জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।

ষোল.

বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডালু অন্যতম। ডালুরা নিজেদেরকে মহাভারতের মহাবীর অর্জুনের পুত্র বভ্রবাহনের বংশধর হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা থাকা স্বত্তেও তারা এখনো তাদের সংস্কৃতি, পরিচয় ও সামাজিক মূল্যবোধ স্বাতন্ত্রতার সাথে টিকিয়ে রেখেছেন।

ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার জয়রামকুড়া, সংড়া, মনিকুড়া; শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার হাতিবান্ধা, পলাশিয়া, সোহাগপুর, সাউলাতলা, নাকুগাঁও, দেবীপুর, আন্ধারীপোপ, শালমারা, গোপালপুর প্রভৃতি গ্রামে বসবাস করছে। ২০০৬ সালে ডালু জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ডালুদের জনসংখ্যা প্রায় ৯৬৫ জন। সরকারী জরিপে ডালুদের কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যার কথা উল্লেখ হয়নি। বেসরকারী সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ডালু জনসংখ্যা ছিল দেড় হাজারের মত।

জন্ম
শিশু জন্মের ১১ দিন পর নাপিত ডেকে নবজাত শিশুর চুল ফেলা হয়। ঐ দিন বিশেষ পূজাও হয় এবং ডালুরা বিভিন্ন রকমের আচারাদি পালন করেন। পূজার দিন সন্ধ্যায় সমবেত সবাইকে মুড়ি, বাতাসা, পান সুপারি প্রভৃতি সহযোগে আপ্যায়ন করা হয়।

ভাষা
ডালুদের প্রবীণ সদস্যরা মনে করেন, মণিপুরীই হচ্ছে তাদের আসল ভাষা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসকারী ডালুরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন। যথাযথ সংরক্ষণ, ব্যবহার কম, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চাপ, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি তারা হারিয়ে ফেলছেন।

বাসস্থান
ডালুদের বাসস্থানের জন্য কোন নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নেই। টিনের ছাউনি দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়। যারা দরিদ্র তারা মাটির দেয়াল, বাঁশ ও ছনের ছাউনি দ্বারা তৈরি করেন। তারা বসতবাড়ির চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পছন্দ করেন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে যখন তাদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল তখন অতিথি সহ প্রতিবেশীদের সাথে আলাপ আলোচনার জন্য বৈঠক ঘর ব্যবহার করতেন। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে সেটি এখন সম্ভব হচ্ছেনা। বৈঠক ঘরের কার্যাদি বারান্দাতেই করতে হয়।

ডালু নারী

পেশা
জীবিকা নির্বাহের জন্য ডালুরা প্রধানত কৃষিকেই বেছে নিয়েছেন। ডালুদের অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। ৯৫% ভূমি শ্রমিক, অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকেই বাঁশ-বেতের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। শিশু কিশোররাও মাঠের কাজে অভিভাবকদের সহায়তা করেন। বিগত সময়ে দেশবিভাগ আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে অনেক ডালুদের দেশ ছাড়তে হয়েছে। সে সময় বাঙালি কর্তৃক তাদের দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধার না হওয়ার ফলে তাদের ফসলি জমির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। কৃষিকাজ প্রধান পেশা হলেও ডালুদের এখন বিভিন্ন চাকরি ও কাজ করতে দেখা যায়। গাজীপুর, ঢাকার টঙ্গী সহ আশেপাশে স্থানে গার্মেণ্টস শিল্প, জুতা শিল্প, কামার শিল্প ইত্যাদি পেশায় কিছু ডালু কাজ করেন।

ধর্ম
ডালুরা সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, দারিদ্রতার কারণে সনাতন ধর্মানুযায়ী পূজা পালন করতে পারে না। তারপরেও সেখানে তাদের চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। বৈষ্ণব মতাবলম্বী বলে পরিচয় দিলেও ধর্মীয় বিবেচনায় তারা শাক্তকেই বেশি প্রাধান্য দেন। পূজা পার্বনে পাঠা বলিসহ শাক্ত মতের অন্যান্য আনুসঙ্গিক রীতি পালন করেন তারা। বর্তমানে মূর্তি পূজার প্রচলন চলছে। ডালুরা পাগলপন্থী ধর্মমতের অনুসারী হওয়ায় তাদের বাড়িতে পাগলদের আসন বসানো হয়েছে।

বিবাহ
একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। বর্তমানে দেশে ডালুদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় একই গোত্রে বিয়ে হচ্ছে। ১২ থেকে ১৬ বছরের মেয়েকে বিবাহের যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে। অন্যদিকে ছেলেদের বয়স ২০ থেকে ৩০ হলে বিবাহযোগ্য পাত্র হিসেবে গণ্য হয়। স্বাভাবিকভাবে ছেলেমেয়েদের অভিভাবকরা বিবাহের সকল ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। যাকে ডালুরা বউ জোড়া নামে বলে থাকেন। বিবাহের রীতি অনুযায়ী ছেলের মা অথবা তার অবর্তমানে পরিবারের অভিভাবক বিবাহের প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ছেলে পক্ষের জন প্রচুর পান সুপারি নিয়ে মেয়ে পক্ষের বাড়িতে যায়। যদি এত ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় তাহলে ছেলের পিতা কনের পিতৃগৃহে গমন করেন। এর মাধ্যমেই দিন তারিখ ও পণ আদায়ের বিষয়টি নির্ধারিত হয়। বিয়ের কাজে সাহায্যের জন্য ডালুদের ধর্ম মা-বাবার প্রয়োজন পড়ে। এ বাবা-মাকে ডালুরা আইড় বলে। বিয়ে কুঞ্জেই কন্যাদান করা হয় এবং কনের বড় ভাই, মামা অথবা কাকা কন্যাদান করেন। প্রথম দিনের বিয়েকে ভরা বিয়ে বলে।

উৎসব
অগ্রহায়ন মাসে ডালুদের জন্য বিশেষ আনন্দ ও উৎসবের মাস। এ মাসে ঘড়ে ঘড়ে নতুন ধান তোলার ধুম পড়ে যায় এবং নবান্নের উৎসব লেগে যায়। গ্রামের ঘরে পিঠাপুলি তৈরির উৎসব, নতুন ধানের চিড়া, নারিকেল গুড়সহ একত্রে খাওয়ার ধুম লেগে যায়। তেলেভাজা ও দশী পিঠা খুব চমৎকার আয়োজন নবান্ন উৎসবের। গুড়ের পায়েসও রান্না হয়ে থাকে এ উৎসবে।

মৃত্যু
ডালু সমাজে পূর্বে মৃতদেহ দাহ করলেও বর্তমানে শুধু মুখাগ্নি করেই মৃতদেহ মাটি খুঁড়ে কবরস্থ করার ব্যবস্থা প্রচলিত। শ্মশান ভূমির অভাব, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, কাঠের অভাব ইত্যাদি কারণে এখন আর মৃতদেহ দাহ করা হয় না। মৃতদেহকে সাবান, চন্দন ও হলুদ দিয়ে পরিষ্কার করার পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়। সাদা ধুতি পরিধেয় করার পরে সাদা কাপড় মুড়িয়ে মৃত ব্যক্তির জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বারা মুখাগ্নি করানোর পর কবরস্থ করা হয়। মৃতদেহের শিয়রে পয়সা, আতপ চাল, পাত্রে পানি ও পুরনো কাপড়গুলো দিয়ে দেওয়া হয়।

তথ্যসূত্রঃ
বিশ্বজিৎ ডালু ‘ডালু’ প্রকাশিত হয়েছে মঙ্গল কুমার চাকমা ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী এথনোগ্রাফীয় গবেষণা (দ্বিতীয় খণ্ড), উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০
সুভাষ জেংচাম ‘ডালু’ প্রকাশিত হয়েছে মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম এবং সুগত চাকমা সম্পাদিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭।