ভজন সরকার : (৪)
সেদিন শতাব্দী এক্সপ্রেসে ফিরছিলাম। ফারাক্কার ওপর দিয়ে এলাম। মনের এক কোণে জলবন্টনের বৈষম্যটা গেঁথে ছিল। শুকনো পদ্মার খাড়িটা ভেসে উঠলো চোখে। খুবই ছোটবেলায় পদ্মায় স্টিমার ছিল। সে স্টিমার থেকে বাতি বেরুতো–দেখাতো আলোকিত কতো আলোর নিশানা। সে স্টিমার নেই। নেই পশ্চিম আকাশের সে দিগন্ত আলো-করা ঝিলিক-মারা রোশনাইও। খুব ছোটবেলার সে স্মৃতি শৈশবেই হারিয়ে গিয়েছিল বুকে বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস রেখে। এবার ফারাক্কা পাড় হতে হতে বুকের দীর্ঘশ্বাসটুকু আবার যেন ফিরে এলো নতুন করে। কতদিন পদ্মা দেখি না। দেখি না নদীভাঙ্গা জলের ঢেউ। উজানে বসে ভাটির দীর্ঘশ্বাসে বুকটা যেন ভারী হয়ে এলো। কেন? জানি না। জানলেও বোঝাতে কি পারি কাউকেও? শুধু কষ্টটুকুই যা বাড়ে। নদীভাংগা মাটির চাঁইয়ের মতো ঝুপ ঝুপ ভেংগে পড়ে সীমান্ত পারাপারের বেদনা। আহা ৃ কান্নার আছে কতো রকমের অব্যক্ততা!

বোলপুরে এসে থামলো শতাব্দী এক্সপ্রেস। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে পড়লাম- শান্তিনিকেতন। হঠাৎ করেই যেন বর্তমান নিমিষে পেরিয়ে গেল শত বছরের বাধা। শুভ্রকেশে কে যেন দাঁড়িয়ে। কেউ তো নেই। চোখের সামনে কেউ-ই তো নেই।
ভাবলাম, শুধু চোখ দু’টোই কি দেখায় মানুষকে? মনকে বুঝালাম- যাকে দেখার জন্য এত ঔৎসুক্য তিনি তো চোখের বস্তু নন- মনের ভিতরে যে সবুজ কুঠুরি- তাঁর অবস্থান তো সেখানেই। তবে কেন এ বাইরের অণ্বেষণ? পর্দা টেনে দিলাম জানালার। ভাটিতে বসে উজানের জন্য বুকে এ কেমন দীর্ঘশ্বাস? এবার কষ্ট নয়- যেন কত প্রশান্তি- অনেক অনেক যুগের ওপার হতে বহে আসা শীতল হাওয়ায় যেন এক স্নিগ্ধ অবগাহন। আহা—সুখেরও আছে কতো কতো রকমের অব্যক্ততা! অব্যক্ত কতো কতো ভালবাসা আছে প্রতিদিন না-দেখা অথচ প্রতিক্ষণ বুকে রাখা সে মানুষটির জন্যও। সে মানুষটি রবীন্দ্রনাথ।

আমার মতো করে “আমার রবীন্দ্রনাথ”। আপনার মতো করে “আপনার রবীন্দ্রনাথ”। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মতো ক’রে বললে,”
“কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায়-তোলা জলপ্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে”।
আমাদের রবীন্দ্রনাথ যেন “কেতকী” আর “লাবন্য” উভয়ের প্রতি “অমিত রয়”-এর ভালবাসা। কখনো আমরা তুলে নিই- ব্যবহার করি নিজেদের প্রয়োজন মতো আবার কখনো সাঁতার দিই ভালবাসার স্নিগ্ধ অবগাহনে।

শতাব্দী এক্সপ্রেসের বন্ধ জানালা দিয়ে দেখলাম “রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন” দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল। কিন্তু মনের ভিতরে তখনো রবীন্দ্রদিঘি-সেখানে আমাদের অনন্ত ডুব সাঁতার।

(৫)
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, প্রত্যেক মানুষ মোটামুটি একই গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারা জীবন বলে। একই কথা। একই অনুসংগ। অধিকাংশই নিজের বীরত্ব গাঁথা কিংবা এই আরেকটুর জন্যে হলো না, এ জাতীয় গল্পকাহিনী।
বাবার এক বন্ধু ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। প্রায় সন্ধ্যাতেই আড্ডার আসরে কাকার সেই একই কাহিনী :
“টাংগাইল থেকে নাগরপুর হয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি এগিয়ে আসছে। যাবে ভাদ্রা- দৌলতপুর-বড়বিলা-তেরশ্রী- ঘিওর বাজার হয়ে মানিকগঞ্জ। আমাদের যে সোর্স ছিল, নাম আক্কাস। আক্কাস একদিন খবর পাঠালো। আমরা তখন সাটুরিয়ার দরগ্রামে অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। শোনা মাত্রই যার যার মতো রেডি হয়ে বসে পড়লাম দরগ্রামের পাশ দিয়ে যে খাল গেছে তার পাড়ে। রাত পেরিয়ে যায়। মিলিটারি আসার নাম গন্ধ নেই। ব্যাটা আক্কাস ভুল সংবাদ দিলো না তো। আমি বললাম আর একটু এগিয়ে দেখি। ঠিকই এগিয়ে গেলাম। কিন্তু তখন রাত পেরিয়ে দিন হয়ে গেছে। মিলিটারি ঘিওর বাজার পুড়িয়ে দিয়ে মানিকগঞ্জের দিকে চলে গেছে ততক্ষণে। একটুর জন্য সন্মুখ সমরের অভিজ্ঞতাটুকু হলো না …।”

কাকার গল্প চলতেই থাকে বছরের পর বছর। অথচ মিলিটারি যে পথ দিয়ে যাচ্ছিল দরগ্রাম থেকে তার দূরত্ব কম করে হলেও মাইল পাঁচেক তো হবেই। পাঁচ মাইল দূরে অবস্থান নিয়ে বসে থাকা মুক্তিযোদ্ধা কাকার এই “আরেকটু হ’লে” বীরত্বের গল্প সারা শৈশব-কৈশোর শুনে এসেছি।
আমাদের এলাকায় এক রাজাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। একাত্তরে শান্তি কমিটির থানা সভাপতি। ৭৫-এর পরে এলাকায় নানারকম অত্যাচার শুরু করলো। তারপর থেকে বাবার গল্প,
“এখন তো হাকিম ভাই বলেন,” এই তোর জন্যেই তো ব্যাটা এখনো বেঁচে। ১৬ ডিসেম্বর রাতে ক্যাম্পে ধরে আনলাম। চোখ বেধে ফেলেছি। পজিশন নিয়েছি। শুধু একটা চাপ। কিন্তু তুই ব্যাটাকে শেষ করতে দিলি না। বললি, থাক হাকিম ভাই, ছেড়ে দ্যান। এখন তো জ্বালাবেই।”

বাবার আক্ষেপ সারাজীবন, “আহা, কেন যে রাজাকারটাকে বাঁচিয়ে রাখলাম। তখন আরেকটু চোখ বন্ধ রাখলেই তো শেষ হয়ে যেতো।”
মানুষ অসহায় হলেও বুঝি সারাজীবন এই “আরেকটু”-র আপসোস করে।
অথচ সময় বড় নির্মম। অধিকাংশ মানুষই অতীতের “আরেকটু”-র পুনরাবৃত্তি দেখতে পায় না। যা চলে যায়, তা চিরদিনের জন্যেই যায়। চলে যাওয়া সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া সে তো আরেক চোরাবালি। অধিকাংশ মানুষ সেটা বুঝতেই পারে না। বহতা সময়ের সারথি হয়ে এভাবেই বহে চলে মানুষের জীবন। কেউ শক্ত-সামর্থ হয়ে রশিটা তুলে নেন নিজের হাতে কিন্তু অনেকেই ছেড়ে দেন অদৃশ্য- অদৃষ্ট- নিয়তির হাতে।

আমার বড়মা (জেঠিমা) কালবোশেখী ঝড় এলে গলায় শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে খোলা উঠোনে কাঠের পিঁড়ি উল্টো করে পেতে বায়ুর দেবতা পবনের উদ্দেশ্যে বলতো, “পবন দক্ষিণ দিকে যা”।
পাশ থেকে একজন বলতো, “আরে দিদি কী বলছো, দক্ষিণ দিকে তো তোমার বাপের বাড়ি”।
বড়মা সংশোধন করে বলতো, “ পবন, দক্ষিণ দিকে যাস না, উত্তর দিকে যা”।
আবার পরক্ষণেই বুঝতো “উত্তর দিকে তো বোনের বাড়ি”।
আবার সংশোধন করে বলতো, “পবন, দক্ষিণ-উত্তরে যাস না, পুব দিকে যা”।
আরেকজন বলত, ‘’পুব দিকে তো মিনুর বিয়ে হয়েছে, কী বলছো এসব”।

বড়মা সেটাও সংশোধন করে পশ্চিম দিকে কালবোশেখীকে যাওয়ার জন্য বলেই বুঝতো পশ্চিম দিক থেকেই ঝড় ধেয়ে আসছে। ফলে পশ্চিম দিকে আর যাওয়া সম্ভব নয়।
অসহায় বড়মা তখন নিয়তির উপর ছেড়ে দিয়ে বলতো, “পবন, তোর যে দিকে খুশী সেদিকেই যা, কিন্তু কারও ক্ষতি করিস না”।
একেকবার ভাবি, নিয়তি, অদৃশ্য ও অদৃষ্টে বিশ্বাস করেই তো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ বেঁচে আছে। সে নিয়তি ঈশ্বর, ভগবান , আল্লাহ-যিশু হবেন সেটা শুধু নয়। সমাজের প্রতিপত্তিশালী মানুষ কিংবা দন্ডমুন্ডের হর্তাকর্তা কতো ক্ষমতাসীন রথি-মহারথিদের আশীর্বাদ ও অনুকম্পার উপরে কোটি কোটি মানুষ বলির পাঁঠা হয়ে বসে আছে। এই সব ক্ষমতাদাম্ভিকগন তো একপ্রকার নিয়তিই- আমাদের মতো অধিকাংশ সাধারণ মানুষের কাছে।

আমরা কিছুই করতে পারি না। কোনো দিকেই প্রলয়কে যেতে বলতে পারি না। কারণ, সবদিকেই তো মানুষ। বড়মার মতো করে শুধু বলতে পারি, “তোদের যেদিকে খুশী যা, কিন্তু কারও ক্ষতি করিস না”।
কিন্তু চাই বা না-চাই দেশে দেশে মানুষের প্রতি পাশবিকতা তো হচ্ছে। বাংলাদেশ – পাকিস্তান-আফগানিস্তান-সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে কী নির্মম নারকীয়তা হচ্ছে। সবই ধর্মের নামে। ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে, ধর্মে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে এবং কখনো কখনো একই ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে এ নারকীয়তা হচ্ছে।
মহাত্মা গান্ধীর দেশ, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রাণপুরুষ নেহেরুর দেশ, অহিংসার প্রচারক মহামতি বুদ্ধের দেশ, বিশ্বের বৃহত্তম গনতন্ত্রের দেশ ভারত। নিছক ধর্মের নামে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটছে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতেও।

কেনো এসব হচ্ছে? এর পেছনে কা’দের ইন্ধন আছে? রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি -কোথায় এর শেকড়? এ নিয়ে হাজারটা যুক্তিতর্ক আছে। বছরের পর বছর এ নিয়ে আলোচনা করাও যাবে। কখনো পক্ষের –কখনো বিপক্ষের নিক্তি ভারী হবে। কিন্তু যেই জিতুক,আসলে পরাজিত হবে মানুষ। দলিত হবে মানবতা। নিষ্পেষিত হবে মানবিক মুল্যবোধ।
আমাদের মতো আমজনতার কতটুকুই বা করার আছে; শুধুমাত্র মানুষের শুভবুদ্ধি নামক নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া ছাড়া। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষাটুকু সচল রাখতে হবে – হোক না তা আপাতদৃষ্টিতে যতই ম্রিয়মান।

কে জানে, অসংখ্য বিন্দুর সম্মিলনেই সিন্ধুর মতো উত্তাল হয়ে ভাসিয়ে নেবে অমানবিক দানবদের একদিন। জয় মানুষেরই। জয় মানবতারই।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, ওন্টারিও, কানাডা।)