জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।

সতেরো.

বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্র উপকূলে ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত রাখাইনদের বসবাস কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার উপকূল অঞ্চলে। রাখাইন জনগোষ্ঠি পনেরো শতক থেকে চট্রগ্রামের রামু ও সংলগ্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। আঠারো শতকে রাজনৈতিক দুর্যোগ ঘটলে তাদের অনেকেই দেশত্যাগে বাধ্য হন। বর্তমানে অধিকাংশ রাখাইন কক্সবাজার, বান্দরবান, মানিকছড়ি এবং টেকনাফে বসবাস করেন। ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে রাখাইন জনসংখ্যা প্রায় সতেরো হাজার, পরিবার সংখ্যা ৩,০১৭ টি। অথচ পটুয়াখালীতেই চল্লিশ দশকের শেষ দিকে ৫,১৯০ টি পরিবারের উল্লেখ রয়েছে এবং জনসংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫০,০০০ জন। তবে বর্তমানে পটুয়াখালী ও বরগুণা জেলায় জনসংখ্যা মাত্র ৪ হাজার। এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমার পেছনে জমি বেদখলকে দায়ী করা হয়, যার ফলে রাখাইনের সংখ্যা দিন দিন কমছে।

রাখাইন শব্দটি তিব্বতি-বর্মী ভাষার শব্দ বোয়াং। এর রূপান্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয় যার অর্থ দাঁড়ায় আরাকান। রাখাইন নেতা তাহানের মতে, রাখাইন শব্দের উদ্ভব ঘটেছে রক্ষা এবং রাখাইন শব্দ থেকে। এ দুটি পালি শব্দ এবং সম্মিলিতভাবে এর অর্থ দাঁড়ায় রক্ষণশীল জাতি। রাখাইনরা ধর্ম, কৃষি, ঐতিহ্য রক্ষা করে এসেছে বলে তাদের নাম রাখাইন রাখা হয়েছে।

ভাষা
মারমা ভাষার সঙ্গে রাখাইনদের ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে মিল লক্ষ্য করা যায়। রাখাইনদের ভাষা তিবেতান ভাষার অর্ন্তভুক্ত। তারা লিখিত রাখাইন ভাষা কিয়াং বা মন্দিরে এবং গ্রাম্য টোলে ব্যবহার করেন।

উত্তরাধিকার
রাখাইন সমাজে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা বিদ্যমান। পিতার অবর্তমানে মাতা সংসারের দেখভাল করেন। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে পুত্র ও কন্যা সমান অধিকার ভোগ করেন। স্বামী মারা গেলে স্ত্রী স্বামীর সমুদয় সম্পত্তি পান এবং স্ত্রী মারা গেলেও স্বামী স্ত্রীর সম্পদ লাভ করেন।

ধর্ম
রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ ধর্মের আচারাদি ঠিক রেখে প্রকৃতি পূজাও করে থাকেন। সমাজে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে। রাখাইনরা তাদের অত্যন্ত সম্মান করেন। বৌদ্ধদের পবিত্র দিনগুলির মাঝে হল: বৈশাখী পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, ভাদ্র পূর্ণিমা, কার্তিকীপূর্ণিমা ও মাঘীপূর্ণিমায় নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, শিশু-বৃদ্ধ সকলেই বৌদ্ধের পরমবাণী শ্রবণ করে বৌদ্ধমন্দিরে যেয়ে। বৌদ্ধপূর্ণিমা হচ্ছে রাখাইনদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। প্রদীপ প্রজ্জলিত করা, বৌদ্ধমন্দির আলোকসজ্জা করা, আতসবাজি ও ফানুস উড়িয়ে যথাযোগ্য শ্রদ্ধার সাথে এ দিবসটি উদযাপন করেন।

গৃহায়ন
নদীর পাড়, সমুদ্র উপকূল ঘেঁষে সমতল ভূমিতে রাখাইনরা ঘরবাড়ি নির্মাণ করেন। সংঘবদ্ধ হয়ে পাশাপাশি বসবাস করেন তারা। কয়েকটি বাড়ি মিলে একটি পাড়া গঠিত হয়। মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর মত রাখাইনদের বাড়ি মাচাং ঘরের মত করে তৈরি করা হয়। কয়েকটি পাড়া মিলে চোয়াই এলাকা গঠিত হয়। বাড়ির সামনে ও পিছনে উঠোন বা বাগান করার জন্য কোন জায়গা থাকে না। ফুলের বাগান, তুলসীতলা, নাটমন্দির ইত্যাদি থেকে রাখাইনদের পাড়ায় সার্বজনীন মন্দির, পাঠশালা, বড় বড় পুকুর, বৌদ্ধ মঠ রয়েছে এবং এগুলোর ব্যবহার সর্বজনবিহিত। রাখাইনদের বাড়ির নির্মাণশৈলী বিশেষ ধাঁচের। মাঁচা তৈরি করে তার উপর ঘর নির্মাণ করে তারা বসবাস করেন।

পানি উৎসবে রাখাইন কিশোরীরা

বিবাহ
রাখাইনদের আনন্দ-উৎসবের অন্যতম সামাজিক মাধ্যম হল বিয়ে। আষাঢ় মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত কোন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় না কারণ সে সময়ে রাখাইনরা আমন ধান বোনেন, কঠিন পরিশ্রম করেন এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ঘরে বাইরে চাষাবাদের কারণে ব্যস্ত থাকেন। এ সময় হাতে টাকা পয়সা থাকেনা, মেজাজ মর্জি থাকে রুক্ষ এবং কঠিন পরিশ্রম করা হয় বিধায় বিয়ের আয়োজন করা হয় না।

সংস্কৃতি
পূর্বে রাখাইনরা তাদের জায়গা-জমি, ধন-দৌলতে সমৃদ্ধশালী ও স্বনির্ভর ছিলেন। চাষের জমি ও ধন-সম্পত্তি থাকার কারণে গড়ে তুলেছিলেন বড় মন্দির, বৌদ্ধ বিহার, শ্মশান, শান বাঁধানো পুকুর। সাজ-সজ্জা, পোশাক অলঙ্করণ এবং হাসি খুশিতে রাখাইন মেয়েরা সব সময় উৎফুল্ল থাকেন। বিভিন্ন ধরনের উৎসব যেমন পূর্ণিমা চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষ উদযাপন, জলকেলি খেলা বা পানি উৎসব, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা সহ গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলো পালন করে থাকেন। রাখাইনরা আমোদ প্রমোদ অত্যন্ত পছন্দ করেন। পরস্পরের সাথে দেখা হলে কুশল বিনিময় করে থাকেন, উৎসবগুলিতে কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য ও উচ্ছলতা দেখা যায়। অতিথি আপ্যায়ন সহ পালা পার্বনে নানা ধরনের সুস্বাদু নকশি পিঠা-পুলি, বিন্নী চালের রকমারি জর্দা-পায়েস অতিথি ও পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে পরিবেশন করা হয়। রাখাইনরা লৌকিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বৈশাখী পূর্ণিমা চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষ উদযাপনে জলকেলি খেলা বা পানি-উৎসব, বৌদ্ধ পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমাসহ সবকটি পূর্ণিমা তারা ঘটা করে পালন করেন।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
রাখাইন সমাজে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান। নারী-পুরুষ উভয়ে কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করেন। নানা জাতের ধান, পাট, ডাল, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, আখ, সর্ষে, তিল প্রভৃতি ফসল তারা উৎপাদন করে থাকেন। কৃষিকাজে হালচাষের জন্য তারা গরু-মহিষ পালন করেন। মাছ ধরাও রাখাইনদের অন্যতম পেশা। কক্সবাজার অঞ্চলে অনেকে মাছ ধরাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রত্যেক রাখাইন ঘরে তাঁত আছে। তারা তাঁত হতে কাপড় বোনা, লবণ উৎপাদন ও গুড় তৈরি করেন। কক্সবাজার এলাকায় বিদেশী পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের বিষয়বস্তু হল রাখাইনদের হস্তচালিত শিল্প। কিন্তু সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ের যথাযথ উদ্যোগের অভাবে এ শিল্পের অবস্থা করুণ। বর্তমানে রাখাইনদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত হচ্ছেন।

পোশাক-পরিচ্ছেদ
রাখাইনরা নিজেদের তাঁতে বোনা কাপড় পরতে পছন্দ করেন। পোশাক পরিচ্ছেদ বিশেষত রঙিন এবং সচিত্র হয়ে থাকে। তাদের তৈরিকৃত কাপড়ে নিজস্ব স্বকীয়তা ও মননের বিকাশ ঘটে থাকে। নারী ও পুরুষের কাপড়ে আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। রাখাইন যুবকেরা নিজেদের তৈরি লুঙ্গি, শার্ট ও মেয়েরা লুঙ্গি, বøাউজ, ওড়না পরিধান করে। পুরুষেরা ফতুয়ার উপরে লুঙ্গি পরেন। ঐতিহ্যগত পোশাক হচ্ছে পাগড়ি। হাতে বোনা বা বাটিক কাজ করা বর্ণময় লুঙ্গি রাখাইন পুরুষদের খুবই প্রিয়। মেয়েরা হাতে, কানে, গলায়, নাকে, কোমড়ে ও পায়ে সূক্ষ কারুকাজ করা সোনা রূপার অলংকার এবং চুলে বিভিন্ন ধাঁচের বেনী, খোঁপা বাধা, খোঁপায় সুন্দর চুল গোজা ইত্যাদি পরতে খুব ভালবাসেন।

মৃত্যু
মারা যাওয়ার পরে সাধারণত হালকা গরম পানিতে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরিধান করানো হয়। চিতায় দেওয়ার পূর্বে মন্ত্র পাঠ, যাগ যজ্ঞ অনুষ্ঠান এবং দান দক্ষিণা করা হয়। দাহ কাজ শেষ হলে ছাই ভস্ম মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। যেখানে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয় ঠিক ঐ স্থানটিতে সাদা কাপড় উড়িয়ে রাখা হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে মৃত ব্যক্তির সৎকারের জন্য সাত দিন পরে শ্রাদ্ধ করানো হয় যেখানে গ্রামের সবাই অংশগ্রহণ করেন।

তথ্যসূত্র :
মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম ও সুগত চাকমা সম্পাদিত, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭।
খুরশীদ আলম সাগর, বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা, পত্রপুট, ২০০৮।
সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসী, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, ২০০৪। ছবি: ইণ্টারনেট