পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা
তখন পনেরো ষোলো বছর বয়স, হঠাত করেই দিগন্ত ছোটো হয়ে এলো। এতোদিন দেখেছি প্রান্তর যতোই বিস্তৃত হোক, এক সময় তা দিকচক্রবালে মেশেই। দক্ষিণ যদি একটু সীমিত হয়, পুব তো ধু ধু প্রান্তর, প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠে হঠাত করে এক বিশাল আলোর বৃত্ত নিয়ে। প্রতি দিনান্তেই সূর্য দূরের ঝাউগাছকে সামনে রেখে অস্তে যায়। বাড়ির বাঁশঝাড়ের পেছনে যে গা ঝমঝম তেতুঁল গাছ, শিশুকালের আতঙ্কের গল্পের শাদা বুড়ির বাস যেখানে, ও দিকই উত্তর। মগজের ভিতরে চার দিকের এ সংজ্ঞাটি একদিন এলোমেলো হয়ে গেলো। দক্ষিণ ঘুরে গেলো পশ্চিমে, উত্তর গেলো পুবে।

রাতে সরাসরি উঠেছি পশ্চিম ছাত্রাবাসে। সকালবেলা দেখি উত্তর দিক আলো করে সূর্য উঠছে। যা পশ্চিম ছাত্রাবাস, আসলে তা দক্ষিণ দিক। যেটাকে দক্ষিণ ছাত্রাবাস বলছে সবাই, আসলে ওটি তো ক্যাম্পাসের পুবদিকে। উত্তর ছাত্রাবাসটি পশ্চিমে অবস্থিত। পার্থক্য এটুকুই যে পশ্চিম ছাত্রাবাসের গা গলে সূর্য ডুবে না। ডোবে দক্ষিণ ছাত্রাবাসের আড়াই তলা ছাদের গা ঘেঁষে।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-কর্মজীবন মিলিয়ে যে শহরে দীর্ঘ দুই দশক কাটিয়ে এসেছি, প্রথম দিনের সেই দিকভ্রমটি কোনোদিনই কাটেনি আমার। এই দীর্ঘ বিশ বছরে কাছের দূরের কতো মানুষকে কখনো সরাসরি, কখনো আবার আকারে-ইংগিতে জিজ্ঞেস করেছি, তাদেরও কি এমন হয়? তাদেরও কি মনে হয় ঢাকার উত্তর আকাশ আলো করে সূর্য ওঠে প্রতিদিন?
অনেকেই চোখ বড় করে তাকিয়েছে। কেউ কেউ আকারে-ইংগিতে বুঝিয়েছে গ্রীন রোডে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট বসেন, আমি সময় করে দেখিয়ে নিতে পারি। ছাত্র জীবনে পড়ার চাপে, কবিতার পেছনে অত্যধিক ছোটাছুটি কিংবা চাকুরীর টেনশনে এমন হয়ে থাকে। অথচ আমি কখনোই এসব টেনশনে থাকিনি। জীবনকে উপভোগ করেছি নিজের সামর্থের বাইরেও। কিন্তু ওই যে দিক বিভ্রান্তি, সেটি কোনোদিনই কাটেনি।

কতোবার রানওয়ে ছুঁয়ে উড়ে গেছে এরোপ্লেন। দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উড়েছি ঢাকা থেকে। মাটি থেকে উপরে উড়ে চলা এরোপ্লেনের অপ্রশস্ত জানালা দিয়ে সবাই দেশলাইয়ের কাঠির বাক্সের মতো ঢাকার ঘিঞ্জি দালানের সৌন্দর্য দেখেছে। আমি কিন্তু তখনো দেখেছি ঢাকার দিকচক্রবালের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমের ভ্রম।

জীবনের এ মোটামুটি দীর্ঘ সময়ে পৃথিবীর নানান প্রান্তে থেকেছি। কিন্তু দিকভ্রমের সেই ভুলটি নিজে নিজেই অন্যান্য বাস্তবতার নিয়ামক দিয়ে শুদ্ধ করে নিয়েছি। কোনোদিনই সেই পনেরো যোল বছরের মগজে গেঁথে থাকা উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমের ধারণাটি বদল করতে পারিনি।

যতই বদলে দাও বদলে যাই বলি না কেনো, মানুষকে বদলে দেওয়া এতো সহজ বিষয় নয়। পরিণত বয়সে তো তা প্রায় অসম্ভবই বটে। তাই তো মনীষীরা শিশু বয়সের শিক্ষার উপর এতো জোর দিয়ে থাকেন। কাদামাটির ছাঁচে বসানো মাটির পাত্রটির মতোই। যতোই রোদে-জলে-আগুনে পুড়ে শক্ত হবে, ততোই কঠিন হবে অবয়ব পরিবর্তন। মানুষের মস্তিষ্কও ঠিক তেমনি। মগজের কোষের গঠন একটা ছাঁচে গড়া হয় একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত। তারপরে যতোটুকু পরিবর্তন -পরিবর্ধন সে ওই পারিপার্শ্বিক নিয়ামকের সাথে সমীকরণ মিলিয়ে।
বাঙালি জাতিগোষ্ঠী যাঁর কাছে প্রতিটি পদক্ষেপে ঋণী, সেই মহান মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শান্তিনিকেতনের এক অধ্যাপককে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, শিশু বয়সে সংগীতের প্রভাব সম্বন্ধে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“আমাদের বিদ্যালয়ে আজকাল গানের চর্চাটা বোধ হয় কমে এসেছে, সেটা ঠিক হবে না। ওটাকে জাগিয়ে রেখো। আমাদের বিদ্যালয়ের সাধনার নিঃসন্দেহে ওটা একটা প্রধান অংগ। শান্তিনিকেতনের বাইরের প্রান্তরশ্রী যেমন অগোচরে ছেলেদের মনকে তৈরী করে তোলে তেমনি গানও জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলবার একটি প্রধান উপাদান। ওরা যে সকলেই গাইয়ে হয়ে উঠবে তা নয় কিন্তু ওদের আনন্দের একটি শক্তি বেড়ে যাবে, সেটাতে মানুষের কম লাভ নয়।”

একটি জাতির কিংবা জনগোষ্ঠীর চিন্তাপ্রসূত কল্পনার রাজ্য গড়ে ওঠার পেছনে অনুকরণীয় এবং অবশ্যই অনুসরণীয় কিছু দৃষ্টান্ত প্রয়োজন। পরিবার তো প্রাথমিক সোপান। কিন্তু প্রত্যেকটি পরিবারের মূল্যবোধকে সামগ্রিকভাবে একটি গোষ্ঠীগত মূল্যবোধের সাথে ‘মেলাবে-মিলিবে’ রকমের সংযোজনের মাধ্যমেই একটি আদর্শ সমাজ গড়ে ওঠে। আর সে ক্ষেত্রে পরিবারের পরেই একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনের কথা মনে পড়ে।
‘বাল্যশিক্ষা’ বা ‘আদর্শলিপি’ পড়তেই হবে তেমনটি নয়। কিন্তু শিক্ষা এবং আদর্শ শিক্ষাটা জরুরি। আর সেটা শিশুশিক্ষার প্রতিষ্ঠান এবং পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমেই দেয়া উচিত।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের বিপুল বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার থেকে ‘শিশু‘ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো প্রত্যেকটি মানুষের বেড়ে ওঠার সময়ে আবশ্যিক পাঠ্য। একবার ভাবুন তো, যে শিশু ‘খোকা’, ‘জন্মকথা’, ‘খেলা’, ‘খোকার রাজ্য’ কিংবা ‘বীরপুরুষ’ কবিতা পড়ে বড় হয়ে ওঠে, তার আদর্শ মানুষ হওয়ার সোপানের ভিত্তিটা মজবুত তো হবেই।
শুধু রবীন্দ্রনাথই পড়তে হবে সেটা নয়, কিন্তু শিশু বিকাশের সহায়ক রচনাগুলো পড়তেই হবে। অথচ আমাদের শিশুতোষ পাঠ্যপুস্তক থেকে একে একে এ সব রচনা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। খুউব সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত বা চক্রান্ত এসবের পেছনে কাজ করছে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন শিশু শিক্ষাকে বিজ্ঞানমুখী করছে, সমমান এবং সমপর্যায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছে ভবিষ্যত প্রজন্মকে; বাংলাদেশে তখন অবৈজ্ঞানিক ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমার দিক বিভ্রমের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মতো একটি জাতিগোষ্ঠী এক সময়ে দিকভ্রান্ত চক্রবালের চোরাবালিতে পথ হারাবে মগজে গেঁথে যাওয়া কুশিক্ষার প্রভাবে। ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’ প্রবাদটির কথা মনে রেখে এখনই প্রয়োজন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সবার জন্য সমমানে রেখে আধুনিকরণ করা।

ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী, হ্যামিল্টন, কানাডা