা ছাড়িয়ে যখন আমরা মেটেলিতে পৌঁছলাম তখন রীতিমতো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আর আমি ঠিক এই বৃষ্টিকেই চাইছিলাম। শিলিগুড়ি থেকে মেটেলির দূরত্ব প্রায় ৭২ কি:মি:। মেটেলিতে পৌঁছে প্রথমে চা বাগানকে উপলব্ধি করলাম। চারপাশে শৃঙ্খলায় চা পাতার বিছানার মধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, মানুষ জানে না ভালোবাসার গোপন দরজা। আলতো স্পর্শে ওদের সেই ভালোবাসার সাড়া দিয়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। মূলত চা-বাগানের জন্যেই বিখ্যাত এই সামসিং। প্রকৃতি প্রেমিকদের ভালোবাসার স্বর্গরাজ্য।

আমরা যত এগিয়ে যাচ্ছিলাম ছোট ছোট পাহাড়গুলো আমাদের যেন দুহাতে আগলে ধরছিল কি অপূর্ব ভঙ্গিমায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ‘সুন্তালেখোলা’। সুন্তালেখোলা থেকে সামসিং নয় কিলোমিটার। সামসিংয়ের দিক থেকে গেলে সুন্তালেখোলার আগে পড়বে বন দফতরের চেকপোস্ট। চেকপোস্ট পেরিয়ে আরও কিছুটা গেলে সুন্তালেখোলা নেচার ক্যাম্প, চারদিকে জঙ্গল। পাখি আর প্রজাপতির এক অসাধারণ মেলবন্ধন। শীতকালে গেলে চোখে পড়বে কমলালেবু।

সুন্তালেখোলার পরিবেশ অতি মনোরম। নেপালি ভাষায় ‘সুন্তালে’ শব্দের অর্থ কমলা, ‘খোলা’ মানে ঝোরা। এই সুন্তালেখোলার নাম এসেছে এই খোলা বা ছোটো নদীটির জন্যেই। নদীটির ওপর ঝুলন্ত সেতু।

কী অসাধারণ নির্জনতা, পাখিদের মিষ্টি আওয়াজ।
পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি-ঘর নিস্তব্ধ নির্জনে। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকা বাঁকা রাস্তা, দু’একটা অসাধারণ বাংলো। বৃষ্টি তখন মন মাতানো সুরে গাইছে ‘রিমঝিম ঘন ঘন রে’।

ছোট্ট সুন্দর একটি দোকানে নেপালীদের হাতের অসাধারণ মোমো খেলাম। তারপর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমরা ওখান থেকে রওনা দিলাম ‘রকি আইল্যান্ডের’ উদ্দেশ্যে।
‘রকি আইল্যান্ড’ মানে পাথুরে দ্বীপ। একটু অবাক তো লাগবেই, উত্তরবঙ্গের ছোট নদীতে দ্বীপ কিভাবে সম্ভব! বেশ দারুণ একটা উত্তেজনা কাজ করছিল, এমন অসাধারণ নাম ভাবা যায়!
সুন্তালেখোলা পেরিয়ে আরও তিন কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই রকি আইল্যান্ড। নদীর ধারে পাহাড় আর জঙ্গল নিয়ে রকি আইল্যান্ড।

কি অপূর্ব জলস্রোত এই মূর্তি নদীর। ক্যাম্পে ঢোকার মুখেই মূর্তি নদীর জলোচ্ছ¡াসের আওয়াজ। সুন্দরী মূর্তি ক্যাম্পের গায়ে আছড়ে পড়ে চলেছে নিজের তালে।
এই মূর্তি নদীকেই অন্যরূপে দেখেছি ধূপঝোরাতে। অথচ এখানে ভয়ংকর রূপ, যেন এক নিমেষে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে একটু অন্যমনস্ক হলে। বড় বড় পাথরগুলো কারো জন্যে যেন অপেক্ষা করছে দীর্ঘদিন ধরে, ওদের দেখলে প্রত্নতাত্তি¡কদের কথা মনে পড়ে যায়। নদীর ওপরে ব্রীজের দু’পাশ দিয়ে ঢালু রাস্তা নেমে গেছে নদী অবধি।
পৌঁছে গেলাম নদীর একেবারে কাছে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করলাম শ্রাবণের নদীর রূপকে। নদীর বুকে অসংখ্য বিশাল আকারের পাথরগুলো দেখলে চমকে যেতে হয়। পাথরের ওপর বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসেই।

ফিরতে মন চাইছিল না কিন্তু ফিরতে তো হবেই কারণ এরপর আরো একটা জায়গা অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে। হ্যাঁ ‘লালিগোরাস’, চারদিকে পাহাড়। সবুজ আর নীলের মেলবন্ধনে লালিগোরাস যেন প্রকৃতির মনোরম সৃষ্টি। আঁকাবাঁকা ঢালু রাস্তা ডানে বামে। অদ্ভুত সুন্দর এক ঢালু রাস্তার ধারে সুন্দর এক সিমেন্টে বাঁধানো বসার জায়গা। চারপাশে পাহাড় আর নীচে খাদ। সূর্য তখন অস্ত যাবে যাবে, তাই ফিরতে হল তাদের সবটুকু ভালোলাগাকে নিয়ে।
পাহাড় থেকে চা বাগান, তারপর একে একে পাহাড়ী নদী ছাড়িয়ে আমরা এগিয়ে চললাম জনতার কলরলে। পেছনে পড়ে রইল একটি দিনের স্মৃতি …

মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত